E-Paper

সঙ্গীহীনতার সঙ্কট

২০১৬ সালের উরি এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামা কাণ্ডের পর (দু’টিই মোদী জমানার) যে প্রশ্নাতীত সমর্থন ও সমানুভূতি ভারত পেয়েছিল, তা অপারেশন সিঁদুরের পরবর্তী পর্যায়ে কোথায়?

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫ ০৬:১৭
ফলহীন: শশী তারুরের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের বৈঠক আমেরিকান সেনেটের সদস্যদের সঙ্গে। ৪ জুন, ওয়াশিংটন ডিসি।

ফলহীন: শশী তারুরের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের বৈঠক আমেরিকান সেনেটের সদস্যদের সঙ্গে। ৪ জুন, ওয়াশিংটন ডিসি। ছবি: পিটিআই।

ইতিহাস বলে, দূত অবধ্য। শেক্সপিয়রের ক্লিয়োপেট্রা অবশ্য দূতকে গালমন্দ করতে বাকি রাখেননি কিছু, তাঁর বার্তা শুনে। বার্তাটি ছিল, রোমান জেনারেল মার্ক অ্যান্টনি অন্যের সঙ্গে পরিণয়বদ্ধ। গালি খেয়ে পালানোর আগে বেচারা দূত এটুকুই বলতে পেরেছিলেন, তিনি খবরটি এনেছেন মাত্র, অ্যান্টনির বিবাহে ঘটকালি করেননি! খবরটি অন্য ভাবে পরিবেশন করলে ফলাফল অন্য হত কি না, তা অবশ্য শেক্সপিয়র সাহেব স্পষ্ট করেননি।

অপারেশন সিঁদুরের পর বিশ্ব জুড়ে ভারতের কূটনৈতিক (এবং রাজনৈতিক) বার্তাবাহকরা রানারের মতো সবেগে হরিণের মতো দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটলেন এবং সমালোচিতও হলেন। কানাডায় জি৭ শীর্ষ সম্মেলনের পর এবং ব্রাজ়িলে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের আগে এ কথা আর অস্পষ্ট নয় যে, অপারেশন সিঁদুরের পর প্রত্যাশিত রাষ্ট্রসমর্থন আদায় করতে তো পারেইনি সাউথ ব্লক, বরং একঘরে, বিচ্ছিন্ন, নির্জন হয়ে গিয়েছে। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসে পাকিস্তানের ভূমিকাকে তুলে ধরে যে ভাষ্য তাঁরা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে গিয়েছিলেন, তাতে ভুল ছিল না কিছু, তবু গলদ কোথায় হল, সেই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছেই।

স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলাই ভাল, তা শুনতে যতই অপ্রিয় হোক না কেন। ২০১৬ সালের উরি এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামা কাণ্ডের পর (দু’টিই মোদী জমানার) যে প্রশ্নাতীত সমর্থন ও সমানুভূতি ভারত পেয়েছিল, তা অপারেশন সিঁদুরের পরবর্তী পর্যায়ে কোথায়? সিঁদুরে মেঘ দেখা তখনই শুরু হওয়ার কথা ছিল সরকারের! ২০১৬-তে উরির পর ভারতের সার্ক বয়কট করার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ। এই তিন প্রতিবেশী, বিশেষত ঢাকার সঙ্গে ‘সোনালি’ সম্পর্কের অবসান হয়েছে বছর ঘুরতে চলল। ২০১৯-এ পুলওয়ামার পরেও বিশ্ব পাশে ছিল নয়াদিল্লির। এতটাই যে, জইশ-ই-মহম্মদ প্রধান মাসুদ আজহারকে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে সন্ত্রাসবাদীর তালিকায় আনার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে বাধ্য হয় চিন-ও। অপারেশন সিঁদুরের পর শুধু তুরস্ক নয়, চিন, আজ়ারবাইজান, মালয়েশিয়া এবং ওআইসি-র অনেক রাষ্ট্রই হয় প্রত্যক্ষ ভাবে নয়তো পরোক্ষে রয়েছে পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের দাপটবন্দি ইসলামাবাদের পক্ষে।

টানা চার দিন ‘গুলির বদলে গোলা’র লড়াই চলার পর ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউস থেকে আসা ঘোষণায় গোটা বিশ্ব ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির কথা শুনল। এর পর ভারতের বিদেশসচিব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তারা সে কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন। সব রাজনৈতিক দলের সংসদীয় বৈঠকের পর এক অভিনব সিদ্ধান্ত নিল মোদী সরকার। সব দলের সংসদীয় প্রতিনিধি দল, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেন বিশ্বের বত্রিশটি দেশে, সব মিলিয়ে প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য। সাধারণ মানুষের করের টাকায় এই রাজসূয় সফরের যাথার্থ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় বা সাহস তখন কংগ্রেস-সহ কোনও বিরোধী দলের নেই। গগন উদবেলিয়া জাতীয়তাবাদের বিপুল তরঙ্গ তখন আছড়ে পড়েছে আসমুদ্র হিমাচল, যে তরঙ্গশীর্ষে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই আবেগে নিজেদের নৌকা না ভাসালে ‘হিন্দু আবেগ’ থেকে ছিটকে যেতে হবে।

কিন্তু দৌত্য শেষ হওয়ার পক্ষকাল পর প্রশ্ন উঠছেই, মোদ্দা কাজ হলটা কী? সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো হল আমেরিকায়। অধুনা রাজনৈতিক অবস্থানে ‘ঘরেও নহে পারেও নহে’ চরিত্র শশী তারুর তাঁর ভাষাজ্ঞানের তুবড়ি ছোটালেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও গেলেন এই নেতারা, বিদেশমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু হলটা কী?

এখনও পর্যন্ত যত দূর হিসাবে আসছে ষোলো বার, প্রকাশ্যে সদম্ভে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের সমস্ত ফুৎকার, কূটনৈতিক বার্তা, দৌত্য উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ বিরতিতে মধ্যস্থতা তিনি করেছেন, তাও আবার বাণিজ্যের টোপ দিয়ে। ভবিষ্যতে কাশ্মীর নিয়েও আলবাত করবেন। এমনকি যে দিন তাঁর সঙ্গে মোদীর ফোনালাপ হল এবং বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী দীর্ঘ হিন্দি ভিডিয়ো বার্তায় আমেরিকার দাবিকে নস্যাৎ করলেন, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প একই রেকর্ড বাজালেন! একই হাইফেনে দু’টি দেশকে নিয়ে আসা বা পাকিস্তানের ভূয়সী প্রশংসা করাই শুধু নয়, অভূতপূর্ব ভাবে নয়াদিল্লির নাকের ডগা দিয়ে হোয়াইট হাউসের নৈশভোজে আমন্ত্রিত হলেন মুনির, যিনি পহেলগাম কাণ্ডের অভিযুক্ত খলনায়ক। হতেই পারে, ইরান থেকে পাকিস্তানকে দূরে রাখার জন্যই এই আমন্ত্রণ, কিন্তু পহেলগাম কাণ্ডের পর পাক সন্ত্রাসের নিন্দা করে আজ পর্যন্ত একটি বাক্যও শোনা গেল না ট্রাম্পের মুখে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে অথবা সন্ত্রাসে পুঁজি জোগানের ক্ষেত্রে নজরদারি সংস্থা এফএটিএফ-এ ইসলামাবাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারল না ভারতের কূটনৈতিক দৌত্য, বরং তার উল্টো ফল হল। ২০০৮-এ মুম্বই হামলার পর বিশ্বজনমত এতটাই ভারতপন্থী ছিল যে, এফএটিএফ-এর তালিকায় সর্বপ্রথম পাকিস্তানকে ঢোকানো গিয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদের নিষিদ্ধ জঙ্গি তালিকায় হাফিজ় সইদ-সহ লস্কর-ই-তইবার একাধিক সন্ত্রাসবাদীকে অন্তর্ভুক্ত করাও সম্ভব হয়েছিল। আর এ বার? নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসাবে, পহেলগাম কাণ্ডের জন্য প্রথমেই নয়াদিল্লিকে কলা দেখিয়ে টিআরএফ (দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট)-কে আলোচনার টেবিল থেকে বাদ দিতে সক্ষম হল পাকিস্তান। তার আগে দু’সপ্তাহ ধরে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে এবং এফএটিএফ-এ দৌত্য করেছিলেন ভারতীয় কূটনীতিকরা।

জুন মাসের গোড়ায় যখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সিঁদুরের তত্ত্ব নিয়ে আবেগের হাওয়া গরম করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী, তখন রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের ‘তালিবান নিষেধাজ্ঞা কমিটি’র চেয়ারম্যানও করা হল পাকিস্তানকে। পাশাপাশি পরিষদের ‘সন্ত্রাস বিরোধী কমিটি’র সহ-সভাপতিও! আর তার তিন সপ্তাহের মধ্যে ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ঋণ পাকিস্তানকে মঞ্জুর করল আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ)। যে মঞ্জুরির আগেই একাধিক বার প্রশ্ন তুলে বিরোধিতা করেছিল ভারত। কা কস্য পরিবেদনা। আইএমএফ কর্তৃপক্ষ জানালেন, পাকিস্তান এই ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল লক্ষ্য পূরণ করেছে। তাই ঋণ মঞ্জুরিতে কোনও বাধা নেই।

ওই জুন মাসেই জি৭-এ যোগ দিতে কানাডা গেলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের ন্যায্য যুদ্ধের সমর্থনে একটি শব্দও পাওয়া গেল না। জুনের শেষে এসসিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে চিনে গিয়ে নথিতে সই করতে পারলেন না প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, কারণ তাতে পহেলগাম অথবা পাকিস্তানের সন্ত্রাস নিয়ে একটি বাক্যও নেই। প্রশ্ন উঠছে, তুরস্ক বা চিন যদি পাকিস্তানের পাশে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, ভারতের পাশে কবে কোন রাষ্ট্র এসে শক্ত ভাবে দাঁড়াবে— ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ড’ হিসাবে? যে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা দৃশ্যতই তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্তির জন্য জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। সতত পরিবর্তনশীল ভূকৌশলগত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত কী করতে চাইছে, সেই ভাষ্য ও বার্তা পৌঁছনোর কাজ শুরু করলে তা অধিক কাজের হবে।

‘যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলাই যুদ্ধ’, মোদীর ‘নতুন বাস্তবতা’ আন্তর্জাতিক বিশ্বে অনেকেরই ভ্রু কুঞ্চিত করেছে। তার মানে কি কোনও সন্ত্রাসবাদীর ট্রিগারের উপরে ভারতের সামরিক অভিযান নির্ভরশীল হয়ে পড়বে? পহেলগাম নাশকতার সঙ্গে যুক্ত সংগঠন ও জঙ্গিদের ভারত কাঠগড়ায় তুলতে পারল না কেন, সেই প্রশ্ন তুলছে অনেক রাষ্ট্র। এ কথাও ভারতের দূতরা ভিন রাষ্ট্রগুলিকে বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে, গত কয়েক বছর ধরে নয়াদিল্লির বাঁধা বুলিটি ‘সংলাপ এবং কূটনীতিই একমাত্র সমাধান’ এবং ‘এই কালখণ্ড যুদ্ধের নয়’— ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হচ্ছে না কেন?

সম্প্রতি মোদী, রাজনাথ সিংহ এবং জয়শঙ্কর একই স্বরে বলেছেন, সন্ত্রাসের প্রশ্নে দ্বিচারিতা চলবে না। যে ভাবে আগেও মনমোহন সরকার বলত, ‘ভাল তালিবান’ ‘খারাপ তালিবান’ তত্ত্ব নেহাতই সুবিধাবাদ। মুশকিল হল, ভারতকেও নিজের বার্তা স্থির করার আগে কয়েকটা কাজ করতে হবে। বাস্তবের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে নিজের পাকিস্তান নীতিকে ঝালিয়ে নিতে হবে। নয়তো এই বিচ্ছিন্নতাই মেনে নিতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Operation Sindoor 2025 Operation Sindoor Effect Operation Sindoor India-Pakistan Diplomacy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy