E-Paper

২০২৪: শেষ সতর্কবার্তা

২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়কাল পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত, যার মধ্যেও ২০২৪ ছিল উষ্ণতম।

আদিত্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৫ ০৫:৫২

এক অতি বিপজ্জনক সীমারেখা অতিক্রম করল বিশ্ব। ২০২৪ সালে দুনিয়ার গড় তাপমাত্রা প্রাক্-শিল্পবিপ্লব যুগের স্তরের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হিসাবে নথিবদ্ধ হল। তাপমাত্রার এই স্তরটির গুরুত্ব বিপুল— এটিই সেই তাপমাত্রা, দীর্ঘ দিন ধরে যাকে সেই সঙ্কটকালের সূচনা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে, যার পর থেকে পৃথিবী ধীরে ধীরে মানুষ এবং বেশির ভাগ প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০ সালের মৌলিক সময়সীমার তুলনায় প্রায় ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল, যা এটিকে ইতিহাসের উষ্ণতম বছর করেছে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়কাল পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত, যার মধ্যেও ২০২৪ ছিল উষ্ণতম। যদিও একটি বছর ১.৫ ডিগ্রির সীমা অতিক্রম করা মানে এই নয় যে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা স্থায়ী ভাবে এই স্তরের উপরে পৌঁছে গিয়েছে— সে কথা নিশ্চিত ভাবে বলার জন্য কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ বছরের গড় প্রয়োজন। তবে ২০২৪ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, এই বিপর্যয় আর সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত নয়, বরং পথ পরিবর্তনের জন্য খুব সামান্য সময়ই আমাদের হাতে রয়েছে। কারণ, এর আগে পূর্বাভাস ছিল যে, ২০৩০ সালের আগে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা এই সীমা অতিক্রম করবে না— কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে ছয় বছর আগেই ঘটনাটি ঘটে গেল, যাকে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস বলেছেন ‘ক্লাইমেট ব্রেকডাউন’।

এই সঙ্কটের সন্ধিক্ষণে দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ হল বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান। পৃথিবীর সমস্ত দক্ষিণপন্থী নেতা প্রকাশ্যে আর জোর গলায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা থেকে সরে আসার আশ্বাস দিচ্ছেন। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দখল নিয়েছেন; ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দক্ষিণপন্থী নেতারা ক্ষমতায় আসছেন বা আসার খুব কাছাকাছি রয়েছেন। এই রাজনৈতিক মতাদর্শগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, তারা জলবায়ু নীতির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের প্রচেষ্টার ঘোর বিরোধী। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থব্যবস্থাগুলিতে দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান জলবায়ু পরিবর্তন রোধের প্রচেষ্টাকে পিছিয়ে দিতে পারে, এমনকি তা পুরোপুরি বন্ধও করে দিতে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প আগের দফায় আমেরিকাকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বার করে এনেছিলেন। তাঁর রাজনীতি মূলত জলবায়ু নীতিগুলিকে দুর্বল করার দিকে কেন্দ্রীভূত। এ বার তিনি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-র জলবায়ু গবেষণার তহবিল কমাচ্ছেন, বিপুল কর্মী ও তহবিল ছাঁটাই করেছেন সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) থেকে। পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সিকে দুর্বল করছেন; এবং তেল ও গ্যাসের উত্তোলন আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। আমেরিকার সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের দায়ভার বার বার চিনের উপরে চাপানোর চেষ্টা করলেও, ২০২৩ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ছিল ১৭.২ টন, যেখানে চিনের ছিল ৯.৮ টন। যদিও বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু নির্গমনকারী মূলত আরব দেশগুলি, কিন্তু তাদের জনসংখ্যা তুলনামূলক ভাবে খুবই কম।

ইউরোপেও দক্ষিণপন্থীদের জয়ধ্বজা উড়ছে। জার্মানির সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে সে দেশের দক্ষিণপন্থী দল ২০% ভোট পেয়েছে, যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে সর্বোচ্চ, আর গত বারের দ্বিগুণ। জার্মানি গত কয়েক দশক ধরে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির গবেষণায় অগ্রণী দেশ ছিল, কিন্তু দক্ষিণপন্থী অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড বা এএফডি দলের উত্থান তার ভবিষ্যৎকে সঙ্কটসঙ্কুল করে তুলতে পারে। এই দলটি জোরদার ভাবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে, সৌর আর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করার দাবি তুলছে, এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল করছে। যদি এএফডি আরও ক্ষমতা অর্জন করে, তা হলে জার্মানির পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সংক্রান্ত গবেষণা আর প্রযুক্তি নির্মাণ বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার প্রভাব পড়বে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে।

ভারতেও কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে জলবায়ু সংরক্ষণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলাফল? ২০২৩ সালে বিশ্বের ১০০টি সবচেয়ে দূষিত (বাতাস) শহরের মধ্যে ৮৩টি ছিল ভারতে। সাতটি পাকিস্তান আর বাংলাদেশে। মজার বিষয়, দিল্লি বাদ দিলে এই তালিকাতে ভারতের আর কোনও বড় শহর নেই। দক্ষিণ ভারতের মাত্র তিন-চারটি শহর রয়েছে। এই দূষিত শহরগুলির অধিকাংশই ছোট শহর, এবং আধা-গ্রামীণ অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে শিল্পের জন্য বিশেষ কর ও দূষণ ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিল্পোন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে আর পুঁজিপতিদের সুবিধা পাইয়ে দিতে পরিবেশগত বিধিনিষেধ শিথিল করার ফলে ইতিমধ্যেই ছোট আর মাঝারি শহরগুলিতে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটে চলেছে, যার ফল ভয়ঙ্কর বায়ুদূষণ এবং তীব্র জলসঙ্কট, যার মোকাবিলায় কোনও রকম জরুরি পদক্ষেপ করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে যে দেশগুলির উপরে, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। এর প্রধান কারণ হল ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান— এটি ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাবের শিকার হবে। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই জলবায়ু-সংবেদনশীল জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ অবস্থানগত, জীবিকাগত বা অন্যান্য কারণে যাঁদের উপরে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রভাব পড়ে— প্রায় ৭০ কোটি মানুষ, যা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ। চরম উষ্ণতা ইতিমধ্যেই দেশের কিছু অংশকে বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলেছে; অনিয়মিত বর্ষা আরও ১০০ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করছে। উপকূলীয় অঞ্চল বা উচ্চ পার্বত্য এলাকার মতো প্রতিবেশ-ব্যবস্থায় দুর্যোগের ঘটনা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস, আকস্মিক বন্যা ইত্যাদি। পাশাপাশি, ধীরগতির পরিবেশগত পরিবর্তনও ঘটছে, যেমন মশাবাহিত রোগের বিস্তার, মাটির উর্বরতা ও জলের গুণগত মানের অবনতি, জলসঙ্কট, নগর এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব এবং প্রাণঘাতী বায়ুদূষণ, যা ভবিষ্যতের আরও ভয়াবহ পরিণতির পূর্বাভাস।

প্রসঙ্গত, ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে কেরল ব্যতিক্রমী। ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত নীতি আয়োগের সাসটেনেব্‌ল ডেভলপমেন্ট গোলস বা এসডিজি-র সূচকে শীর্ষে থেকেছে রাজ্যটি। কেরল দীর্ঘ দিন ধরে সমাজ ও পরিবেশগত ক্ষেত্রে অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যের তুলনায় ভাল ফলাফল করে। এই রাজ্য বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা, জনগণ-নেতৃত্বাধীন সংরক্ষণ কার্যক্রম এবং শক্তিশালী জলবায়ু অভিযোজন কৌশল বাস্তবায়ন করেছে। যদিও এই সূচক নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, বিশেষত এটির পদ্ধতিগত সমস্যা নিয়ে, তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, উত্তর ভারতের চেয়ে কেরলের পরিবেশ সচেতনতা ও জ্ঞান অনেকটাই বেশি।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ এড়ানোর শেষ সুযোগ এখনই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি এখন থেকে পৃথিবীব্যাপী জোরালো ‘কার্বন নিঃসরণ হ্রাস নীতি’ গ্রহণ করা হয়, তা হলে বিশ্বের উষ্ণতা ‘প্রাক্‌-শিল্পবিপ্লব যুগের চেয়ে দু’ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি’ স্তরের চেয়ে নীচে রাখা হয়তো সম্ভব হবে। তবে যদি দক্ষিণপন্থী সরকারগুলির কারণে জলবায়ু নীতি আরও দুর্বল হয়ে যায়, তা হলে ২.৭ ডিগ্রি বা তারও বেশি উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে, যা পৃথিবীতে আরও বেশি তাপপ্রবাহ, বন্যা, খাদ্যসঙ্কট এবং জনবসতি ধ্বংসের কারণ হবে। বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান এবং জলবায়ু সঙ্কট সম্বন্ধে তাদের অবস্থান বিশ্ব উষ্ণায়ন আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। ২০২৪ আমাদের জন্য সেই অমোঘ সতর্কবার্তা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Right Wings Climate

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy