Advertisement
০৪ ডিসেম্বর ২০২৪
Gender Inequality

বিয়ের পর কেরিয়ারে দাঁড়ি

বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ নারী বিয়ের পর পেশা থেকে সরতে বাধ্য হন। ভারতে বিবাহিত নারীর কর্মনিযুক্তি কমে যায় ১২%।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৫:৫৯
Share: Save:

চাকরিটা ছাড়তেই হল। স্বামী কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে।’ ‘বাচ্চার পড়াশোনাটা দেখতে হবে।’ ‘শ্বশুর-শাশুড়ির অপছন্দ।’ ‘বাচ্চাকে দেখবে কে?’— সবই খেদোক্তি, বিবাহোত্তর জীবনে পেশা থেকে সরতে বাধ্য নারীদের। ‘করওয়া চৌথ’ করা সমাজ ভাবতে পারে না, স্বামী বেঙ্গালুরুর চাকরি ছেড়ে উত্তরপাড়ায় আসবেন, চাকরিতে সমঝোতা করে সন্তানের লেখাপড়ার মূল দায়িত্ব নেবেন; শ্বশুর-শাশুড়ির ‘আবদার’-এর আড়ালে থাকা স্বামীর আদেশ অমান্য করা যাবে; বাড়িতে বাচ্চাকে বাবা দেখবেন, মা যাবেন চাকরিতে।

বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ নারী বিয়ের পর পেশা থেকে সরতে বাধ্য হন। ভারতে বিবাহিত নারীর কর্মনিযুক্তি কমে যায় ১২%। অথচ বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে কর্মজগতে প্রবেশের প্রবণতা বাড়ে ১৩%। প্রতিবেদন এই ‘ট্র্যাজেডি’-কে বিয়ের জরিমানা বলেছে। ভারত ও মলদ্বীপে বিয়ের পর পাঁচ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে বহু নারী পেশায় ফিরতে পারেন না। অনেকে কোনও দিনই পারেন না। রয়েছে ‘সন্তানপালনের জরিমানা’ও। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি তিন বিবাহিতার দু’জনই আর পেশায় টিকে থাকতে পারেন না। এখানে নারীর কর্মনিযুক্তির হার মাত্র ৩২% (পুরুষের ৭৭%)। নারী-পুরুষ সমহারে সুযোগ পেলে দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বাড়ত ১৩% থেকে ৫১%।

স্বাধীনতার পর দারিদ্র কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। নানা উন্নতি হয়েছে। কেবল পেশাজীবনে বিবাহিতা নারীর অবস্থান অন্ধকারেই রয়েছে। স্বামীর সমযোগ্যতাসম্পন্ন নারীর ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যান আশাপ্রদ নয়। পুরুষতন্ত্রের শিকড় রাজনীতি, সমাজ, পরিবারের এত গভীরে যে শ্রমজীবনেও নারীকে তা স্বাধীন ভাবে বাঁচতে ‘অনুমতি’ দেয় না। পুরুষতন্ত্র কিন্তু ধর্ম-বর্ণ-জাতির নিরিখে ‘সাম্যবাদী’— নারীকে ‘প্রজনন শ্রমিক’ বানানো এবং তাঁর শ্রমশক্তি, শ্রম-সময়ের উপর পূর্ণ আধিপত্যই তার লক্ষ্য। গৃহকর্মকে উৎপাদনমূলক কাজের স্বীকৃতিতেও আপত্তি। তাতে যদি সেই শ্রম অর্থমূল্য দাবি করে। ফলে শ্রমক্ষেত্রে নারীর আয় পুরুষের আয়ের প্রায় অর্ধেক।

গৃহকর্মে নারী-পুরুষে অসাম্য, পরিবার ও সমাজের চাপানো প্রতিবন্ধকতা, যৌন নিগ্রহ, প্রশিক্ষক এবং উৎসাহদাতার অভাব: অনেক কিছুই সন্তানধারণের আগেই নারীকে কর্মক্ষেত্রের বাইরে ঠেলে দেয়। সন্তান ‘মানুষ’ করার মূল দায় এই ‘বহিষ্কার’কে ‘বিধিসম্মত’ করে। না হলে সন্তান দেখাশোনার ছুটির পাল্লা মহিলাদের দিকে এতখানি ঝুঁকে কেন যে, পুরুষের দিকটা হাওয়ায় ভাসছে মনে হয়? এত বাধা ঠেলে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া সুনিশ্চিত হলে আসে যানবাহন সমস্যা, কর্মস্থলে ক্রেশের অভাব, সেখানেও নিরাপত্তার অভাব, নিগ্রহের আশঙ্কা। অথচ আইনকানুন যথেষ্ট। অভিযোগ জানানোর কমিটি তৈরির কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এত আড়ম্বরে সুস্থ, স্বাভাবিক কর্মপরিবেশের দাবিই চাপা পড়ছে। হয়তো তাই ২০২২-এর প্রতিবেদন দেখিয়েছে দেশে শ্রম-আয়ের ৮২%-ই পুরুষদের। মহিলাদের ভাগ মাত্র ১৮%।

বহু কর্মক্ষেত্রই অতিরিক্ত আত্মনিবেদন, সময় চায়। ‘সংসার’-এর প্রতাপে বিবাহিত নারী ওই অতিরিক্তটুকু দিতে পারেন না অনেক সময়। ফলে, প্রতিযোগিতার বাজারে টেকাই মুশকিল। বিবাহিতার পেশাজীবন বজায় প্রসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্ব ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ফ্রানজ়িস্কা ওনসার্গে-র মত, বিভিন্ন প্রচেষ্টায় সরকার, বেসরকারি ক্ষেত্র, পরিবার সকলকেই ভূমিকা নিতে হবে। আইন সংস্কার, লিঙ্গ অসাম্য দূরীকরণে লড়তে হবে। কর্মসৃষ্টি করতে হবে, পরিবার ও সমাজের বাধা বিমোচনে জোর দিতে হবে, শিশু ও বৃদ্ধের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে। ২০২২-২৩’এর হিসাবে দেশে মহিলাদের (পনেরো বছর ও ঊর্ধ্বে) কর্মনিযুক্তি মাত্র ৩৭%-এর আশপাশে!

লিঙ্গ অসাম্য এমন তীব্র যে নারীর পেশাকে অনেকেই এলেবেলে ধরে নেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারীশ্রমিকের অবস্থা করুণতর। বাইরে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ঘরেও বিশ্রাম নেই। কারণ তাঁর পেশার দামই নেই। আসল দায়িত্ব সংসার প্রতিপালন। কষ্টের রোজগারও প্রায়শই নিজের আয়ত্তে থাকে না। এই সামাজিক পরিমণ্ডলে নারীর কর্মনিযুক্তিতে দরকারি উল্লিখিত সুপারিশগুলির বাস্তবায়নেরও আগে এই দর্শনটি বদলানো দরকার যে নারীর পেশাগত জীবন কেবল বিলাসিতা, অতিরিক্ত আয়ের সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র। সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি নারীর স্বাধিকারের জন্যই এই সব মূর্খামি মুছে ফেলে তাঁর পেশাজীবনের স্বীকৃতি চাই। এই গণসচেতনতা তৈরির জন্য এক দিনও অপেক্ষা করা চলে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Gender Inequality Married Women Patriarchal Society Jobs
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy