Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
tree

রক্ষা করো এই গ্রহের প্রাণ

গত তিন দশকে হিমালয়ের অরণ্যানী ধ্বংস হয়েছে। বস্ত্রহীন পাহাড় ধসে পড়ছে নদীর পর নদীর পথ জুড়ে। তাতে কী! রাস্তা হচ্ছে।

জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২২ ০৪:৪৩
Share: Save:

পুরুলিয়া যাচ্ছিলাম। মুরাডি পার হওয়ার পর থেকে অনেকখানি পথের দু’পাশ এখনও গাছে ভরা। পলাশ, কুসুম, অর্জুন, তেঁতুল, মহুয়া— প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সবুজ। প্রাণ জুড়ানো। একটু দূরের রুদ্র রোদ্দুর এখানে গায়ে লাগে না। গ্রামের রাস্তার মোড়ে এক প্রকাণ্ড বট। অদ্ভুত তার চেহারাটা। নীচের প্রধান গুঁড়িটা খোখলা হয়ে একটা গহ্বর হয়ে আছে। গা ঘেঁষে একটা নতুন ঝুরি এমন ভাবে পাক খেয়েছে, যেন শিশু কোলে এক রোগাসোগা মা সেই গহ্বরে আশ্রয় নিতে চায়। তার পায়ের কাছে অনেক দূর পর্যন্ত নতুন ফেলা মাটির ছোট ছোট স্তূপ। বড় ভয় হয় দেখলে। রাস্তা চওড়া হবে। উন্নয়নের প্রথম ধাপ।

ছোট-বড় গাছ, মাটি ধরে রাখা, ছায়া ফেলে রাখা ঝোপঝাড় ঘাসের যে আস্তরণকে রেচেল কারসন বলেছিলেন ‘পৃথিবীর সবুজ আঁচল’, দ্রুত ছিড়েখুঁড়ে অন্তর্হিত হচ্ছে তা। মাটি পড়ে থাকছে অনাবৃত। ধুয়ে যাচ্ছে কোটি বছরে তিলে তিলে তৈরি হওয়া মৃত্তিকাস্তর। শস্যখেতের পা রাখার জমি। দেশ জুড়ে বদলে যাচ্ছে ভূত্বকের রূপ। সুবিস্তৃত জঙ্গল আর নিচু ঝোপঝাড়ে যে দেশের অধিকাংশ অঞ্চল ঢাকা ছিল, যার প্রাণিকুল মিলেমিশে থাকত সেই পরিবেশ সুরক্ষার আবরণে, মাত্র তিন দশকের মধ্যে ভয়াল রুক্ষতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার চেহারা। অন্য সব প্রাণীর চেয়ে যাকে নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা বেশি, সেই মনুষ্যকুলের অস্তিত্ব সত্যিকারের বিপন্ন হয়ে উঠছে ছায়াবিহনে, অন্য প্রাণিবিহনে। কী অবিশ্বাস্য গতিতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গাছ, বৃক্ষসংসার!

ভারতের যে প্রাচীন ধর্মকে কোনও মতেই ছিন্ন করা যায় না তার প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে, তার প্রধান অংশই প্রকৃতিচর্চা। নদী, অরণ্য, কৃষি বিষয়ের নানা নিয়মকানুন, রীতি-রেওয়াজ। গাছ কাটার নানাবিধ অলঙ্ঘ্য সামাজিক নিয়ম। বনস্পতি ছেদন করা যাবে না, কেননা তারা রক্ষক— গ্রামের, পশুপাখিদের, শিশু ও বৃদ্ধদেরও। নষ্ট করা যাবে না ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত লতাগুল্ম। মানুষ বন থেকে নেবে ততটুকুই, যতটা তার সংসারের কাজে নিতান্ত প্রয়োজন। এই নিয়ম মানা হয়েছে হাজার বছর থেকে পঞ্চাশ বছর আগে পর্যন্ত। বট, অশ্বত্থ, নিম, বেল, মহুয়া, খেজড়ি, সারজোম, দেবদারু— জাতিধর্ম নির্বিশেষে গৃহস্থের কাছে মান্য ছিল পবিত্র গাছ হিসাবে।

ছিল, যত দিন না ঔপনিবেশিক লোকদের কাছে এ দেশের সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠনযোগ্য বলে প্রতিভাত হল। সেই শুরু। বন ছেদনকে আইনি মান্যতা দেওয়ার জন্য তৈরি হল সরকারি বনবিভাগ। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস। গাছকাটার রীতিনীতি, গাছের আর্থিক মূল্য, গাছদের হত্যা করে মৃত গাছের ব্যবসা চালানোর জন্য শিক্ষিত প্রশাসক তৈরি। বছরের পর বছর সেই ধ্যানধারণার বিস্তার। দেহরাদূনে বিখ্যাত ফরেস্ট মিউজ়িয়াম— ভারতীয় অরণ্যে প্রাপ্ত নানা গাছের কাঠ, তার রোগ, সেই কাঠের মূল্য পরিচায়ক ছবির পর ছবি। নিহত গাছের লোভনীয় নগদ মূল্যলাভের সংস্কৃতি।

গত তিন দশকে হিমালয়ের অরণ্যানী ধ্বংস হয়েছে। বস্ত্রহীন পাহাড় ধসে পড়ছে নদীর পর নদীর পথ জুড়ে। তাতে কী! রাস্তা হচ্ছে। গত বছরের স্মৃতিক্ষত শুকোয়নি, তারই মধ্যে স্থানীয় মানুষদের উদ্যত প্রতিরোধের সামনেই উত্তরাঞ্চলে ছ’হাজার দেওদার কেটে ফেলা সাব্যস্ত হল। মধ্যপ্রদেশের সিংগরৌলী থেকে কথা বলছিলেন এক তরুণ— “আমাদের এখানে খুব জঙ্গল ছিল তো, পাহাড় ছিল। বেশি গরম হত না। এখন জঙ্গল নেই, হাইওয়ে করতে পাহাড়ও কেটে নিয়ে গিয়েছে ব্লাস্টিং করে। চার দিকে খোলা খাদান। খুব গরম।” অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীকাকুলামের পাহাড় নেই, জঙ্গলও না। পাহাড়গুলো ভেঙে ‘গিট্টি’ বানানো হয়েছে, শহরে বাড়ি বাড়ছে। গোদাবরীর মোহনা রাজমহেন্দ্র পর্বত হয়েছে রাজামুন্দ্রি শিল্পাঞ্চল। তাপের দহন। পশ্চিমঘাটের জঙ্গল নেই। দিল্লি-চণ্ডীগড় হাইওয়ের নীচে পড়ে আছে অন্তত কুড়ি কিলোমিটার আরাবল্লীর পাথর। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে দু’টি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার সৌজন্যে গাছ আর ঝোপঝাড় মিলিয়ে কাটা পড়েছে তিন লক্ষ। পুরনো মানুষগুলি ‘কর্মসংস্থান’-এর মজুর হয়েছেন। যদিও কাজ চাননি তাঁরা, ঘরে থাকতে চেয়েছিলেন। পুরনো জঙ্গল অঞ্চল আসানসোলে শুধু চার কিলোমিটার রাস্তা চওড়া করতে কাটা পড়েছে ২৫০ বড় গাছ। গাছ নেই, আকাশ থেকে ঝরাপাতার মতো মাঝে মাঝেই ঝরে পড়ে পাখিরা। রোদের ছাই ঝরছে আকাশ থেকে— ঘাস পুড়ছে, মাটি পুড়ছে। রাস্তার পিচ আর কংক্রিট গলে যাচ্ছে। কোনও আড়াল নেই মাঝখানে।

সত্যিই ফুরিয়ে যাবে জঙ্গল? এই দেশের সুঘন বন? কোনও পাখি, ছোট পশু, রাস্তায় থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষ— কাউকে দরকার নেই সভ্যতার? বৃক্ষছায়াবিহীন পৃথিবী সম্ভব? পাড়ার ছোট ছেলেটি বলে, “বড়রা তো কিছুই বোঝে না। আমি শুধু একটা গাছ পুষে রেখেছি— যেন আমি অক্সিজেন পাই। ওকে রোজ জল দিই। অক্সিজেন না হলে কী করে শ্বাস নেব?” কিছু চেষ্টা হয়। পুরুলিয়াতেই শুনি পলিথিন প্যাকেট ব্যবহার বন্ধ করেছে পুরসভা। একই সঙ্গে শুনি, প্রত্যহ দু’হাজার টন পলিথিন আবর্জনা ফেলে দিল্লি, আগুন লাগে সেখানে। বার বার। শিক্ষিত মানুষ ‘পাতা পড়ছে’ বলে গাছ কেটে ফেলতে চান আর বাজার থেকে হাত ভরে নিয়ে আসেন পলিথিন প্যাকেট।

পথের ধারে সেই প্রকাণ্ড বটের পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসি। বলি, তোমরা আশ্রয় দাও। ছেড়ে যেয়ো না মূর্খ মানুষদের। থাকো। তোমরা এ পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ। তোমরা একে বাসযোগ্য করেছ। কিছু লোকের মূঢ়তায় তোমরা হার মেনে নিয়ো না। বাতাস রাখো, বাষ্প রাখো, রাখো বর্ণ, প্রাণবৈচিত্র। যারা চেষ্টা করছে তোমাদের রক্ষা করার, তোমরা তাদের রক্ষা করো। লোভের অপরিণামদর্শী রাক্ষসবুদ্ধিকে প্রতিহত করে রক্ষা করো এই নীলসবুজ গ্রহের প্রাণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tree Save Trees Save Trees Save Earth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE