শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস-কেন্দ্রিক গল্প-উপন্যাস বাঙালি পাঠক এখনও গোগ্রাসে পড়েন— তাঁর সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ সাম্প্রতিক কালে চলচ্চিত্র ও অন্যান্য দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের আনুকূল্য যত পেয়েছে, ঐতিহাসিক কাহিনিগুলি তেমন করে অন্য মাধ্যমের আনুকূল্য পায়নি। তাতে অবশ্য তাঁর ঐতিহাসিক লেখাপত্রের কদর কমেনি। ঐতিহাসিক কাহিনিগুলি দুই মলাটের স্থূল অবয়বে অনেক দিন হল ধরা পড়েছে। তবে সেই মোটাসোটা বইয়ের পাতায় আমরা শরদিন্দুর ইতিহাসের লেখাগুলি যে ভাবে রুদ্ধশ্বাসে পড়ি, সেগুলি নিয়ে সে ভাবে তেমন করে ভাবি না। ইতিহাস সমগ্রের অবয়বের তলায় হারিয়ে গিয়েছে শরদিন্দুর ইতিহাসের সত্যান্বেষণের নানা পর্যায়, পায়ে চলার নানা পথ। প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুত্বের বা প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামের সুনিশ্চিত সমৃদ্ধ বৃহদায়তনের তলায় যেমন হারিয়ে যায় অনেক কিছু, এও খানিক সে রকমই। এ সময়ের প্রয়োজনেই মোটা দাগের ইতিহাসের অন্তরাল থেকে খুঁজেপেতে নেওয়া উচিত নানা দাগের বিচিত্র পথনির্দেশিকা।
তাঁর ইতিহাসের গল্পগুলি পরাধীন ভারতবর্ষে যখন গ্রন্থাকারে আত্মপ্রকাশ করছিল, সে এক ‘আলো নেই’ সময়। গত শতকের তৃতীয় দশক— দুই পক্ষের সঙ্কীর্ণ কট্টরপন্থীরা হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সংঘর্ষ উস্কে তুলতে চাইছিলেন। ইংরেজ উপনিবেশের প্রভুরা শাসনের ভেদনীতির মাধ্যমে দুই পক্ষকে লড়িয়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ পূর্ণ করতেই তো উৎসাহী। তাঁরা ভাবিয়ে তোলেন, এই দুই পক্ষের যুযুধানতাই যেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের চলে আসা ‘চিরকালীন’ সত্য। মুসলমান যুগ পুরনো হিন্দু যুগের কণ্ঠ রোধ করে দিল। শরদিন্দুর প্রথম গল্পের বই জাতিস্মর সেই হিন্দু-মুসলমান যুযুধানতার একমাত্রিক চালচিত্রটিকে গত শতকের তৃতীয় দশকে ভাঙতে চাইছিল। এই বইয়ের প্রথম গল্প ‘অমিতাভ’। ছিয়াত্তর টাকা মাইনের রেলের কেরানি জাতিস্মর— স্মৃতিলোকে ফিরে যাচ্ছেন অতীতে অজাতশত্রুর জগতে। হিন্দু অজাতশত্রু ‘প্রফুল্ল মনে যুদ্ধ করতে’ ভালবাসেন। অজাতশত্রুর মহামন্ত্রী জাতিস্মর কেরানিটিকে সুদূর অতীতে বলেছিলেন, “বৌদ্ধদিগকে কদাচ বিশ্বাস করিবে না, ইহারা মগধের ঘোর শত্রু। দুর্গসন্নিধানে যদি ইহাদের দেখিতে পাও, নির্দয়ভাবে হত্যা করিও।”
নির্দয়তা কি কেবল বৌদ্ধদের সইতে হয়েছিল? কালিকট বন্দরের ঘটনাসূত্রে একই নির্দয়তা সইতে হয় মুসলমান ব্যবসায়ীদেরও। তাঁদের নির্দয় ভাবে হত্যা করেছিল ফিরিঙ্গি বণিক ভাস্কো-ডা-গামা। শরদিন্দুর চুয়াচন্দন গল্পের বইতে ‘রক্ত-সন্ধ্যা’ গল্পে ব্যবসা-বাণিজ্য হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলনের উপায়, ব্যবসা ‘যুক্ত-সাধনা’ হয়ে উঠেছিল। শরতের মেঘমার্জিত আকাশে শুভ্র পাল উড়িয়ে বঙ্গদেশের প্রভাকর শ্রেষ্ঠীর নৌকা এসে লাগল কালিকটে। প্রভাকরের সঙ্গে মির্জা দাউদের গভীর বাণিজ্যিক সখ্য। খোদার দয়ায় দাউদের মেয়ে হয়েছে শুনে প্রভাকর বলেন, “তাহা হইলে আজ রাত্রে আপনার দৌলতখানায় আমার নিমন্ত্রণ রহিল। দেশে কুক্কুটাদি ভোজনের সুবিধা হয় না— দুষ্প্রাপ্যও বটে, আর ব্রাহ্মণগুলা বড়ই গণ্ডগোল করে।” এই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এসে দাঁড়ায় ভাস্কো-ডা-গামা। কালিকটে সে দিন না পারলেও ভাস্কো-ডা-গামা চার বছর পরে তীর্থ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী মির্জার জাহাজ ভারত মহাসাগরে ডুবিয়ে দিলেন, নিরপরাধ তীর্থযাত্রীদের প্রাণ গেল। শরদিন্দু গ্রন্থসূচনায় লিখেছেন, “ভাস্কো-ডা-গামার চরিত্র সম্পূর্ণ ইতিহাসসম্মত, কোথাও রং চড়াইবার চেষ্টা করি নাই।”
শরদিন্দু ভাস্কো-ডা-গামা চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে হাত পেতেছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র কাছে। তখন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র প্রয়াণ হয়েছে। ঐতিহাসিক চিত্র সাময়িকপত্রের সম্পাদক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বাঙালির ইতিহাস-সাধনার অন্যতম ব্যক্তিত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বঙ্গদেশের ও ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার জন্য যে উদ্যোগ করা হয়েছিল তাতে কেবল বাঙালি হিন্দুরাই অংশগ্রহণ করেননি, আরবি-ফারসি জানা সহযোগী মুসলমান চিন্তকরা সতথ্য সহায়তা করেছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ইতিহাস-রচনার সময় যতটা সম্ভব বিবিধ সূত্র ব্যবহার করতেন। মুসলমান ও ইংরেজ লেখকদের পাশাপাশি প্রয়োজনে পর্তুগিজ়, ফরাসি, ওলন্দাজদের সাক্ষ্য গ্রহণে উৎসাহী। নিখিলনাথ রায় মুর্শিদাবাদের ইতিহাস লেখার সময় ফজলরব্বী খাঁ বাহাদুর ও মির্জা সুজাত আলি খাঁ বাহাদুরের সাহায্য নিয়েছিলেন। ফজলরব্বী তাঁকে নিজ়ামত পুস্তকাগারের ও ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই, হস্তলিখিত কেতাব দিয়েছিলেন।
শরদিন্দু তাঁর গল্প লেখার সময় যে ফিরিঙ্গি-বণিক বইটির সাহায্য নিয়েছিলেন সে বইটিতে অক্ষয়কুমার লিখেছিলেন, “প্রতীচ্য লেখকবর্গ যে ভাবে এই ইস্লাম-বিপ্লব লিপিবদ্ধ করিতেন, তাহাতে পাঠকচিত্ত ইস্লামের নামে ঘৃণা, ঈর্ষা ও অসঙ্গত ইস্লাম বিভীষিকায় পূর্ণ হইয়া উঠিত।” অক্ষয়কুমারের ভাষায় যা ‘অসঙ্গত ইস্লাম বিভীষিকা’, এ কালের চলিত কৃতঋণ বাংলায় তা ‘ইসলামোফোবিয়া’। ইতিহাসের তথ্য কী? অক্ষয়কুমার লিখেছিলেন, “ইস্লাম সত্যসত্যই কৃপাণস্কন্ধে বহু দেশের বহু সমরক্ষেত্র নর-শোণিতে অনুরঞ্জিত করেছিল... কিন্তু তাহাই পৃথিবীর সকল জাতির প্রথম অভ্যুদয়কালের সাধারণ কাহিনী।” প্রথম অভ্যুদয়কালের সাধারণ কাহিনি যে রণরক্তের সফলতায় ভরা থাকে, সে প্রসঙ্গে মনে পড়বে পুরন্দর ইন্দ্রের পুরীনাশের কাহিনি। অক্ষয়কুমার খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন ইসলামের অন্য রূপ, এই ইসলামই পরে জ্ঞানবিস্তারে ইউরোপের ‘নবজীবন দান’-এর কারণ। ইসলাম-পূর্ব ভারতবর্ষেও পুরন্দরদের সঙ্গে স্থানীয়দের পরবর্তী কালে সহযোগী সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। শরদিন্দু অক্ষয়কুমারের তথ্যসূত্র থেকে যখন ‘রক্ত-সন্ধ্যা’ লিখছেন তখন এ কথাগুলি মনে রাখছেন। ‘অমিতাভ’ গল্পে বুদ্ধদেবের শান্তির বাণীমন্ত্র শ্রবণ করা মানুষটি জন্মান্তরে কলকাতায় রেলের কেরানি আর ‘রক্ত-সন্ধ্যা’ গল্পে কালিকটের ব্যবসায়ী ধর্মপ্রাণ মানুষটি জন্মান্তরে দরিদ্র মুসলমান কসাই। ইতিহাসের কী পরিহাস! প্রতীচ্যের ঔপনিবেশিকতা কোথা থেকে কোথায় এনে ফেলেছে হিন্দু-মুসলমান উত্তরসূরিদের!
শরদিন্দু তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস যখন লিখতে শুরু করলেন পুরোদমে, তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভাঙা স্বাধীন দেশ, ধর্মের নামে দ্বি-বিভক্ত। ন্যাশনালিস্ট মুসলমানরা সংবিধানস্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী। এই ভারতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি প্রমুখের জ্ঞানভান্ডারের সহায়তায় শরদিন্দু ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করতে বসলেন নতুন করে। হিন্দু-বাঙালির আত্মপরিচয়টিকে তিনি মমতার সঙ্গেই লালন করেন কিন্তু সেই আত্মপরিচয়ের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কখনও বিভেদকে বড় করে তোলেন না। আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভেদনীতিকে স্বীকার করা, এই দুইয়ের মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য তা রক্ষার গুরুদায়িত্ব তিনি পালন করেন। দেশভাগ ও দাঙ্গার বাস্তবতালগ্ন হতাশ বাঙালিকে সেই গরিমার কথা মনে করিয়ে দেন তিনি, যে গরিমা বাঙালির বাহুবল ও বুদ্ধিবলের কথা বলে, কিন্তু ভেদবুদ্ধির দ্বারস্থ হয় না।
নিজের ছোট-ছোট লেখায় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে শরদিন্দু তাঁর মনের কথা জানাচ্ছেন। ‘ঘটনার ইতিহাস নয়, ধাতু-প্রকৃতির ইতিহাস’ তাঁর বিবেচ্য। সেই ধাতু-প্রকৃতি ভারতীয়দের এক রকম স্থিতিশীলতা দেয় বলেই তাঁর বিশ্বাস। সেই স্থিতিশীলতা ‘ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ’ চারটিকে নিয়েই। সেই স্থিতিশীলতা তাঁর মতে, ইতিহাসের আত্মনিষ্ঠা থেকে আসে। ইতিহাসের আত্মনিষ্ঠা কী? শরদিন্দুর মতে, “যাহারা মানুষে মানুষে ভেদবুদ্ধি চিরস্থায়ী করতে চাহে তাহারা ইতিহাসের অমোঘ ধর্ম লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করে...।” সেই অমোঘ ধর্মই ইতিহাসের আত্মনিষ্ঠা, এই সত্যে বিশ্বাস যে এক দিন না এক দিন ভেদবুদ্ধির অবসান হবে। এমনি এমনি হবে না, তার জন্য সক্রিয় হওয়া চাই। অজাতশত্রুর রাজ্যে পুরী নির্মাণকারীদের প্রধানকে অমিতাভ বুদ্ধ ভেদবুদ্ধিহীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। আর ‘কালের মন্দিরা’ হুন যোদ্ধা মোঙ? স্বাধীন ভাঙা ভারতে স্বাধীনতার বছর চারেক পরে লেখা এ উপন্যাসে শরদিন্দু গল্প বলা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য যদি ব্যক্ত করতে চান সে হল তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “হেথায় আর্য হেথা অনার্য/ হেথায় দ্রাবিড়, চীন—/ শক-হুন-দল পাঠান মোগল/ এক দেহে হল লীন।” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় ইসলামের নিজস্ব রূপের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, তাঁর লেখায় তুর্কিয়ানা থেকে সুফিয়ানায় উত্তরণের কথা আছে। শরদিন্দুর ‘কালের মন্দিরা’-য় মোঙ সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
এই ভাবনার মধ্যে উনিশ শতকীয় বঙ্কিমী-ভাবনা মিশে ছিল, বঙ্কিমকে মনে রেখেও রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকে ভারতের ইতিহাসবোধের মধ্যে যে সম্প্রসারিত ঐক্যবোধের অনুসন্ধান করছিলেন তাও শরদিন্দুর অজানা ছিল না। তবু মনে হয়, এখনকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দূর করার জন্য এই যে ‘চিরায়ত’ ‘ভাবগত’ বিশ্বাস কতটা কার্যকর? উত্তর দেওয়া কঠিন। শরদিন্দু কিন্তু ভেদবুদ্ধির অবসানকে কেবল ভাবসত্য বলে বিচার করতেন না, কর্মসত্য বলে জানতেন। বাণিজ্যসূত্রেই প্রভাকর ও মির্জা দাউদ সখা, যুক্ত-সাধনাতেই নিরাময়। পাশাপাশি গৌড়মল্লার শেষ হয়েছিল এক অমোঘ জিজ্ঞাসায়, “হে চির-সারথি, যে-পথে তোমার রথ লইয়া চলিয়াছ কোথাও কি তাহার শেষ আছে?” যাত্রার শেষ নেই, তাই উত্তরের রূপকথায় পৌঁছনো অসম্ভব।
ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে প্রায়োগিক দিক থেকে যুক্তসাধনার স্থিতিশীল লাভের কথা যুযুধান মানুষকে বার বার মনে করিয়ে দেওয়া চাই।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)