গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ কমছে। ফলে বহু নামী কলেজেও— একদা যেগুলিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া তাদের কাছে স্বপ্ন ছিল— কিছু কিছু বিষয়ে আসন খালি থাকছে। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে এ বছর পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকার-পোষিত কলেজগুলিতে স্নাতক স্তরে ভর্তি প্রক্রিয়া অনির্দিষ্ট কাল স্থগিত থাকার ফলে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে যে সঙ্কট সৃষ্টি হল তা প্রায় নজিরবিহীন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গত ২২ অগস্ট রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে বটে, কিন্তু এর পর কাউন্সেলিং ও ভর্তির পর্ব রয়েছে। সে সব মিটতে মিটতে হয়তো পুজোর ছুটি কাছে চলে আসবে। ফলে যারা ভর্তি হবে, প্রথম সিমেস্টারের পরীক্ষার আগে ক্লাস করার সুযোগ খুবই কম পাবে। এই দীর্ঘ সময়ে বেসরকারি কলেজগুলিতে কিন্তু ভর্তি প্রক্রিয়া থেমে নেই, সেখানে ইতিমধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে তাদের অনেকেই বেসরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে, কেউ কেউ ভিন রাজ্যেও পাড়ি জমিয়েছে। এ ছাড়া প্রথম সারির ছাত্রদের অনেকেই আইআইটি বা এনআইটি-র মতো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে গেছে। তাই অনেকেরই আশঙ্কা, ভবিষ্যতে শিক্ষা কেবল ধনীদের জন্যেই সংরক্ষিত থাকবে, জাতপাতভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা রাজনীতির উপজীব্য হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে তা হয়তো অবান্তর হয়ে উঠবে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, যে ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ নিয়ে এই জটিলতা, আইনবেত্তাদের অনেকেই মনে করছেন, সেটুকু বাদ দিয়ে বাকি ৯০ শতাংশ আসনে (এঞ্জিনিয়ারিং বাদে) ভর্তির ক্ষেত্রে কোনও আইনি বাধা বা আদালতের নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা, রাজ্যের কলেজগুলিতে মোট আসনসংখ্যা প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ, অথচ ভর্তির জন্যে আবেদন জমা পড়েছে মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একাধিক বিষয়ে আবেদন করেছে, কেউ অন্যত্র ভর্তি হয়েছে।
সুতরাং, ওবিসি-সংক্রান্ত মামলার সাপেক্ষে যে ১০ শতাংশ আসনের সংরক্ষণের বিষয়টি বিচারাধীন, তার নিষ্পত্তির জন্যে অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা না করে বরং ১০ শতাংশ আসন ফাঁকা রেখে বাকি ৯০ শতাংশ আসনে ছাত্র ভর্তি করাই যেত। সেটা যে সম্ভব, তা করে দেখিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয় পোর্টাল খোলার অপেক্ষায় না থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর্টস ও সায়েন্সের নানা স্নাতক কোর্সে ছাত্র ভর্তি করেছেন, ক্লাসও শুরু হয়েছে।
সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে এ বছরে মেডিক্যালের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্সে ভর্তির জন্য অপেক্ষারতরা। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট’ (নিট)-এর ফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে এবং অধিকাংশ রাজ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া সমাপ্ত, পঠনপাঠনও শুরুর পথে। ব্যতিক্রম একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ। বিজ্ঞপ্তি জারি করে এ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে কাউন্সেলিং ও ভর্তি স্থগিত রাখা হয়েছে। অথচ ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এনএমসি)-এর পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ বছর অগস্ট মাসের মধ্যে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্সে ভর্তি না হলে ছাত্রছাত্রীরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন পাবে না।
উপরন্তু এনএমসি সম্প্রতি যে ‘কমপিটেন্সি-বেসড মেডিক্যাল এডুকেশন কারিকুলাম (সিবিএমই) ২০২৪’ প্রকাশ করেছে তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে ভর্তি হওয়া পড়ুয়াদের কোর্স থেকে ‘ডিসচার্জ’ করা হবে, অথবা তাদের প্রাপ্ত কোনও ‘মেডিক্যাল কোয়ালিফিকেশন’কেই এনএমসি মান্যতা দেবে না। সুতরাং, ওবিসি-আবেগে হাওয়া টানতে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ ও মেধাসত্তাকে বাজি রাখার এই কৌশল রাজনৈতিক আয়ুধ হিসাবে যতই তীক্ষ্ণ হোক না কেন, এ বছরের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ুয়াদের পঠনপাঠনে সেটি যে ক্ষত সৃষ্টি করল, তা সহজে নিরাময়ের নয়।
এ তো গেল এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার মানচিত্রে এক বার চোখ বোলালেই বোঝা যাবে, সঙ্কট আরও ব্যাপক ও গভীর। এ রাজ্যে পড়ুয়ার অভাবে ইতিমধ্যে আট হাজার সরকার-পোষিত স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আরও কয়েক হাজার বন্ধ হওয়ার পথে। তত্ত্বগত ভাবে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞানচর্চা হলেও বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে অধিকাংশ পড়ুয়া কোনও সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন নিয়েই পড়াশোনা করতে আসে। অথচ শিল্প-বন্ধ্যা এই রাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। সরকারি ক্ষেত্রেও নিয়োগ তলানিতে।
তদুপরি নিয়োগের জন্য প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পিএসসি, এসএসসি, মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস কমিশন-সহ রাজ্য সরকার পরিচালিত অধিকাংশ সংস্থার বিরুদ্ধে বারংবার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসায় তরুণপ্রজন্মের অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, মেধার জোরে এ রাজ্যে চাকরি পাওয়া দুষ্কর। এমনকি, পেলেও তা যে কোনও সময় চলে যেতে পারে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে যাওয়া এবং সরু সুতোয় বত্রিশ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের ভাগ্য ঝুলন্ত দেখার পর তাঁদের এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে।
খুব সঙ্গত কারণে, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের পড়ুয়ারা আর স্কুল-কলেজে পড়তে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তাই একদা কায়িক শ্রমের জোগানদার হিসাবে পরিচিত পড়শি রাজ্যগুলির বাসিন্দারা সর্বভারতীয় স্তরে শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠায় অনেক এগিয়ে গিয়েছে, আর তাদের জায়গা নিয়েছে মেধা ও শিক্ষার শ্লাঘা-রোমন্থক বাঙালি। প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানরা কেবল মেধার জোরে আজ আর বিদ্যাসাগর, মেঘনাদ সাহা কিংবা আবুল কালাম আজাদ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে না। ভিন রাজ্যে তারা ইতিমধ্যেই রাজমিস্ত্রি, সাফাইওয়ালা কিংবা গৃহসহায়িকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বহু সরকারি কলেজেও তালা ঝুলবে। পরিত্যক্ত ভবনে শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ এবং সর্বজনীনতার ঢক্কানিনাদ ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মেহের আলির মতোই চিৎকার করে বলবে, “সব ঝুট হ্যায়!”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)