Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ভোট নেই, তাই টিকা নেই?
Coronavirus

ছোটদের টিকাকরণ না হলে সুরক্ষায় ফাঁক থেকেই যাবে

আদালতের চাপে পড়ে প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা জোগাতে সরকার এখন দায়বদ্ধ।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:১২
Share: Save:

আঠারো বছরের কম বয়সিদের কোভিড টিকা দিতে সরকারি দোদুল্যমানতা, বা বলা ভাল অনীহা দেখে আজ বোধ হয় আলেকজ়ান্ডার সাহেব বলতেন, সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশের সরকার! দীর্ঘ লকডাউন পেরিয়ে সারা দেশে স্কুল-কলেজ খুলছে, টিকা না নেওয়া অরক্ষিত শিশু ও কিশোরদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে, পাশাপাশি ওমিক্রনের বিপদ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও, এবং আঠারো বছরের কমবয়সিদের জন্য দু’টি টিকা হাতে মজুত থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও তাদের জন্য টিকাকরণের কোনও পরিকল্পনা বা ঘোষণা করেনি, বরং লোকসভায় দাঁড়িয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে ‘আলোচনা চলছে’!

একটু পিছনে ফিরলেই স্পষ্ট হয় যে, মন্ত্রী মহাশয়ার বক্তব্যে যুক্তি কম, অজুহাত বেশি। ২০২১ সালের ২৪ জুন কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম ঘোষণা করে যে, বারো থেকে আঠারো বছর বয়সিদের টিকাকরণ জুলাইয়ের শেষ বা অগস্টের গোড়ায় শুরু হতে পারে। এর পর অগস্টে কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থা ‘ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া’ জ়াইকোভ-ডি টিকাকে বারো বছরের বেশি বয়সি শিশুদের উপর প্রয়োগের অনুমতি দেয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কোভ্যাক্সিনকে অনুমতি দেয় সংস্থারই বিশেষজ্ঞ কমিটি। মন্ত্রী মহাশয়াকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, এত কিছুর পরেও বিজ্ঞান কি কিছু কম পড়িয়াছে?

পাশাপাশি মনে করা যাক, কী ভাবে গত জানুয়ারির গোড়ায়, তৃতীয় দফার ট্রায়াল চলাকালীনই, কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন সরকারি ছাড়পত্র পায়, আর দেশ জুড়ে টিকাকরণও শুরু হয়ে যায় দু’সপ্তাহের মধ্যেই। এমনকি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদীও ১ মার্চ কোভ্যাক্সিন টিকা নেন। বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক অনুমতির আগেই অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে শুরু হওয়া এই টিকাকরণ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছেন না, কেননা মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং ভয়ানক অসুস্থতা থেকে রেহাই দিতে হয়তো এই সিদ্ধান্তের প্রয়োজন তখন ছিল। আসল প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই দ্রুততা থাকলেও শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে কেন বৈজ্ঞানিক ছাড়পত্র পাওয়ার এত মাস পরেও সেই বিজ্ঞানের দোহাই দিয়েই বিপরীত আচরণ?

আসলে আঠারো বছরের নীচে ভোট নেই, রাজধানীর রাস্তা বন্ধ করে রাজনীতিকে উথালপাথাল করার ক্ষমতাও নেই, ফলে তার জন্য টিকাও নেই। একই কারণে সরকার তো দূরস্থান, তাদের সঙ্গে বিরোধীরাও নেই। সরকার বিজ্ঞানের দোহাই দিলেও, এখনও টিকাকরণ শুরু না হওয়ার পিছনে অর্থনীতি ও রাজনীতির যুগলবন্দির কথাই উঠে আসছে। শোনা যাচ্ছে, জ়াইকোভ-ডি টিকা কিনতে গিয়ে দরাদরিতে পিছিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার, পাশাপাশি কোভ্যাক্সিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টিকা-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি, ফলে হাতে কিছুটা জমিয়ে রাখাই শ্রেয়! এ ছাড়াও সরকারি কর্তাব্যক্তিরা মনে করছেন, যে হেতু আঠারো বছরের কমবয়সিদের মধ্যে সংক্রমণের হার ও তীব্রতা কম, তাই আপাতত দেশের ৪১ শতাংশ নাগরিকের— সংখ্যার হিসাবে ৫০ কোটির আশেপাশে— ভবিষ্যৎ ঈশ্বরের হাতে (পড়ুন, কোভিডের হাতে) ছেড়ে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত! অন্য দিকে, আদালতের চাপে পড়ে প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা জোগাতে সরকার এখন দায়বদ্ধ। এটাও স্পষ্ট যে, হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন পার্লামেন্ট ভবন, রেকর্ডধারী উচ্চতাসম্পন্ন মূর্তি অথবা তাক লাগিয়ে দেওয়া মন্দির নির্মাণ তাঁদের তালিকায় থাকলেও, শিশুদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করাটা বোধ হয় সরকারি অগ্রাধিকারের মধ্যে নেই।

প্রশ্ন হল, সত্যিই কি শিশু-কিশোরেরা কোভিড সংক্রমণে একেবারে নিরাপদ? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) তেমনটা বলছে না। তাদের তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ থেকে ১৫ অক্টোবর, ২০২১ অবধি চোদ্দো বছর বা তার কম বয়সি প্রায় দশ লক্ষ শিশু আক্রান্ত হয়েছে, আঠারো বছর অবধি ধরলে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক লক্ষ বাড়বে। তারা এ-ও সাবধান করছে, যে হেতু শিশুদের কোভিডের লক্ষণ অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল হয়, তাই শিশুদের কোভিড পরীক্ষাও হয় তুলনামূলক ভাবে কম, ফলে কোভিড ধরাও পড়ে অনেকটাই কম। এটাও জানা যাচ্ছে যে, আক্রান্ত শিশুদের ‘লং কোভিড’, অর্থাৎ কোভিড থেকে দীর্ঘকালীন শারীরিক সমস্যা বড়দের মতোই হতে পারে, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই ডায়াবিটিস, স্থূলতা, হাঁপানি, হৃদ্‌যন্ত্র ও ফুসফুসের সমস্যা, স্নায়ুর অসুখ অথবা ডাউন সিনড্রোমের মতো কঠিন রোগে ভুগছে। এই সব নানা কারণেই পৃথিবী জুড়ে বেশ কয়েকটি দেশে শিশুদের টিকাকরণ ইতিমধ্যে বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই শুরু হয়ে গিয়েছে। বস্তুত, আমেরিকার সরকার সম্প্রতি যে কয়েক দফা আশু করণীয় নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে, তার একেবারে উপরের দিকেই আছে আঠারো বছরের কম বয়সিদের টিকাকরণ। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, ওমিক্রন নামক ভাইরাসের নতুন চেহারা পৃথিবী জুড়ে আবার ভয় ধরাচ্ছে। সে বিষয়ে গোড়ার দিকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগের তুলনায় শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের হার দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে বাড়ছে।

ভারতের বর্তমান ছবিটাও খুব একটা উজ্জ্বল নয়। হয়তো শিশুদের মধ্যে কোভিডে মৃত্যুর হার তুলনায় কম, কিন্তু সংক্রমণের হার টক্কর দিচ্ছে বড়দের সঙ্গে। গত জুন-জুলাই মাসে সারা দেশ জুড়ে যে গবেষণা হয়, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, শিশু-কিশোরদের মধ্যে সংক্রমণের হার বয়স্কদের প্রায় সমান। তথ্য বলছে, দেশে কোভিডের সংক্রমণ ধরা পড়ার হিসাবেও পাঁচ বছর অবধি যাদের বয়স, তাদের সংখ্যা সত্তর থেকে আশি বছর বয়সিদের সঙ্গে একেবারে তুল্যমূল্য। এই কলকাতা শহরেও প্রতি দিন যে পরিমাণ কোভিডের সংক্রমণ ধরা পড়ছে, তার প্রায় ৭ শতাংশের বয়স আঠারোর নীচে।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, এই মুহূর্তে শিশুদের টিকাকরণে নিষেধ করছে না বিজ্ঞান, বরং উল্টোটাই বলছে। বিশেষজ্ঞদেরও স্পষ্ট মতামত, আঠারো বছরের কমবয়সিদের এখনই টিকাকরণ শুরু করা উচিত, কেননা বয়স্করা টিকা নেওয়ার ফলে বেশ খানিকটা সুরক্ষিত থাকলেও আঠারো বছর নীচে যাদের বয়স, তাদের প্রায় কোনও রক্ষাকবচই নেই, বিশেষত তারা যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যেতে শুরু করেছে। হয়তো বয়স অনুযায়ী ধাপে ধাপে টিকাকরণ করাই যথাযথ, কিন্তু কমবয়সিদের শুরুটা তো করতে হবে। এটাও মনে রাখতে হবে, শিশু-কিশোর’সহ সবাইকে টিকা-সুরক্ষার ছাতার তলায় আনতে না পারলে সমাজের সামগ্রিক সুরক্ষা তৈরি করা যাবে না। আমরা ইতিমধ্যেই পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার রেকর্ড করে ফেলেছি। প্রায় একটা গোটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের সামনে ফেলে দিয়েছি, অজস্র শিশু ইতিমধ্যেই স্কুলছুট হয়ে গিয়েছে। আমরা কি কোভিডের পরবর্তী ঢেউকে শিশু-কিশোরদের মধ্যে আনার ব্যবস্থা করে আর এক দফা স্কুল-কলেজ বন্ধের দিকে এগোতে চাইছি? প্রধানমন্ত্রী কি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন অথবা ঝাঁ-চকচকে মন্দির চত্বরের দারোদ্ঘাটন ইত্যাদি সামলে সময় করে একটু এ নিয়ে ভাববেন? না কি শিশুদের ভবিষ্যৎ এমনই অন্ধকারে ঠেলে দেবেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus COVID19 Vaccine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE