আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি একটা চিত্তচমৎকারী প্রশ্ন তুলেছিলেন, দুর্গাপুজোর মধ্যে শুক্লা সপ্তমী-অষ্টমী তিথির সন্ধি হয়, নবমী-দশমী তিথির সন্ধি হয়, আলাদা আলাদা তিথির পুজো হয়, অঞ্জলি ইত্যাদিও চলে। তবে অষ্টমী-নবমী তিথির সন্ধিক্ষণটিকে অত বিশেষ করে তুলে ‘সন্ধিপুজো’ বলে এমন বিশদ আয়োজন হয় কেন?
পুরুলিয়া জেলা লাইব্রেরির উঁচু তাকে রাখা অনেক পুরনো প্রবাসী পত্রিকায় ছিল লেখাটা। এক রকম করে তার উত্তরও ছিল। আরও বেশ কিছু প্রশ্ন, এবং তাদের সম্ভাব্য উত্তরও। ইস্কুলে পড়া কালে যে তার সব বুঝতে পেরেছিলাম, এমনও নয়। তবে এটুকু মনে আছে, শ্রীবিদ্যানিধির বিষয় ছিল এ কথা প্রমাণ করা যে, দুর্গাপুজো আসলে কোনও একটা পুজো নয়, যে ভাবে বাংলায় পুজো হয় তা প্রকৃতপক্ষে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন পূজার্চনার একটি সমন্বয়। এবং তার অন্যতম অংশ হল কৃষিকাজের সঙ্গে জড়ানো। পুরুলিয়ার সব লোক সেই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণী লেখা পড়েছিলেন কি না জানা নেই, কিন্তু ওই ‘সন্ধিপুজো’ ব্যাপারটার সমারোহ ছিল অতি বিশাল। এবং প্রধানত শব্দগত। অন্তত শহরে।
পুরুলিয়ার নিজস্ব ভাষায় একে বলত ‘ক্ষ্যাণ’। অপেক্ষাকৃত উচ্চবর্ণের পরিবারে নানান পালনীয় বিধি ছিল সে দিন, উপবাস ও সম্পূর্ণ নিরামিষ রান্নাবাড়া সম্পর্কে। কিন্তু বাকি সবাই সেই ‘ক্ষ্যাণ’ টের পেত শব্দে। যদিও তখন সর্বজনীন পুজোর সংখ্যা ছিল কম। ঘটাপটার তুলনায় আজকের কাছে একেবারে নস্যি, কিন্তু তারও হাঁচির দাপট কম ছিল না। এক মুহূর্তে সব মণ্ডপের সব ঢাক, কাঁসর-ঘণ্টা এক সঙ্গে বেজে ওঠা তো ছিলই, কিন্তু আসল আকর্ষণ (মতান্তরে আতঙ্ক) ছিল শহরের চকবাজারের মণ্ডপ থেকে কাপড়াগলি পর্যন্ত, নডিহা ষোলোআনা থেকে বড়হাট পর্যন্ত, একশো-দু’শো মিটার রাস্তা জুড়ে বিছিয়ে রাখা কালীপটকার মালায় এক সঙ্গে আগুন দেওয়া। সেই শব্দ আর পোড়া বারুদের গন্ধে মাইকে নানা প্যান্ডেলের ভেসে আসা মন্ত্রোচ্চারণের টুকরো মিলে যে ব্যাপারটা তৈরি হত, ঠিক ‘ক্ষ্যাণ’ বললেই তার সম্যক শব্দরূপটি বোঝা যায়।
তবু, সেই পুরুলিয়ায় দুর্গাপুজো উৎসবের অনেক বেশি জাঁকজমক ছিল নবমীকে ঘিরে। সে দিন পুরুলিয়া আর পুরুলিয়ায় থাকত না। এমনিতে দুর্গাপুজো শহরের পুজো, গ্রামে সে সময়টা বড় একটা আনন্দের নয়। তখন, সেই ষাট-সত্তরের দশকে, ওই সময়ে গ্রামে গত বছরের চাল ফুরিয়ে গিয়েছে, পরের বার ধান উঠতে তখনও ঢের দেরি। খাটিয়ে লোকেদের বেশির ভাগ ঘরেই খাবার বলতে শুধু মকাই, কোদো, গুঁদলি আর শাকপাতা। কিন্তু নবমীর দিন আশপাশের গ্রাম উজাড় করে লোকেরা আসত শহরের পুজো দেখতে। এক সঙ্গে নয়, নানা গ্রাম থেকে দল বেঁধে বেঁধে লোক আসত বেলা দশটা-এগারোটা থেকে। শহরে শতাধিক বছরের প্রাচীন নীলমণি চাটুজ্জের বাড়ির পুজো, তাঁদের বাড়ি নাকি নেতাজি এসেছিলেন, চকবাজারের পুরনো ডাকের সাজের গমগমে পুজো— সব ম্লান করে দিয়ে সবচেয়ে বেশি ভিড় জমা হত জেলেপাড়ার ঠাকুরের প্যান্ডেলে।
সারা বছর নজরে না-আসা, সাহেব বাঁধের কোল ঘেঁষা সেই মাটির রাস্তার মোড়খানা সেই ক’দিন যেন একেবারে আলতা বেনারসি পরে ফেলত। অতটা জায়গা যে লুকিয়ে আছে ওই তিন-মাথার মোড়ের মধ্যে, সারা বছর যেখানে জাল শুকোয়, বাচ্চারা খেলে, কেউ মনই দেয় না যাতায়াতের পথে— সেইটে হঠাৎ কী করে নিজেকে একেবারে পাল্টে ফেলে পাকা বিরাট এক দুর্গামণ্ডপ বার করত ট্যাঁক থেকে। শহরের সবচেয়ে বড় মূর্তি, সবচেয়ে জাঁকজমকের পুজো। তার নিজস্ব গান, নিজেদের ‘সং’ বেরোনো, সব নিয়ে জেলেপাড়া ক’দিন হয়ে উঠত শহরের আকর্ষণ। সেই আকর্ষণ চূড়া স্পর্শ করত নবমীর দিন। চলত একাদশীর দিন অবধি।
এমন নয় যে একই লোকেরা রয়ে যেত তিন দিন ধরে। প্রতি দিন নতুন নতুন গ্রাম থেকে আসত লোক। বাঁকুড়ার রাস্তা দিয়ে, হুড়া পুঞ্চা মানবাজার সব রাস্তা দিয়ে, পায়ে হেঁটে। আলাদা সমারোহ থাকত আদিবাসী দলগুলোর আসায়। পুরুলিয়ার চলতি কথায় তাদের সকলকেই বলা হত মাঝি। এদের আসা মন্দ্রিত হত ধামসা-মাদলের গম্ভীর ধ্বনি আর ধিতাং ধিতাংয়ে। গ্রাম থেকে ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি, সবচেয়ে বেশি দেখা যেত বাচ্চা-কোলে মায়েদের। দু’-তিন কিলোমিটার হেঁটে সকলে আসত তারা। আর শহরের সব রাস্তা ভরে যেত উৎসব দেখতে-আসা মানুষদের ভিড়ে। কোনও যানবাহন চলবে না, রিকশা পর্যন্ত নেই। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া শহর সে দিন নিজের ঘরে বসে থাকত পথ ছেড়ে।
বেলা ঢলে আসার সময় থেকে শুরু হত পার্বণের এক নতুন অধ্যায়। সারা বছর গ্রামের আনাজপাতি, মাছ, শস্য শহরের গৃহস্থঘরে ঢোকে, তাদের মুখগুলো থাকে অনেক দূরে। ওই নবমীর দিন গ্রামের মানুষদের ঢেউ শহরের গৃহস্থদের উঠোনে এসে দাঁড়াত। বেলা আড়াইটে-তিনটে থেকে খোলা দরজা দিয়ে দল বেঁধে আসত লোকজন— এখানেও সবচেয়ে বেশি মেয়েরা আর কচি মায়েরা— ‘আমাদের পাব্বনিটা দাও গো’ বলে। কোনও রকম ভিক্ষা দূরস্থান, কৃপা প্রার্থনারও সুর থাকত না সেই সুরে। থাকত এক সহজ দাবির সুর, যেমন হওয়ার কথা, “আজ আমি তোমার বাড়িতে এলাম, আমারটা দাও।” ধামসার গভীর, গম্ভীর আওয়াজে পুরো গলির বুকের মধ্যে গুরুগুরু করে উঠত।
গৃহস্থের তরফেও থাকত এই আসার প্রস্তুতি। আমরা সেই অর্থে পুরুলিয়ার মাটির নই, বাইরে থেকে আসা দূরদেশের শেকড়ছেঁড়া লোক। মা তবু ভালবাসতেন, সম্মান করতেন এই মাটির মানুষদের। মাকে দেখতাম, বরাবরের মতোই নিজের সীমিত সাধ্যকে যত্ন দিয়ে পূরণ করতে। পাঁচ-দশ দিন আগে থেকে শুরু হত খই দিয়ে মুড়কি করে একটা বড় টিনে ঢেলে রাখা, আর নারকেল নাড়ু বানানো। তার পর সেই মহাদিনে বাড়ির বড় গৃহিণী, কনিষ্ঠা গৃহিণী মিলে হাসিমুখে কুলোয় করে সেই ‘পাব্বনি’ ঢেলে দিতেন আগন্তুকদের কোঁচড়ে। পুরনো চেনাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হত। সেই পর্ব চলত রাত অন্তত আটটা পর্যন্ত, তার পর বন্ধ হত বাড়ির খিড়কি। এই ‘পাব্বনি নেওয়া’র দল যদি কোনও বাড়িতে না যায়, তা ছিল এক রকম সামাজিক অসম্মান। আগের বছরগৃহস্থের তরফে কোনও বিরক্তি প্রকাশ, বা অন্য কোনও ত্রুটির কারণে সেই ‘বয়কট’ অবশ্য ঘটত খুবই কম। তবু সব গৃহিণীই নিজেদের উত্তরাধিকারিণীদের সতর্ক করে রাখতেন— এমনকি যদি অসুবিধা হয়, তা হলেও প্রকাশ না করতে। সেই শহরে আসা কাজেই ‘পাব্বনি নেওয়া’ চলত একাদশী অবধিই, যদিও পরের দু’দিনে কমে যেত। দশমীর দিনই মোটামুটি সব প্রতিমা ভাসান হত, বাকি কেবল জেলেপাড়া। জেলেপাড়ার ঠাকুর যাবেন সকলের শেষে, একাদশীতে। সবচেয়ে বেশি ধুমধামে পাড়া কাঁপিয়ে।
তার পর শহর খালি।
অনেক অবাঙালি ব্যবসায়ী পরিবারের তিন-চার প্রজন্মের বাস ছিল শহরে, তাই দীপাবলির উৎসবে শহরটার চেহারা একেবারে পাল্টে যেত। বাজারের একটা বড় এলাকা সে দিন এমন আশ্চর্য সাজে সেজে উঠত, যেন ওটা আমাদের সারা বছরের চেনা সেই শহরই নয়।
সে এক অন্য বৃত্তান্ত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)