আজকের পোস্ট-ট্রুথ বা সত্য-উত্তর যুগে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, তার সর্বজনগ্রাহ্য কোনও মাপকাঠিই সম্ভবত আর অবশিষ্ট নেই। সমাজমাধ্যমের প্রসার, তথ্যের অনিয়ন্ত্রিত এবং ব্যাপক আদানপ্রদান, এবং গোটা পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান— পুরনো সমস্ত হিসাব পাল্টে দিয়েছে। তার চেহারা ঠিক কী রকম, নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই— দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুন, ভুয়ো তথ্য এবং মিথ্যা আপনার কাছে পৌঁছবেই। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, বেছে নেওয়া প্রতি দিন কঠিনতর হয়ে উঠছে।
অনেকে মনে করছেন যে, এই প্রক্রিয়াটি বাজারে পণ্য কেনা-বেচার মতোই— পণ্যের পরিবর্তে এখানে রয়েছে তথ্যের বাজার। বাজারে অনেক তথ্য রয়েছে। আপনি হয়তো সব সময় সঠিক তথ্য চিনতে পারছেন না। কিন্তু যে-হেতু তথ্য সরবরাহকারীর সংখ্যাও বাজারে অনেক, অতএব বহু মানুষ যদি বুঝতে পারেন যে, কোনও এক তথ্যের জোগানদার তাঁদের ভুল তথ্য সরবরাহ করছে, তা হলে তাঁরা সেই জোগানদারকে পরিত্যাগ করে সঠিক তথ্যের কারবারির কাছে চলে যাবেন। ‘বাজারের অদৃশ্য হাত’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুয়ো তথ্য সরিয়ে শুধুমাত্র সঠিক তথ্যই রাখবে।
ধারণাটি শুনতে ভাল, কিন্তু নিতান্তই ভুল। প্রথমত, ভোক্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের পছন্দমতো তথ্যই দেখতে চান এবং বিশ্বাস করতে চান। আচরণবাদী অর্থনীতির ভাষায় একে বলে ‘কনফার্মেশন বায়াস’। নিজের ধারণার সঙ্গে মিলছে না, এমন তথ্যকে যাচাই করতে যে সময় বা বুদ্ধি ব্যয় করতে হয়, তা অনেক মানুষই করতে চান না। ফলত, মানুষ যা পছন্দ করেন সেই তথ্যই দেখতে চান। সমাজমাধ্যমের অ্যালগরিদমের কাজ ঠিক এটাই, ভোক্তাদের পছন্দের তথ্য বা দৃশ্য দেখানো। এর ফলে আসলে সবাই একটি বুদ্বুদের মধ্যে বাস করেন, যেখানে মুঠোফোন আদতে মানুষ যা দেখতে চান তা-ই দেখায়। তাকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেন বহু মানুষ। কোনটা আসল সত্য, তা যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টাও করেন না।
তার চেয়েও বড় কথা, তথ্যের সরবরাহকারী তথ্যের উপভোক্তার তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাবান। পুঁজি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মেলবন্ধনে তৈরি কাঠামোর মধ্যে তথ্য যাঁরা সরবরাহ করছেন, তাঁরা তা পরিবেশন করছেন এমন ভাবে, যেন তাঁদের তথ্যই ধ্রুব সত্য। কিন্তু আসলে তা পরিবেশিত হচ্ছে ক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। দুনিয়া জুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান হয়েছে। এই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে মিশেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং পৃথিবীর বৃহৎ পুঁজিপতিদের সীমাহীন ঐশ্বর্য। এই দুইয়ের মিশ্রণে যে আখ্যান তৈরি হচ্ছে, তা সংবাদমাধ্যম মারফত পৌঁছচ্ছে আমাদের টিভির পর্দায়, মোবাইল ফোনে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বরাবরই নিজের অনুকূলে আখ্যান নির্মাণের চেষ্টা করে এসেছে— সংবাদমাধ্যম বা বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে। কিন্তু সমাজমাধ্যম আসার পরে ক্ষমতার এই আখ্যানকে সত্যি বলে ধরে নিয়ে তার অভিঘাত বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে সমাজমাধ্যমের অগুনতি উপভোক্তা, তাঁদের শেয়ার ও লাইকের মাধ্যমে। এর জন্য বেতন দিয়ে লোক রাখা হচ্ছে, যাঁদের কাজ সমাজমাধ্যমে কোনও একটি ‘তথ্য’কে বহু গুণ প্রচার করা। বৃহৎ পুঁজি ও ক্ষমতা নিজের মতো করে আখ্যান নির্মাণ করে চলেছে, যার মূল উদ্দেশ্য প্রচারমূলক, যাতে মানুষ তাদের প্রচারিত মতাদর্শ বা নীতির প্রতিই আকৃষ্ট থাকেন, বিকল্প কোনও মত যেন তাঁদের কাছে না পৌঁছয়।
এমনটা ভাবলে অবশ্য ভুল হবে যে, কিছু অসাধু ব্যক্তি সংবাদমাধ্যমে কাজ করে, যারা শুধুমাত্র মিথ্যা ছড়ায়। আসলে রাষ্ট্র ও পুঁজি নিজেদের পছন্দমতো ‘সত্য’ তৈরি করার চেষ্টা করছে, বা সত্যের পরিভাষা বদলে দিচ্ছে, ক্ষমতার জোরে। ক্ষমতা যাকে সত্য বলে মানছে, তাকেই সত্যের মান্যতা দেওয়া হয়, মূলধারার মাধ্যমে। ক্ষমতার জোর আছে, তাই প্যালেস্টাইনের উপরে ইজ়রায়েলের ভয়ঙ্কর আক্রমণও হয়ে ওঠে নিতান্ত আত্মরক্ষার চেষ্টা, আর প্যালেস্টাইনিদের আত্মরক্ষার অধিকার অস্বীকৃত হয়। আমেরিকার ইরাক আক্রমণ পরিচিত হয় ‘গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য যুদ্ধ’ হিসাবে, আর রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করলে তাকে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। দু’টি যুদ্ধই অন্যায়। কিন্তু ক্ষমতার ভাষ্যে একটি মহৎ কোনও স্বার্থের জন্য নিবেদিত হওয়ার মর্যাদা পায়, আর অন্যটি নিছক পশ্চিম সভ্যতার বিরুদ্ধে করা আগ্রাসী পদক্ষেপ।
এই ভাষ্য নির্মাণের একটি কদর্য উদাহরণ সম্প্রতি দেখা গেল হোয়াইট হাউসে। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নৈশভোজে বসে, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পকে মনোনীত করে যে চিঠি পাঠিয়েছেন নোবেল কমিটির কাছে, তারই একটি প্রতিলিপি ট্রাম্পের হাতে তুলে দিলেন। যাঁর নেতৃত্বে বিগত ২০ মাস ধরে প্যালেস্টাইনের মানুষের উপরে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ আনুমানিক ৭০,০০০ মানুষের প্রাণ নিয়েছে, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ মহিলা ও শিশু; যাঁর নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী ত্রাণশিবিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুধার তাড়নায় ক্লিষ্ট মানুষের উপরে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে; যাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশে গাজ়ার সমস্ত হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় ধূলিসাৎ, তিনি মনোনয়ন দিচ্ছেন নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য! নেতানিয়াহু নেতৃত্বাধীন সরকার গাজ়ার মানুষের উপর অমানবিক যুদ্ধ অপরাধ সংগঠিত করছে এই অভিযোগ করেছেন ইজ়রায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইয়েহুদ ওলমার্ট। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।
এই নৈশভোজের আসরেই নেতানিয়াহু বলেন, যে সব দেশ প্যালেস্টাইনের পক্ষে অনেক কথা বলে, তাদের উচিত গাজ়ার মানুষদের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ দেওয়া, অর্থাৎ নিজেদের দেশে নিয়ে নেওয়া। বলেন যে, গাজ়ার মানুষ যদি অন্য দেশে চলে যেতে চায়, তা হলে তারা যেতে পারে। যেন গাজ়ার ভূখণ্ডের মালিক তিনি! ইতিমধ্যেই ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন গাজ়া খালি করে মানুষকে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা তৈরি করতে। ইজ়রায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নামে আসলে গাজ়ার ভূখণ্ড দখল করে সেখান থেকে প্যালেস্টাইনিদের উৎখাত করে অঞ্চলটির দখল নিতে চায়।
বৃহত্তর ইজ়রায়েল গড়া নেতানিয়াহুর বহু বছরের স্বপ্ন, যেখানে প্যালেস্টাইনিদের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না এবং প্যালেস্টাইনের সম্পূর্ণ অঞ্চলে একচ্ছত্র অধিকারী হবে ইজ়রায়েল। এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনটি চলছে নিতান্তই খুল্লমখুল্লা— কারণ, পশ্চিমি দুনিয়ায়, বিশেষত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সত্য নির্মাণের প্রক্রিয়ার উপরে ইজ়রায়েলের দখল ও নিয়ন্ত্রণ সুগভীর। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলি ইজ়রায়েলের এই হত্যালীলায়, দখলদারি বাসনায় পূর্ণ সহযোগিতা দিচ্ছে। ট্রাম্পের জন্য নোবেল-সুপারিশকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা জরুরি।
ট্রাম্প হঠাৎ বৈশ্বিক শান্তি-দূত হতে চাইছেন। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছেন, ইজ়রায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছেন, ইজ়রায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করার চেষ্টা করছেন ইত্যাদি। কিন্তু যথারীতি ক্ষমতার ভাষ্যে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে ট্রাম্পের বোমাবর্ষণকেও শান্তিকামী পদক্ষেপ হিসাবেই দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমাবর্ষণের ঘটনা প্রায় নজিরবিহীন— যদি সত্যিই কেন্দ্রটি ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তার বিকিরণে মানুষের প্রবল ক্ষতি হবে। কিন্তু তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিশেষ কোনও আলোচনা চোখে পড়ছে না। যিনি নিজের দেশের সংখ্যালঘু ও কালো মানুষদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত; মানুষের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী তকমা লাগিয়ে অন্য দেশে জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন; টিকার বিরুদ্ধে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ধারণার বিরুদ্ধে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন; যিনি অন্য দেশে বোমাবর্ষণ করেছেন, তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করছেন গুরুতর যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত আর এক ব্যক্তি! এই অলীক কুনাট্যের সাক্ষী থাকছে গোটা দুুনিয়া।
সত্য নির্মাণের অধিকারটি কুক্ষিগত করতে পারলে ঠিক কত দূর যাওয়া সম্ভব, এর পরেও কি সে কথা বুঝতে বাকি থাকে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)