E-Paper

হঠাৎই আত্মঘাতী গোল

সাম্প্রতিক সময়ে এই বাংলায় বিজেপির যে প্রচার, তা মোটের উপরে ফুটবল ম্যাচে নিজেদের পেনাল্টি বক্সে হ্যান্ডবল খেলার মতো। দিনের পর দিন ধর্মনির্বিশেষে গরিব পরিযায়ী বাঙালিকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে হিন্দু ভোটারদের চটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে তারা।

শুভময় মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৩০
সু-যোগ: বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা সংস্কৃতিকে হেয় করার অভিযোগ তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৬ জুলাই।

সু-যোগ: বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা সংস্কৃতিকে হেয় করার অভিযোগ তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৬ জুলাই। ছবি: পিটিআই।

বাঙালির গর্ব করার মতো যে কয়েকটা জিনিস ছিল, তার মধ্যে একটা হল রাজনৈতিক সচেতনতা। দীর্ঘ সময় ধরে এ রাজ্যে হিন্দু রাষ্ট্রবাদের প্রভাব ছিল একেবারেই কম। গত শতকের আশির দশকের শেষ থেকে যখন গোটা দেশে আরএসএস এবং বিজেপির উত্থান, তখনও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রভাব পড়েনি তেমন ব্যাপক ভাবে। সেই ঘটনা ঘটল ২০১৬ সালের পর থেকে, এবং তা সঠিক ভারসাম্য পায় ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে। তার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি মানেই তৃণমূল বনাম বিজেপি। সেই রাজনীতি অবশ্যই উন্নয়নের তুলনায় অনেক বেশি বিভেদের। বাঙালি পরিচিতি নিয়ে এখন গোটা দেশে যে অশান্তি তীব্র হচ্ছে, বাংলায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে হবে তৃণমূল-বিজেপির সেই বিভেদের পরিপ্রেক্ষিতেই। নিম্নবিত্ত বাংলাভাষী মানুষকে বাংলাদেশি তকমা দেওয়া হচ্ছে, যা নিয়ে বিজেপি-তৃণমূলের তরজা জারি।

প্রথম ভাষা হিসাবে লোকসংখ্যার নিরিখে ভারতে হিন্দি এক নম্বরে, দ্বিতীয় স্থানে বাংলা। গোটা পৃথিবীতে হিন্দি তিনে, বাংলা সাতে। প্রশ্ন হল, হিন্দির সঙ্গে তুলনায় বাংলা ভাষা কোথায় দাঁড়াবে? বাঙালিদের এবং বাংলা ভাষার যে দীর্ঘ ইতিহাস এবং অবদান, তা অস্বীকার করার নয়। অবাঙালি বুদ্ধিজীবীরা আজও বাংলা এবং বাঙালির মগজ নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে উচ্ছ্বসিত। বাঙালি হিসাবে এটা ভাবতে ইচ্ছা করে যে, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের দিক থেকে বাংলা এখনও এগিয়ে— যদিও, সে কথাটা নৈর্ব্যক্তিক ভাবে প্রমাণ করা মুশকিল। গোটা দুনিয়ায় মেধাজীবী শ্রেণির মধ্যে সম্ভবত হিন্দিভাষীদের তুলনায় বাঙালিরা এখনও এগিয়ে রয়েছেন। তবে, সেই ব্যবধানও কত দিন টিকবে, বলা মুশকিল। কিন্তু, সে সব হিসাব মহানগরের উদারবাদী মধ্যবিত্ত নাগরিক শ্রেণির। বাংলা ও বাঙালি বলতে তো শুধু সেটুকুই বোঝায় না।

গোটা দেশের মতোই আমাদের রাজ্যে বিপুলসংখ্যক নিম্নবিত্ত মানুষ। শুধু আজ নয়, নবজাগরণের সময় থেকেই তাঁরা চিরকাল বাঙালি গৌরবের হিসাবের বাইরে থেকে গিয়েছেন। স্বাধীনতার আগে এবং পরেও দীর্ঘ সময় ধরে— কংগ্রেস আমলে, এমনকি সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খোয়াব নিয়ে ক্ষমতায় আসা বাম রাজত্বের প্রথমার্ধেও— ক্ষমতার রাশ ছিল বাঙালি ভদ্রলোক এবং উচ্চ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। বাম আমলের দ্বিতীয়ার্ধে খানিক হলেও ছবিটি পাল্টায়, রাজনীতির ভাষা বদল হতে শুরু করে। সেই ধারাকে একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলে তৃণমূল। আজকের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি আর মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক নন। তার রাজনৈতিক সুফল নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বাঙালির যে সম্মান ছিল, সেটা ছিল মূলত ভদ্রলোক শ্রেণির আধিপত্যের কারণেই। রাজনৈতিক অ-সংস্কৃতায়ণের ফলে সেই সম্মান খর্ব হয়েছে, এ কথা বললে সেটা রাজনৈতিক অশুদ্ধতার দোষে দুষ্ট হতে পারে, কিন্তু অনৃতভাষণ হবে না। বাংলার রাজনীতি থেকে ভদ্রলোক শ্রেণির রাশ যত চলে গিয়েছে, ততই কমেছে সেই পরিচিতির আত্মগৌরব— বাঙালি অনেক সহজে হিন্দি সংস্কৃতির আধিপত্য মেনেছে; উপভোগ এবং জীবন, দু’ক্ষেত্রেই। তৃণমূল কংগ্রেসের চোদ্দো বছরেররাজত্ব অবশ্যই এর জন্যে অনেকটা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।

নিম্নবিত্তের ভোটেই সরকার নির্বাচিত হয়। তাদের উন্নয়নও জরুরি। কিন্তু তার সঙ্গে রাজ্যের সার্বিক স্বাভিমান বজায় রাখার জন্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দিকে সরকারের যে নজর দেওয়া দরকার, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আমলে তাতে বড় মাপের ঘাটতি হয়েছে। এবং, মধ্যবিত্ত যে কিছুই পাচ্ছে না, সে বিষয়ে ক্ষোভের মাত্রা প্রকৃত ঘাটতির সঙ্গে সমানুপাতিক, হয়তো বা তার চেয়েও বেশি হয়ে উঠেছে। একটা কথা পরিষ্কার— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালি অস্মিতার রাজনীতিতে নামলেও সম্ভবত মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণিকে তাঁর পাশে পাবেন না। এটা ইতিহাসের এক আশ্চর্য রসিকতা— ঐতিহাসিক ভাবে যে শ্রেণি বাঙালির জাতিগৌরবের ধারক ছিল, এবং সেই পরিচিতি বাবদ সবচেয়ে বেশি সুবিধাও পেয়েছে যে শ্রেণি, তারাই এখন বাঙালি অস্মিতার লড়াইয়ে শামিল নয়।

অনুসিদ্ধান্তে এ রাজ্যে সামনের ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের কথায় আসতে হবে। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প হলেও এখনও বাম বা কংগ্রেস— অথবা, তাদের নির্বাচনী মহাজোট— প্রচুর আসন পাবে, তেমন সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজ্যের সিংহভাগ আসন ভাগ হবে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে— গত বার যেটা ছিল ২৯৪-এর মধ্যে ২৯৩। তৃণমূল রাজত্বে জনমুখী প্রকল্প সত্ত্বেও যে পরিমাণ দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ, তাতে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণির ভোট তাদের কম পাওয়ারই কথা। চাকরি চুরি থেকে আর জি কর-দক্ষিণ কলকাতা ল কলেজ— বহুবিধ কারণে মানুষ বিরক্ত। রাজ্যের পূর্ব প্রান্তের প্রতিবেশী দেশগুলির অস্থিরতা যে অনুপ্রবেশের সমস্যা বাড়িয়েছে, তা নিয়েও বাঙালি মধ্যবিত্ত কার্যত নিঃসংশয়। শুভেন্দু অধিকারী যে কোটি কোটি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর কথা বলেন, নিতান্ত সংখ্যাতত্ত্বের বিচারেই তা অতিরঞ্জন। কিন্তু, সংখ্যা নিয়ে সংশয় থাকলেও অনেকেই শুভেন্দুবাবুর অবস্থানটির সহভাগী। বিশেষত বাঙালি ভদ্রলোক— যার কাছে অনুপ্রবেশকারীরা শুধু অর্থনৈতিক কারণেই অবাঞ্ছিত নয়, শ্রেণিগত কারণেও অপাঙ্‌ক্তেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোককে আকর্ষণ করার জন্যে শমীক ভট্টাচার্যের মতো বাংলা ভাষায় অনবদ্য দখল রাখা মানুষের বিজেপি রাজ্য সভাপতি হওয়া অবশ্যই লক্ষণীয় পদক্ষেপ। দেখে মনে হয়, বিজেপি বাঙালির কাছে বাঙালি দল হিসাবে পৌঁছনোর চেষ্টা করবে— উত্তর ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে নয়, বাঙালির ধাঁচে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই বাংলায় বিজেপির যে প্রচার, তা মোটের উপরে ফুটবল ম্যাচে নিজেদের পেনাল্টি বক্সে হ্যান্ডবল খেলার মতো। দিনের পর দিন ধর্মনির্বিশেষে গরিব পরিযায়ী বাঙালিকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে হিন্দু ভোটারদের চটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে তারা। নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট যৌক্তিক ভাবে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধনের কথা বললেও বিজেপি-তৃণমূল তরজায় তার নেতিবাচক ব্যাখ্যা সামনে আসছে বেশি। মৃত ভোটার বাদ দেওয়ার থেকেও বিজেপির বেশি উৎসাহ তালিকায় অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে। এইখানেই সংখ্যালঘু ছাড়াও নিম্নবিত্ত সংখ্যাগুরু বাঙালির ভয় পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। প্রদত্ত ভোটের ৪০ শতাংশের আশেপাশে বিজেপি যে সমর্থন পায়, তা তো কোনও অঙ্কেই শুধু হিন্দু মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণির হতে পারে না। তৃণমূলের জনমুখী প্রকল্প সত্ত্বেও প্রচুর সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বী নিম্নবিত্ত মানুষ বিজেপিকে ভোট দেন, এ কথা বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। নির্বাচনের ঠিক আগে বিজেপি সেই সমর্থন নিজেরাই গুলিয়ে দিতে চাইছে কেন? মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণিও যে ভয় পাচ্ছে, এমন প্রচার উঠে আসছে তৃণমূলের গলায়— রিজেন্ট পার্কের সাম্প্রতিক আত্মহত্যাকে সেই ভাবেই পেশ করা হচ্ছে।

২০২৬-এ বাম বা কংগ্রেসের যে ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই, সে কথা বলতে জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রয়োজন হয় না। আরএসএস-এর চিন্তনদল কি মনে করছে যে, তা সত্ত্বেও তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকলে তাদের মঙ্গল? কারণ, বিজেপি এক বার জিতে গেলে তৃণমূল কংগ্রেস যদি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, তখন আবার সিপিএম বা কংগ্রেসের সঙ্গে মতাদর্শগত লড়াই লড়তে হবে? বা, তৃণমূলের একটা বড় অংশ এসে ভিড় জমাবে শাসক বিজেপিতে, যেটা হরে দরে হাঁটুজল? লোপ্পা ফুলটস দেখে অবাক লাগছে, যেখানে দিল্লির পুলিশ বাংলা ভাষাকে বলছে ‘বাংলাদেশি ভাষা’! বাঙালি মননকে ছুঁতে চাওয়া বাংলা বিজেপি যদি উল্টে অসংবেদনশীল হয়ে তৃণমূলকে ভাষা আন্দোলনের সুযোগ করে দেয়, সে ক্ষেত্রে তাকে নির্ভেজাল আত্মঘাত ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP TMC Bengali Migrant Worker Migrant Labours

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy