E-Paper

অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে

কিছু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। লক্ষণীয়, মানবসমাজে জাতিদ্বন্দ্বেও সেই বিলোপের ছায়া। জাতি তো কেবল শারীরিক উপস্থিতি নয় জাতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটি ভূখণ্ড, ভাষা আর ধর্ম সংস্কৃতি।

মোহিত রায়

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:৫২

ভবিষ্যৎ-বলা জ্যোতিষ-ব্যবসায়ী বা কিছু ধর্মব্যবসায়ীদের কাজ। কিন্তু আমরাও সবাই ভবিষ্যতের কথা ভাবি, বিশেষত ভাবি পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা, যাদের পৃথিবীতে এনেছি আমরাই। সেটা আমাদের দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। ভাবতে হয়, একটা সমাজ বা জাতি বা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতের কথাও। কখনও মনে হয় তাদের ভবিষ্যৎ যেন সামনেই দৃশ্যমান, বলা যায় দুয়ারে ভবিষ্যৎ।

কিছু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। লক্ষণীয়, মানবসমাজে জাতিদ্বন্দ্বেও সেই বিলোপের ছায়া। জাতি তো কেবল শারীরিক উপস্থিতি নয় জাতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটি ভূখণ্ড, ভাষা আর ধর্ম সংস্কৃতি। জাতিদ্বন্দ্বে ঘটে কখনও গণহত্যা, কখনও জাতি বিতাড়ন, কখনও ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি বিলুপ্তকরণ। সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকায় এর প্রয়োগ ঘটেছে, প্রয়োগ ঘটেছে উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত। দেখেশুনে আশঙ্কা হয়, এখন যেন সেটাই ঘটে চলেছে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশেরই গবেষণা বলছে, চোখের সামনে গত সাত দশকে সে দেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা অনেকাংশে কমে গিয়েছে। তার উপর গত জুলাই থেকে বাংলাদেশে ছাত্র অভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী ইসলামি বিপ্লবে হাসিনা সরকারের পতনের সময় থেকে শুরু হয়েছে সংখ্যালঘুর উপর লাগাতার আক্রমণ। অন্তর্বর্তী সরকার ও তার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বলে চলেছেন, এ সব ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার, আসলে কিছুই ঘটছে না। কিছু না ঘটলে এমন অমূলক প্রচার সম্ভব কি? বাস্তবিক, এই প্রথম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় মনে হয়েছিল যেন পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের সরকারি মহল থেকে হয়তো এ বার কোনও প্রতিকারের চেষ্টা হবে। তেমন কিছু করা যায়নি। বাংলাদেশের হিন্দু সমাজকে এখন বিপন্ন প্রজাতি ঘোষণা করাই যায়।

আর পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ? দেখে নেওয়া যাক স্বাধীন ভারতের উদ্বাস্তুদের ছবি। স্বাধীন ভারতে নিজেদের দেশেই মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর আগে ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে দেখা গিয়েছিল কাশ্মীরি পণ্ডিত সমাজের ভিটেমাটি ব্যবসাপত্তর ছেড়ে একবস্ত্রে গণপলায়ন। বাইরে মিনারে মিনারে লাগানো মাইকে মৌলবাদীদের আস্ফালন। প্রায় তিন লক্ষ কাশ্মীরি কয়েক দিনে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছিলেন। আশ্রয় পেয়েছিলেন দিল্লি বা জম্মুর আশ্রয় শিবিরে।

ঝড়ে, বন্যায়, খরায় মানুষ সর্বস্বান্ত হয়, আবার উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি হারালে সে হারায় নিজস্ব অস্তিত্ব। কিছু দিন আগে উদ্বাস্তু কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের উপর হরিয়ানা সরকারের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশদ সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। জানা যাচ্ছে যে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ৬৮ শতাংশ পরিবারের সেখানে পারিবারিক সম্পত্তি রয়েছে, এঁদের অর্ধেক সংখ্যক পরিবার এই সম্পত্তি বিক্রয়ে রাজি নন এবং প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ আশা রাখেন তাঁরা এক দিন স্বভূমিতে ফিরতে পারবেন। এই সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে যে, মাত্র ৬০ শতাংশ মানুষ কাশ্মীরি ভাষায় তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ৪০ শতাংশ জানান যে, তাঁদের সন্তানদের কাশ্মীরি ভাষায় দক্ষতা খুব কম। অর্থাৎ, যতই এই সদ্য-উদ্বাস্তু সমাজ আবার প্রত্যাবর্তনের আশায় থাকুক না কেন, মাতৃভাষার ব্যবহারের দ্রুত অবক্ষয়ে সেই মাতৃভূমির সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের যোগসূত্র ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষার ক্রমশ বিলুপ্তিতে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের কথ্য গল্প কাহিনির ঐতিহ্য, হারিয়ে যাচ্ছে সামাজিক রীতি ও পার্বণ। চরক বা পাণিনির দেশের মানুষ হারিয়ে ফেলছে তার কয়েক হাজার বছরের যোগসূত্র। ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, কমেছে শিশু-জন্মহার। ছন্নছাড়া এই সমাজের রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। কংগ্রেস থেকে বিজেপি, কোনও সরকারই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেনি, শুধু কিছু আইনি কাগজ আর নেতাদের আশ্বাস-ভাষণই শোনা গিয়েছে।

আটাত্তর বছর আগে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে অন্তর্ভুক্ত বর্তমানে পাকিস্তানের অধিবাসী— সেই সিন্ধু প্রদেশের মানুষ। সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা অনেকেই ছিলেন বড় ব্যবসায়ী, সম্পন্ন পরিবারের, স্রেফ কয়েক দিনে তাঁদের সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে হয়েছে ভারতে। এঁরা পুনর্বাসিত হয়েছিলেন মূলত মহারাষ্ট্রে, গুজরাতে। অর্থবান সিন্ধি সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে অনেক স্কুল-কলেজ চালান। অর্থনৈতিক সমস্যা তাঁদের তেমন নেই, কিন্তু জাতি হিসাবে তাঁরা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন তা নিয়েও সন্দেহ চলে না। তাঁদের নিজের কোনও ভূখণ্ড নেই, একমাত্র মিলনসূত্র ভাষা আর ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কিছু উৎসব। সিন্ধি ভাষা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে নানা কারণেই। একটি বড় কারণ ভারত সরকার এখনও সিন্ধি ভাষার আরবি-ফারসি হরফ লিপিকেই স্বীকৃতি দেয়, যা ভারতের নতুন প্রজন্মের সিন্ধিরা জানেন না, জানতেও চান না। ফলে সিন্ধি সিনেমা, বই আর দেখা যায় না। সত্যিই তো, ভাষা হারালে কোনও জাতির পক্ষে সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখা কঠিন বইকি।

আগের দু’টি জাতির মতো দেড় হাজার বছর আগে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে, মূলত গুজরাতে, আশ্রয় নিয়েছিলেন পার্সিরা। কিন্তু ভারতে তাঁদের ধর্ম সংস্কৃতি রক্ষা হলেও শুরুতেই তাঁদের ভাষা ত্যাগ করে ভারতীয় ভাষা গ্রহণ করতে হয়েছিল। ভাষা ত্যাগ করেও ধর্ম সংস্কৃতি রক্ষার্থে এঁরা বাইরের সমাজের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। দেড় হাজার বছর ধরে ভারতে সসম্মানে টিকে থাকা ধনী প্রগতিশীল পার্সি সমাজ এখন জনসংখ্যাতেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে।

অর্থাৎ, নিজেদের ভূখণ্ড হারিয়ে ভারতে থাকা উদ্বাস্তুদের ভবিতব্যের ছবিটি আমাদের সামনেই রয়েছে। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা যে সব উদ্বাস্তুকে জোর করে পুনর্বাসিত করা হয়েছে বা আশ্রয় নিতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের অন্যান্য অংশে— তাঁরাও কি ক্রমশ তাঁদের বাঙালি অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন না? পশ্চিমবঙ্গে যে উদ্বাস্তুরা জায়গা পেয়েছেন, বাংলা বই, গান, চলচ্চিত্র, পূজাপার্বণ তাঁদের এখনও বাঙালি করে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু উত্তরাখণ্ডে, ওড়িশায় বা দণ্ডকারণ্যবাসী উদ্বাস্তুরা অনেকেই আজ আর বাংলা পড়তে পারেন না, ফলে অনেকেই ক্রমশ কাশ্মীরি বা সিন্ধি সমাজের মতো হারিয়ে ফেলছেন ঐতিহ্যগত যোগসূত্র।

এ সব কথা বলতে হচ্ছে কারণ আবার এক কঠিন সময় এখন। প্রতিবেশী দেশে অস্থিরতার সুযোগে এ পারেও অস্থিরতা ও বিপদ বেড়েছে, শোনা যাচ্ছে। দেগঙ্গা বা মল্লিকপুরের বাড়ি বিক্রি করে কেউ উঠে আসছেন নিরাপদ অঞ্চলে। এ ভাবেই পাকিস্তান বাংলাদেশে হঠাৎ দেখা যেত পাশের বাড়ি সব তালা বন্ধ, ‘ইন্ডিয়া চলে গেছে’। একবস্ত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা হাজারও পরিবারের কাহিনি আমরা জানি। সেই দুর্ভাগ্য আবারও দেখতে হবে কি না, জানা নেই।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে ভারত সরকারের নরম মনোভাবে সে দেশের সংখ্যালঘুর মতো পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিরও উদ্বেগের কারণ আছে বিস্তর। এক বার বিঘ্ন ঘটতে শুরু করলে তা কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, ইতিহাসেই তার প্রমাণ। ভারত সরকারের দিক থেকে আরও স্পষ্ট ও জোরালো বার্তা আসছে না যখন, তা হলে কি আমরা বিপন্নতর ভবিষ্যতের দিকে চলেছি?

এক দিন কিশোরগঞ্জ স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলাম বেশ কিছু ক্ষণ। কোনও ট্রেন ধরতে নয়, সাত দশক আগে এই স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে আমার কংগ্রেসি জেলখাটা মাতামহ আমার কিশোরী মা ও মাসিকে নিয়ে যে কী ভাবে পালিয়েছিলেন— তা অনুভব করতে। দুর্ভাগ্যের ইতিহাস হয়তো ভুলতে হয়, তবু অশান্তি আর হিংসা দেখলে উদ্বাস্তু সন্তানরা যে বেশি ভয় পায়, সেও স্বাভাবিক। অরণ্যে রোদন হলেও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Refugees Bangladesh Unrest Kashmiri Pandits

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy