বন্দে মাতরম্ গানের ১৫০ বছর উদ্যাপনের লক্ষ্যে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার সে রাজ্যের সমস্ত বিদ্যালয়ে গানটি বাধ্যতামূলক রূপে গাওয়ার ফরমান জারি করে। এ দিকে আলিগড় জেলার জনৈক শিক্ষক সামসুল হাসান বন্দে মাতরম্ গাইতে অস্বীকার করেন এবং বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁর মূল বক্তব্য, এই গান তাঁর ধর্মীয় ভাবনার বিরোধী।
ঘটনাটি জানাজানি হতেই সে রাজ্যের শিক্ষা দফতর উক্ত শিক্ষককে সাসপেন্ড করেছে। অন্য দিকে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতার বিভিন্ন ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করা হয়েছে। অন্য একটি ঘটনায় আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইবার জন্য অসমের জনৈক প্রবীণ কংগ্রেস নেতার বিরুদ্ধে সেখানকার প্রশাসনের তরফে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
প্রশ্ন হল, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় গান গাইতে দেশবাসীকে বাধ্য করা যায় কি না! ভারতীয় সংবিধানের ৫১এ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাবে বলা রয়েছে যে, প্রত্যেক ভারতবাসীর কর্তব্য হল, সংবিধান মেনে চলা ও জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। তবে কোনও ব্যক্তি জাতীয় সঙ্গীত চলার সময় উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেও কণ্ঠ মেলাতে অস্বীকার করলে তাঁকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে— এমন কথা ভারতীয় সংবিধান অথবা ‘প্রিভেনশন অব ইনসাল্টস টু ন্যাশনাল অনার অ্যাক্ট’— কোথাও বলা নেই। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে ‘বিজো ইমানুয়েল বনাম কেরল রাজ্য’ মামলাটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়। কেরলের এক বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত জিহোবা মতাবলম্বী তিন ছাত্র বিজো, বিনু মোল ও বিন্দু ইমানুয়েল বিদ্যালয়ের প্রভাতী অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করায় বিদ্যালয় থেকে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছিল। এই সময় কেরল সরকারের জারি করা দু’টি সার্কুলার অনুযায়ী, বিদ্যালয়ের প্রভাতী অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে ইমানুয়েল পরিবার ন্যায়বিচার চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়, যা অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ছাত্রদের বক্তব্য ছিল, এই গান গাইলে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা হবে। ১৯৮৬ সালের অগস্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও চিন্নাপ্পা রেড্ডি এবং এম এম দত্তের বেঞ্চ সংবিধানের ৫১এ ধারা বিবেচনা করে রায় দেয়, এই ছাত্রদের বরখাস্ত করার অর্থ তাদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা। এ ক্ষেত্রে বিচারপতিদের বক্তব্য ছিল, “আমাদের পরম্পরা সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়, আমাদের দর্শন সহিষ্ণুতার উপদেশ দেয় এবং আমাদের সংবিধান সহিষ্ণুতা অনুশীলন করে। একে লঘু করা উচিত নয়।” এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বন্দে মাতরম্ গানটি গাইতে অস্বীকার করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের জারি করা ফতোয়া-সহ বিভিন্ন ধারায় রুজু করা মামলা আদৌ কতখানি টিকবে, গভীর সংশয় রয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নটি জরুরি— ভারতের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান ও গণতন্ত্র কি এতই ঠুনকো যে, কোনও ব্যক্তি জাতীয় সঙ্গীত বা গানের সঙ্গে কণ্ঠ না মেলালেই তা বিপন্ন হয়ে পড়বে? এক দিকে রাষ্ট্র বা দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত তথা সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন সব নাগরিকের কর্তব্য। অপর দিকে, স্বাধীন ভাবে চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার তথা স্বাধীন ভাবে ধর্মাচরণের অধিকারও সংবিধানের ১৯ ও ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকাররূপে স্বীকৃত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে সংঘাত উপস্থিত হলে নাগরিক কোন সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পেতে পারেন, বিজো ইমানুয়েল মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তা স্পষ্ট করে দিয়েছে।
গণতন্ত্রে এ প্রশ্ন তোলাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় গলা মেলানো বা উঠে দাঁড়ানোর মতো রাষ্ট্র নির্ধারিত প্রতীকী আচরণগুলিকে মেনে চললেই কি কোনও ব্যক্তিকে দেশপ্রেমিক আখ্যা দেওয়া যেতে পারে? দৈনন্দিন জীবনে চরম দুর্নীতিপরায়ণ বা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তি যদি প্রতি দিন সকাল-সন্ধ্যায় জাতীয় পতাকার পদতলে মাথা ঠুকে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে নিজের সততা জাহির করে, তবে কি তার অপরাধমূলক আচরণকে লঘু করে দেখা হবে? অন্তরে গভীর দেশপ্রেমী, ন্যায় ও মূল্যবোধসম্পন্ন কোনও নাগরিক যদি শুধুমাত্র জাতীয় সঙ্গীতে গলা না মেলানোর ‘অপরাধ’টুকু করে বসেন, তবে তাঁর উপর নেমে আসবে রাষ্ট্রের প্রতিহিংসার খাঁড়া? হয়তো বিভিন্ন অপরাধমূলক ধারার পাশাপাশি ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৫২ নম্বর ধারাতেও (দেশদ্রোহিতা আইনের নয়া রূপ) তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। উল্টো দিকে, জল-জঙ্গল-জমি-বন্দর-পাহাড়-খনিজ সম্পদ লুটের কারবারিরা মেকি জাতীয়তাবাদের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে প্রশাসনের চোখের সামনে সদর্পে ঘুরে বেড়াবে।
স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও দেশবাসীকে কর্তব্যবোধের পাঠ মুখস্থ করানোর জন্য যে ভাবে সরকারকে বলপ্রয়োগ করতে হচ্ছে, তা যথেষ্ট লজ্জার বিষয়। আইন বা বলপ্রয়োগ করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করা আসলে জাতির দৈন্যকেই প্রকট করে তোলে। শুধুমাত্র অধিকারের দাবি নয়, বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ভারতে জনগণের সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির উপর ভরসা রাখা ছাড়াও গত্যন্তর নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)