E-Paper

একাকী মানবের মুখ

১৯২৫-এ বেঙ্গালুরুতে জন্মানো বসন্তকুমারের বেড়ে ওঠা কলকাতায়। এ কথাও বহুশ্রুত যে, তাঁর গুরু দত্ত নামটাও কলকাতা থেকেই সংগৃহীত। কলকাতা ও বাঙালি-প্রীতি সারা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন।

সায়নদেব চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৫:৩৫
গুরু দত্তের যে ‘ব্যক্তিবাদ’, যে কোনও সময়েই তা সমষ্টিবাদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হতে পারে— কিন্তু পঞ্চাশের দশকে ওই সংঘাতের রূপ ছিল তীব্র।

গুরু দত্তের যে ‘ব্যক্তিবাদ’, যে কোনও সময়েই তা সমষ্টিবাদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হতে পারে— কিন্তু পঞ্চাশের দশকে ওই সংঘাতের রূপ ছিল তীব্র।

সমষ্টি কি ব্যক্তির মুখ, না কি ব্যক্তি সমষ্টির— মানব সংস্কৃতির এ এক প্রাচীন দ্বন্দ্ব। বা ধন্দ। পশ্চিমি সভ্যতার উষাকালে ইলিয়াড-এ আকিলিস ঘোষিত ভাবেই গোষ্ঠীবিরোধী, ট্রয়-এর যুদ্ধে সে লড়ে পুরস্কার এর লোভে, পরে হেক্টর-এর হাতে পেট্রোক্লাস নিহত হলে অদম্য ক্রোধের বশবর্তী হয়ে। সমষ্টির প্রশ্নে তার কিছু আসে যায় না। ঠিক যেমন ইউলিসিস-এরও। অথচ কালের নিয়মে এই দুই মহারথী— অ্যাকিলিস আর ইউলিসিস— যাবতীয় দোষগুণ নিয়েই, স্থাপিত হয়েছে গ্রিসের আর্কেটাইপ বা মূল প্রতিরূপ হিসাবে। সত্যি বলতে কি, গোটা সাহিত্যের ইতিহাসে স্বকীয়, ব্যক্তিবাদ আর সামষ্টিক আর্কেটাইপ-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব এক অন্যতম মুখ্য বিষয়।

এই দ্বন্দ্ব ফিরে ফিরে এসেছে বার বার। সাহিত্যের যে যুগটায় এই প্রশ্ন একেবারে কেন্দ্রীয় আকার নিল, সেটা রোম্যান্টিসিজ়ম। ‘এনলাইটেনমেন্ট’-এর হাত ধরে রোম্যান্টিসিজ়ম-এর জন্ম। এই দর্শনে ব্যক্তিই হল শেষ কথা— সমষ্টির স্থান ব্যক্তির নীচে। রোম্যান্টিসিজ়ম-এর মুখ্য কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তিবাদী দর্শনের উপরে। তাই রোম্যান্টিক কবিরা বার বার নিজেকেই তাঁদের কাব্যের মূল চরিত্র করেছেন। আধুনিক কবি ও কবিতাও কিন্তু এই কাঠামোর বাইরে নয়। তাই বলে সমষ্টি কি আসেনি— না কি সাহিত্যে সে ব্রাত্য? টলস্টয় থেকে গ্রসমান থেকে মার্কেস বার বার হাতড়ে খুঁজেছেন সমষ্টির মুখ হতে পারা ব্যক্তি। অন্য দিকে জয়েস থেকে কাফকা থেকে কামু বার বার ফিরে গেছেন ব্যক্তিবাদেরই কাছে।

পাঠক! রবিবারের সকালে এমন তাত্ত্বিক কচকচির অবতারণা করছি নিতান্ত বাধ্য হয়ে— এই কথাগুলোকে বাদ রেখে বসন্তকুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোনকে নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দুষ্কর। তিনি কে? সদ্য শতবর্ষ পার করা গুরু দত্ত। তাঁর নিজের সময়ে তিনি ব্যক্তি ও সমষ্টির এই দ্বন্দ্বের মাঝখানেই শুধু পড়ে গিয়েছিলেন তা নয়, তাঁর জীবন ও কাজ প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে বিলীন করেছিলেন এই দ্বন্দ্বের ওজন সামলাতে।

১৯২৫-এ বেঙ্গালুরুতে জন্মানো বসন্তকুমারের বেড়ে ওঠা কলকাতায়। এ কথাও বহুশ্রুত যে, তাঁর গুরু দত্ত নামটাও কলকাতা থেকেই সংগৃহীত। কলকাতা ও বাঙালি-প্রীতি সারা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন। চরিত্র খুঁজেছেন সে রকম। পরে বিয়েও করলেন ফরিদপুরের ঘোষচৌধুরী বাড়ির মেয়ে গীতাকে। কলকাতা থেকে গেলেন আলমোড়া, ছাত্র ছিলেন উদয়শঙ্করের নাচের স্কুলে। কুড়ির কোঠায় পুণের প্রভাত স্টুডিয়োতে সিনেমায় হাতেখড়ি।

শোনা যায়, লন্ড্রির কাপড় অদলবদল হওয়ার চক্করে দেব আনন্দের সঙ্গে পরিচয় ও গভীর বন্ধুত্ব। কথা ছিল, যিনি আগে সিনেমায় নাম করবেন, তিনি অন্য জনকে সুযোগ দেবেন। সেই থেকেই প্রথম সিনেমা পরিচালনা। ১৯৫১। নতুন প্রোডাকশন সংস্থা ‘নবকেতন’-এর ছবি বাজ়ি। নায়ক দেব। বাজি আর পরের ছবি জাল দুটোই হইহই করে চলেছিল। দুটোই ১৯৪০-এর দশকের হলিউড-এর ‘ফিল্ম নোয়ার’-এর প্রতি সাদর শ্রদ্ধার্ঘ্য। গুরু দত্তের ছবির চরিত্রগুলির মধ্যে যে নৈতিকতার দ্বন্দ্ব, সেটাও খুব সূক্ষ্ম ভাবে ধরা পড়তে শুরু করল দুটো ছবিতেই। ১৯৫৩ থেকে নিজের সংস্থা। আর তার সঙ্গে নিজের একটা দল— জনি ওয়াকার, ভি কে মূর্তি, আবরার অলভি, রাজ খোসলা। তাঁদের নিয়ে আর পার, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫, সিআইডি। কোনওটা থ্রিলার, কোনওটা রোম্যান্টিক কমেডি। কিন্তু তিনটেই তুমুল সফল। আর একটা মিল। আর পার-এর ট্যাক্সিচালক বিরজুই হোক, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ৫৫-র অস্থির, কর্মহীন কার্টুনিস্ট প্রীতমই হোক, বা সিআইডি-র এর ইনস্পেক্টর শেখর— কোনও চরিত্রই একেবারে সাদামাঠা, নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা নয়। সে রকম চরিত্রের প্রতি কিঞ্চিৎ অবজ্ঞা ছিল গুরু দত্তের, এ রকমই মনে করা হয়।

এই অবধি দত্তের উত্থানকাহিনিতে পাকদণ্ডীর কোনও প্রগাঢ় উপস্থিতি নেই— যেটুকু আছে, সেটুকু সিনেমার সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাইকেই সয়ে নিতে হত। সিনেমা মানেই হার-জিতের বাজি, সাফল্য-ব্যর্থতার আলোআঁধারি। সেখানেও দেখা যাচ্ছে এক সয়লাব ছাড়া পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গুরু দত্ত বা তাঁর সংস্থার সে রকম কোনও স্খলন নেই। খ্যাতি, সাফল্য আর অর্থ, তিনটেই জুটছে গুরু দত্তের; ও তাঁর দলের বাকিদের।

কিন্তু গুরু দত্তকে নিয়ে আজ অবধি যত লেখা হয়েছে, তার ৯৯ শতাংশই কোনও রকম বিশ্লেষণ ছাড়া জানাবে যে, ব্যক্তি গুরু দত্ত ও তাঁর সিনেমা সবটাই, একেবারে শুরু থেকে, একটা সরলরেখার অংশ— যে সরলরেখার মেজাজ রোম্যান্টিক, আত্মবিলাসী, আত্মঘাতী, বিষণ্ণ ইত্যাদি। ঠিক তাই কি? তাঁর সিনেমার মূল চরিত্রের নৈতিক দ্বন্দ্ব লক্ষণীয়, কিন্তু সার্বিক ভাবে সিনেমার চিরবিষণ্ণ কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়ার যে দাবি এই লেখাগুলো করে থাকে, সেগুলোর কিন্তু কোনও বাহ্যিক প্রকাশ ১৯৫৭ অবধি নেই। একমাত্র ইয়াসের উসমান গুরু দত্তের সাম্প্রতিকতম জীবনীতে দেখতে চেয়েছেন যে, একেবারে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কোনও গভীর ক্ষত গুরু দত্তের মধ্যে ছিল কি না। এর কারণ, ১৯৫৬ সালে প্যাসা-এর কাজ সমাপ্তির পর (আর, তাঁর স্বপ্নের এই ছবির মুক্তির আগেই) প্রথম বার আত্মহননের চেষ্টা করেন গুরু দত্ত। কেন? এর কোনও সহজলভ্য উত্তর নেই। প্যাসা-র বিষয়— আপসহীন, ব্যক্তিবাদী, সভ্যতার সঙ্কটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া কবি বা শিল্পীর সঙ্গে এই বেচা-কেনার পৃথিবীর যে অবশ্যম্ভাবী সংঘাত— সেটা তাঁর নিজের জীবনেও কি ক্রমাগত ছায়া ফেলছিল? তারই প্রতিক্রিয়ায় কি ওই ছবি সমাপ্ত করেই এক ধরনের মুক্তির প্রচেষ্টা?

নিজের সৃষ্টি ও কাজ ক্রমে একটা ব্যক্তিগত সঙ্কটে পরিণত হচ্ছে, এ রকম শিল্পীর সংখ্যা তো কম নয়। গুরু দত্ত কি তার মধ্যে এক জন? এটা আরও ভাবায় আর একটা কারণে। তাঁর প্রযোজনা সংস্থার জন্য তাঁর নিজেরই করে দেওয়া নিয়ম— একটা ঝুঁকিপূর্ণ ছবি করলে পরেরটা ব্যবসায়িক ছবি করতে হবে— নিজেই ভাঙলেন গুরু দত্ত। প্যাসা-র পরের ছবি বাছলেন কাগজ় কে ফুল। এ ছবির বিষয় প্রচণ্ড আত্মাভিমানী এক চলচ্চিত্র পরিচালক, যিনি ক্রমাগত নিজেকে একটু একটু করে কাজে আর ভালবাসায় নিঃশেষ করে দিতে থাকেন। ‘রোম্যান্টিক আর্টিস্ট’-এর এটা এক অমোঘ চিহ্ন— শিল্পীর শিল্পে বিলীন হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, যে সঙ্কট প্যাসা-এ ছিল গহন, সেটাকেই পুরোমাত্রায় পৃষ্ঠতলে নিয়ে এলেন গুরু দত্ত। এর থেকে সর্বার্থে ব্যক্তিগত ঝুঁকি আর কী থাকতে পারে? ছবির ব্যবসায়িক অসাফল্য যে তাঁকে মর্মাহত করবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর এটাই তাঁর পরিচালিত শেষ ছবি। এর পর পাঁচ বছর অভিনয় আর প্রযোজনা, ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষোভ, পাওয়া-না-পাওয়ার খতিয়ান ইত্যাদি, কিন্তু পরিচালনা নয়। তার পর, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যু। ইচ্ছামৃত্যুও বলা যেতে পারে।

কিন্তু গুরু দত্তের ‘সঙ্কট’টাকে শুধুই ব্যক্তিগত হিসাবে দেখলে হিন্দি ছবির ইতিহাস অনেকটাই ফ্যাকাশে রয়ে যাবে। এর কারণ, ব্যক্তির ও ব্যক্তিত্বের যে বিনাশের উপাখ্যান প্যাসা আর কাগজ় কে ফুল, সেটার পরিপ্রেক্ষিত পঞ্চাশের দশক। গুরু দত্তের যে ‘ব্যক্তিবাদ’, যে কোনও সময়েই তা সমষ্টিবাদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হতে পারে— কিন্তু পঞ্চাশের দশকে ওই সংঘাতেররূপ ছিল তীব্র। তার কারণ, নেহরুবাদ। নেহরুবাদের যদি কোনও সংজ্ঞা থেকে থাকে, সেটার একক ব্যক্তি নয়, সমষ্টি; আমি নয়, আমরা। দেখা যাবে যে, বিমল রায় থেকে রাজ কপূর, এবং সর্বোপরি দিলীপ কুমার যথাক্রমে তাঁদের ছবিতে ও চরিত্রে সমষ্টির মুখ হয়ে ওঠার একটা ধারা তৈরিতে অনেকাংশে ব্যস্ত। দো বিঘা জ়মিন থেকে গঙ্গা যমুনা, আওয়ারা থেকে নয়া দৌড়, একের পর এক ছবি নির্মাণ করছে সমষ্টির চিত্র, দেশের সমষ্টিক সমস্যা ও এক ধরনের দূরদর্শী, প্রগতিবাদী, ভ্যানগার্ড প্রোটাগোনিস্ট। প্রগতিবাদী সোভিয়েট রিয়ালিজ়ম যেমন ব্যক্তির সঙ্কটকে একেবারেই পাত্তা দিতে নারাজ ছিল, পঞ্চাশের দশকের নেহরুবাদ ব্যক্তির সঙ্কটকে কটাক্ষ না করলেও সেই সঙ্কটে অংশগ্রহণ করতে চায়নি, কিংবা পারেনি। অন্তত সে রকমই একটা পরিস্থিতি গুরু দত্তের সংশয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল বলা যায়।

তাই গুরু দত্তের ব্যক্তিত্বর কাছাকছি ওই বিশেষ দুই চরিত্র— প্যাসা-র বিজয় আর কাগজ় কে ফুল-এর সুরেশ সিনহা— অন্তর্মুখী, প্রতিবাদী, ইগোয়িস্টিক, ব্যক্তিবাদী; দু’জনেই রোম্যান্টিক শিল্পীর কাব্যিক দুঃখময়তা নিয়ে হেঁটে গিয়েছেন স্রোতের বিরুদ্ধে। প্যাসা-র ‘জিনহে নাজ় হ্যায় হিন্দ পর’ শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন নেহরু— কিন্তু ছবিটি স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন দেশের ভবিষ্যৎ ও প্রগতির ব্যাপারে নির্লিপ্ত। বিজয়কে ভাবায় সমষ্টি নয়, বরং শৈল্পিক অস্তিত্বের অশ্লীলতা, নিচু জীবনের অপমান ও জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে থাকা লেনদেনের মহাসমারোহ। তাই বিজয় জিশুর মতো দেখা দেয় তার নিজেরই স্মারক অনুষ্ঠানে; আর একদা-বিখ্যাত, বিস্মৃত, উপেক্ষিত সুরেশ সিন্‌হার মৃত্যু হয় ধূলিধূসরিত স্টুডিয়োর একাকী চেয়ারে।

তাই বোধ হয় তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও ‘ইয়ে দুনিয়া আগর মিল ভি জায়ে তো কেয়া হ্যায়’ বা ‘ওয়াক্ত নে কিয়া কেয়া হাসিঁ সিতম’ বয়ে নিয়ে বেড়ায় সমষ্টির মুখ হতে না পারা বিদ্রোহী এবং উদ্ধত ব্যক্তিবাদের ব্যঞ্জনা।

ক্রিয়া ইউনিভার্সিটি, অন্ধ্রপ্রদেশ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Legend Film industry

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy