Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ছক ভাঙার চ্যালেঞ্জ
CPM

মতে না মিললে ‘শত্রু’ ভাবার আত্মঘাতী প্রবণতা ছাড়তে হবে

সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে কৃষকের, শ্রমিকের, খেটে খাওয়া মানুষের শ্রেণিচেতনা।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২১ ০৪:৪২
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গে আট দফার নির্বাচন যখন মাঝপথে, যখন নরেন্দ্র মোদী তাঁর সভায় উপচে পড়া ভিড় দেখে আত্মমুগ্ধ হয়ে ‘দিদি-ও-দিদি’ ডাক ছাড়ছেন, আর দিলীপবাবু শীতলখুচি হবে, বারমুডা পরুন, ন্যাকামো করবেন না আর রগড়ে দেব বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখনই গোটা দেশ জুড়ে আছড়ে পড়ল করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ। রাতারাতি পরিবেশ পাল্টে গেল। নির্বাচন কত তাড়াতাড়ি শেষ হয় আর সরকার কত তাড়াতাড়ি সেই ঢেউ সামলাতে মন দেয়, তখন থেকে এটার জন্যই ছিল বাংলা তথা দেশের সাধারণ মানুষের অপেক্ষা।

কিন্তু বিজেপি প্রকৃতই একটি অ-সাধারণ পার্টি। মোটেই আর পাঁচটা দলের মতো নয়। বাংলার রায় তাদের পছন্দ হয়নি। তাই করোনা আবহেও কেন্দ্রের সরকার, কেন্দ্রীয় সংস্থা, কেন্দ্রের প্রতিনিধি রাজ্যপাল সব কিছু কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ের নতুন ব্যূহ রচনাতে তারা ব্যস্ত হয়েছে। এই পর্ব এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই দেখার।

বিজেপি কিন্তু শুধু সরকারি ক্ষমতার দল নয়। সে ক্ষমতা তো এ রাজ্যে এখনও অধরা থেকে গেল। বিজেপি মানে আসলে আরএসএস-এর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক অভিযান। কেন্দ্রের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের বিরোধী সরকারকে নাজেহাল করে রাখাটা বিজেপি রাজনীতির একটা সাময়িক ও ছোট অংশ। তারা যে আসল শিক্ষাটা নিচ্ছে তা হল বাম-কংগ্রেস ভোটে থাবা বসানো, আর তৃণমূলের নেতা ভাঙানোর শর্টকাট ছেড়ে এ বার আত্মনির্ভর সংগঠন ও রাজনীতি চাই। অর্থাৎ, চাই আরও বেশি হিন্দুত্ব। আর সে হিন্দুত্বকে আনতে হবে হিন্দির অনুপাত কমিয়ে, বাংলা ও বাঙালির গ্রহণযোগ্য করে। এ বারের ভোটে বিজেপিকে ঠেকানো গেলেও এই ছক থেকে বাংলাকে কী করে বাঁচানো যাবে?

এটাই আগামী দিনের বাংলার রাজনীতির মূল প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের জবাব হয়েই বাংলায় বামপন্থীদের আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। এই প্রশ্নের উত্তরের কিছু উপাদান ও প্রতিশ্রুতি এ বারের নির্বাচনেই চোখে পড়েছে। সেই উপাদানগুলোকে আরও বিকশিত ও সংহত করতে হবে। হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের জবাব বাংলার প্রাণের কবি চণ্ডীদাস। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। জবাব বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুল। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। এই মানবিকতা বাংলার মাটিতে, মজ্জায় মিশে আছে। আজও এই মানবিকতার পতাকা জাতের নামে বজ্জাতিকে রুখে দিতে পারে, বাংলার বিবেকের কান্ডারিকে হুঁশিয়ার করে রাখতে পারে।

সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে কৃষকের, শ্রমিকের, খেটে খাওয়া মানুষের শ্রেণিচেতনা। দাঙ্গা ও দেশভাগের কঠিন সময়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল তেভাগা, রুখে দাঁড়িয়েছিল ট্রাম শ্রমিকের ধর্মঘট। আজ এ চেতনা অবশ্যই কিছুটা দুর্বল, কিন্তু তা কি অপ্রাসঙ্গিক, অকেজো? দাঙ্গা-বিভক্ত মুজফ্‌ফরনগরের কৃষক যদি আজকের চলমান কৃষক আন্দোলনে আবার কৃষক পরিচয়ে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তবে বাংলার কৃষক কি ধর্মের নামে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজনেই আবদ্ধ থাকবে? বিজেপি যদি ক্ষমতা দখল করতে না পেরে আরও বেশি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথে পা বাড়ায়, বামপন্থীদেরও অবশ্যই শ্রেণিচেতনার প্রতি আরও মনোযোগ বাড়াতে হবে। ব্যাপক বেসরকারিকরণ, কর্মসঙ্কোচন, মূল্যবৃদ্ধি ও মজুরি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে রুটি-রুজির লড়াইয়ের নতুন তাগিদে আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে আন্দোলন।

বাংলার এ বারের নির্বাচনে মহিলা ভোট নিয়ে যথেষ্ট চর্চা চলছে। নন্দীগ্রামের নির্বাচনকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরুদ্ধে নারীশক্তির প্রতিরোধী ভূমিকার এক উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক প্রচার ও যাবতীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত খুব কম ব্যবধানেই বিতর্কিত জয়ের মুখ দেখেছেন শুভেন্দু অধিকারী। নারীশক্তির প্রতিরোধকে শুধু মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প থেকে লাভান্বিত মহিলাদের নির্বাচনী প্রতিদানের প্রশ্ন হিসেবে দেখলে ভুল করা হবে। নারীস্বাধীনতা খর্ব করাটা হল আরএসএস মতাদর্শ ও বিজেপি রাজনীতির গোড়ার কথা, প্রশ্ন হল এই নারীবিদ্বেষী রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক নারী জাগরণ ও আন্দোলন গড়ে তোলার।

নির্বাচনের মঞ্চে এ বার প্রায়ই শোনা গিয়েছে বহিরাগত বনাম বাংলার রণধ্বনি, বর্গিদের বাংলা দখল বনাম বাংলা নিজের মেয়ের কাছেই থাকুক— এই দুই দৃশ্যকল্পের সংঘাতের পটকথা। নির্বাচনী যুদ্ধে তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরুদ্ধে হয়তো এর একটা তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এর উপর দাঁড়িয়ে কোনও প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক আখ্যান কি তৈরি হতে পারে? বাংলায় যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এ রাজ্যের ভোটার। তাঁদের মধ্যে কাউকে যেমন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেওয়া যাবে না, তেমনই ভাষা বা সংস্কৃতির দিক থেকে বিজেপির আটত্রিশ শতাংশ ভোটারকেও বহিরাগত বলে চিহ্নিত করা যাবে না।

বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা অন্য জায়গায়। বাংলার উদার ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বহুমুখী বলিষ্ঠ ইতিহাস বনাম উগ্র রক্ষণশীলতা, অন্ধবিশ্বাস, সাম্প্রদায়িকতা এবং সামাজিক অন্যায় অত্যাচারের ধারা, ইংরেজ শাসকের প্রতি আনুগত্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস— বিতর্ক আসলে এই সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মাটিতে। বাংলার ইতিহাসকে শুধু দাঙ্গা ও দেশভাগের অধ্যায়ে বন্দি করে রাখার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে ধরা আজ সময়ের দাবি। যে ইতিহাসে স্বাধীনতা বলতে শুধু ব্রিটিশ শাসনের অবসান নয়, সামাজিক বৈষম্য ও উৎপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামও সমান স্থান পাবে। এই ইতিহাসই হবে সঙ্ঘ পরিবারের বাঙালি হিন্দুত্বের আখ্যানের দুর্বলতম গ্রন্থি।

এই চ্যালেঞ্জকে স্বীকার করে বামপন্থী রাজনীতির পুনর্জাগরণ ঘটাতে অবশ্যই গত চার দশকের ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিগত দশ বছর বিরোধী পরিসরে থেকেও বামফ্রন্ট কেমন যেন ‘অপেক্ষমাণ সরকার’ হয়েই থেকে গিয়েছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে বামপন্থী গণরাজনীতির অনুশীলনের প্রাণশক্তি ও শিক্ষাকে আজ আবার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ঠিক যেমন তরুণ বামপন্থী স্বেচ্ছাসেবকরা এই করোনা সঙ্কটে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন।

একই সঙ্গে কৃষিকে ‘ভিত্তি’ ধরে নিয়ে উপেক্ষা করা ও অসংখ্য রুগ্ণ ও বন্ধ কারখানার রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করে সিঙ্গুরের এক পরিত্যক্ত প্রকল্পকে কৃত্রিম স্বপ্নের ভবিষ্যৎ হিসেবে আরাধনা করার পটকথা বাংলার রাজনীতিতে গত পনেরো বছর বার বার কেন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে। রাজনৈতিক বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিজেমূলের গল্পে ডুব দিলে যে বিজেপি বা তৃণমূল কারও বিরুদ্ধেই লড়াইটা দাঁড়ায় না, এই সহজ কথাটা সহজ ভাবেই স্বীকার করে নিতে হবে।

দেশজোড়া ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলার স্পষ্ট গণ-রায় গণতন্ত্রের পক্ষে, বাংলার মানুষের সম্মান ও শান্তির সঙ্গে বেঁচে থাকার পক্ষে। এই রায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাজ্যে তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে আসা সরকারকে তার প্রতিশ্রুতি পালনে দায়বদ্ধ করতে হবে। সরকারি বিভিন্ন অনুদান প্রকল্পকে ভিক্ষাদান প্রকল্প বলে অবজ্ঞা করে তার বিপরীতে কারখানা ও চাকরির কথা বললে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইকেই হেয় করা হয়, আর এর মধ্য দিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে বামপন্থী বিরোধী পক্ষের ভূমিকাও দুর্বল হয়ে পড়ে।

সবশেষে বলি, বামপন্থী বন্ধুদের মধ্যে মতপার্থক্য হলে বন্ধুদেরই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়ার সঙ্কীর্ণ আত্মঘাতী প্রবণতা ছাড়তে হবে, পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে কথোপকথন চালিয়ে যেতে শিখতে হবে। অতীতের বহু বিতর্ক মুলতুবি রেখে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে, সঙ্ঘ বাহিনীর ছকের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে এগিয়ে যাওয়াই আজ সময়ের দাবি। সেটাই একুশের ডাক।

সাধারণ সম্পাদক, সিপিআইএম-এল লিবারেশন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP TMC CPM West Bengal Assembly Election 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE