একা রামে রক্ষে নেই, তায় সুগ্রীব দোসর! কোভিডের সংহারী রূপ, তার পরে আবার ওমিক্রন। ২০২১ সালটা বেশ দুঃখেই কাটল আমাদের। ভাইরাস একই, তবে নানা রূপে আসে। কোভিড ভাইরাসেরই এক রূপ ওমিক্রন। প্রথম দেখা গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। কতখানি সংহারী মূর্তি ধরতে পারে ওমিক্রন? এখনও পর্যন্ত তথ্যপ্রমাণ হাতে নেই।
করোনা মনে করাচ্ছে একশো বছর আগের ফ্লু অতিমারিকে। ১৯১৮-য় শুরু হয়ে যা ইউরোপ-আমেরিকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছিল এক দশক। তখনও বিমানযাত্রা সে ভাবে শুরু হয়নি। হলে ওই ভাইরাসও করোনার মতো পৃথিবী গ্রাস করত।
২০২১ সালের মধ্যে করোনা টিকা ৪৫০ কোটি মানুষকে দেওয়া হয়েছে। সেটা নিশ্চয়ই এক সাফল্য। টিকার আওতায় এখন বিশ্বের ৫৬ শতাংশ মানুষ। সেই কবে ১৮৮০-র দশকে জীবাণুকে কিছু রোগের উৎস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তখন থেকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা ভাবা হয় টাইফয়েড, পোলিয়ো, হাম, হেপাটাইটিস বি, ইবোলা রোগের ক্ষেত্রে। ও সব রোগের বেলা কোনও কোনওটার ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে দশকের পর দশক কেটে গেলেও, করোনার ক্ষেত্রে এক বছরেই প্রতিষেধক এসে যায় বাজারে। এটাও কম বড় কৃতিত্ব নয়।
বাজার বড় কথা। টিকার চাহিদা ভেবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিনের দাম যা চাইছিল, তাতে গরিব দেশগুলোয় অনেক লোক টিকা না পেয়ে মারা যেত। রুখে দিয়েছেন এক মহিলা। উইনি বিয়ানিমা (ছবিতে)। নিজে উগান্ডার মানুষ। রাষ্ট্রপুঞ্জের এডস প্রতিরোধ উদ্যোগের প্রধান। বুঝেছেন তিনি, করোনার টিকা সস্তা না হলে, বিশ্বের সমস্ত জনসাধারণ নিতে পারবে না।
কিন্তু ইন্টেলেকচুয়াল প্রোটেকশন (আইপি) রাইটস আছে না? অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা, ফাইজ়ার-বায়োএনটেক, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন, ভারত বায়োটেক-এর মতো কোম্পানি সস্তায় ভ্যাকসিন বিক্রি করবে কেন? দামি ওষুধ মানে ও সব কোম্পানির মুনাফা বেশি। ওই লক্ষ্যকে ‘ইমমরাল, গ্রিডি, রং’ আখ্যা দিয়ে বিয়ানিমা তৈরি করেন পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স। ডেকে নেন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। মে মাসে আসে ওঁদের সাফল্য, যখন আমেরিকা, পেটেন্ট রাইটস-এর কট্টর সমর্থক, পাশে দাঁড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতের, ভ্যাকসিন সস্তা করার দাবিতে। সস্তায় ভ্যাকসিন না পেলে এত দিনে করোনায় মৃত্যুহার আরও বাড়ত। সুতরাং, বিয়ানিমাকে কুর্নিশ জানাই।
কুর্নিশ তুলিয়ো দে অলিভেইরা-কেও। দক্ষিণ আফ্রিকার কাওয়াজুলু-নাটাল রিসার্চ ইনোভেশন অ্যান্ড সিকুয়েন্সিং প্ল্যাটফর্মের এই ডিরেক্টর দক্ষিণ আফ্রিকা এবং হংকং-এ রোগীদের মধ্যে ওমিক্রন ভাইরাস শনাক্ত করেন। বছরখানেক আগে তিনি করোনার আর এক রকমফের (বিটা) শনাক্ত করেছিলেন। দে অলিভেইরা সরকারি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান। জানতেন করোনার নতুন রকমফের শনাক্ত হলে দেশে বিদেশি টুরিস্টদের আসা-যাওয়া বন্ধ হবে। তবুও সত্যিটাকে গোপন করেননি। বিজ্ঞানীসুলভ আচরণ। সাহসিকতার জন্য দেশনেতাদের রোষদৃষ্টিতে পড়েছেন দে অলিভেইরা। ওঁরা ওঁকে দেশের শত্রু ঘোষণা করেছেন। শুধু ডেল্টা কিংবা ওমিক্রন নয়, পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা, জ়িকা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত করেছিলেন দে অলিভেইরা।
২০২১ সালে একটি পরীক্ষার ফল বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছিল। পরীক্ষাটি হয় শিকাগো শহরের অদূরে কণা পদার্থবিদ্যার ল্যাবরেটরিতে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গুরু নিলস বোর খুব খুশি হতেন, যখন কোনও এক্সপেরিমেন্টে উল্টোপাল্টা ফল আসত। বলতেন, ফল উল্টোপাল্টা মানে তত্ত্বের সঙ্গে মিলছে না। মানে, তত্ত্বে কিছু গোলমাল আছে। তো খোঁজো সেই গোলমাল। নতুন তত্ত্ব বেরিয়ে আসবে।
মিউওন নামে একটা কণা নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছিল। কণাটা আমাদের পরিচিত ইলেকট্রন জাতের। গোলমালটা মিউওনের চৌম্বক ধর্ম সম্পর্কে। বলা ভাল, মিউওনের চুম্বকত্ব বেশি ধরা পড়ছে। তত্ত্ব যা বলছে, তার চেয়ে বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, তত্ত্বটায় কি গোলমাল আছে? তত্ত্বের নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল। কণা পদার্থবিদ্যার একমাত্র তত্ত্ব। ১৯৭০-এর দশক থেকে যে তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের পথ দেখিয়ে এসেছে, তা কি এ বার বাতিল করে দিতে হবে?
তত্ত্ব বলছে, মিউওন নিয়ে পরীক্ষার সময় শূন্যস্থান থেকে ভার্চুয়াল পার্টিকল ওঠে। ভার্চুয়াল পার্টিকল মানে যে কণা থেকেও নেই। ওই সব কণা আবির্ভূত হয়েই সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ পরেই শূন্যে মিলিয়ে যায়। শূন্য থেকে উদ্ভব, শূন্যেই মিলায়। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান বলতেন, শূন্যস্থানে জন্ম, শূন্যস্থানেই মৃত্যু, শূন্যস্থানের কোনও কাজ নাই নাকি রে বাবা!
স্ট্যান্ডার্ড মডেল মিউওনের চুম্বকত্ব যতটুকু বলছে, তার অন্যথা হওয়া মানে ভার্চুয়াল পার্টিকলের হিসাবে গোলমাল। বিষয়টা প্রথম ধরা পড়ে ১৯৯৭-এ। ওই বছর নিউ ইয়র্কের বিজ্ঞানীরাও মিউওন কণা নিয়ে পরীক্ষাতেও গোলমাল পেলেন। ২৪ বছর পরেও একই গোলমাল। গলদ স্ট্যান্ডার্ড মডেল তত্ত্বে নয়তো? প্রশ্নটা কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের কুরে কুরে খাচ্ছে। এই সব নিয়ে ২০২১ সালটা এক দিকে ত্রাসে, আর এক দিকে আশায় কেটে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy