কথা তবু থেকে যায় কথার মনেই/ কঠোর বিকল্পের পরিশ্রম নেই (‘বিকল্প’/ শঙ্খ ঘোষ)। হাওয়ায় উড়তে থাকে কিছু কথা, দীর্ঘকাল বাতাসে উড্ডীন থাকার পর যেমন থিতিয়ে আসে ধূলিকণা, তেমনই সেই সব কথাও ক্রমে ক্রমে জনমানসে বিশ্বাসরূপে প্রোথিত হয়ে যায় এক সময়। তার পর সত্য আর গুজবকে এক সময় আলাদা করা যায় না আর। নাৎসি জার্মানির প্রচারমন্ত্রী গ্যোয়েবলস-এর কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া সেই নীতির কথা আমরা সবাই জানি— একই কথা, তা যদি অসত্যও হয়, বারংবার প্রচার করলে কালক্রমে তাই প্রতিষ্ঠা পায়। মানুষ যা বিশ্বাস করেন সেটাই আসলে সত্যি। কিংবা জনপ্রিয় বাংলা গানের কলির মতো— আসলে সত্যি বলে সত্যিই কিছু নেই।
গুজবকে ভাসিয়ে দিয়ে তাকে ধীরে ধীরে সত্যির চেহারা দেওয়া যেমন রাজনীতির চিরকালীন অস্ত্র, তেমনই শাসক তথা প্রতিষ্ঠান সেই অস্ত্রের ব্যবহার যে কিছুটা বিপ্রতীপ দিক থেকেও করে ফেলতে পারে সে সম্ভাবনাও এই পোস্ট-ট্রুথের যুগে অসম্ভবপর নয়। যেমন, হয়তো জনমানসে প্রোথিত হয়েছে ঠিক ধারণাটাই, কিন্তু সত্যিটাকে সত্যি হিসাবে জনসাধারণ বুঝে ফেলতে পারলে শাসকের গভীর অস্বস্তি স্বাভাবিক। তখন, সে উল্টো পথে প্রাণপণ রটিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় থাকে যে, যা সত্যি বলে ভাবছ তা-ই আসলে গুজব। যা দেখছ তা আসলে দেখছ না। এই সম্ভাবনার কথা মনে এল আমাদের এই পোড়া রাজ্যটির সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবতে গিয়ে।
সাম্প্রতিক কিছু বছরেই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গনে, বিশেষত স্কুলশিক্ষায় যে অবহেলা ও এলোমেলো নিয়মনীতি লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে একটা ইঙ্গিত যেন স্পষ্ট, সরকার আর শিক্ষাব্যবস্থার বিপুল ভার বহন করতে ইচ্ছুক নয়। কথাটা মনে আসামাত্র শিরদাঁড়া দিয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। শুনতে যত হৃদয়বিদারক, হাটে-বাজারে-তর্কে উচ্চারিত হয় যত না সহজে, কথাটির ব্যাপ্তি আসলে তার চেয়ে ঢের বেশি গভীর ও মারাত্মক। কিছু কাল আগেও কলকাতা এবং দু’-একটি জেলাশহরের দু’-একটি বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বাদ দিলে প্রায় সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থাটাই ছিল সরকারি এবং সরকার পোষিত বিদ্যালয়-নির্ভর। তা হলে গত দশ-পনেরো বছরে কী এমন ঘটল যে এমন ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল চতুর্দিকে?
সে সন্ধানে প্রবেশের আগে মনে রাখা দরকার, এখনও বেশ কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অংশীদার, এখনও বিরাজমান আস্ত একটা শিক্ষা দফতর, তার বহুস্তরীয় আমলা ও কর্তাব্যক্তি, সম্পূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রক। এখনও স্বল্প আয়ের পরিবারের কাছে কিংবা দূরান্তের গ্রাম-মফস্সলে, পুরুলিয়া, সুন্দরবনে, চিকেন’স নেক কিংবা ভুটান সীমান্তের জনপদগুলিতে সরকারি স্কুলই একমাত্র দিশা। একটি কন্যাশ্রী প্রকল্প কিংবা ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল প্রদান দেখে যদি ধারণা করার ইচ্ছে হয় যে, সরকার স্কুলশিক্ষার উন্নতির জন্য সচেষ্ট, তা হলে ধোঁকা খেতে হবে। ক্রমশই দেখা যায় যে এত জায়গায় গন্ডগোল, অসুখ এত বিস্তৃত এবং তা সারানোর সদিচ্ছায় এতটাই ঘাটতি যে, এই সব ভাতার সুফল উবে তো যায়ই, সামগ্রিক ভাবেই ব্যবস্থাটা উদ্বায়ী হয়ে ওঠার দিকে অগ্রসর হতে থাকে দ্রুত। সিলেবাস বদল নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু যা কিছু অতিপ্রয়োজনীয় ও ফলদায়ী সেই সমস্তকেই কেবল আগের জমানার তালিকাভুক্ত বলেই বাতিল করা কি খুব যৌক্তিক? এই নিবন্ধের লেখক নিজে বিদ্যালয় স্তরে ইংরেজির শিক্ষক বলে ইংরেজির সিলেবাস নিয়ে দু’-চার কথা বলার কিছুটা হকদার।
‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’-র ইংরেজি ‘হোয়্যার দ্য মাইন্ড ইজ় উইদাউট ফিয়ার’, রবীন্দ্রনাথের এই অসামান্য কবিতাটি উগ্র-জাতীয়তাবাদের বিপদ এবং মুক্তচিন্তার তাৎপর্যকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য একটি চমৎকার আবশ্যিক টেক্সট। আজকের এই চড়াদাগের দেশপ্রেমের ঝনঝনানি (যার মধ্যে দেশের মানুষকে প্রকৃত ভালবাসার কথাটিই অনুপস্থিত) এবং বিভাজনের বিষবাষ্পের দিনকালে, ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীদের মনটিকে সম্যক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই কবিতাটির চেয়ে উপযুক্ত ‘টুল’ কমই পাওয়া যাবে। সেই কবিতা বাদ তো পড়লই, উপরন্তু প্রায় দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজি-বি পাঠ্যসূচিতে রইল না রবীন্দ্রনাথের একটিও টেক্সট। অতি সম্প্রতি সিলেবাস বদলানো হল আবার, এবং তার পর বদল হতে থাকল ঘনঘন, সেই ভাঙাগড়া বোধকরি ‘চলছে-চলবে’ মোডেই থাকবে এখন। কোনও কোনও টেক্সট সিলেবাসে এল, পড়ার আগেই তা ফের বাদ চলে গেল, আবার নতুন টেক্সট পুস্তিকা আকারে ছাপিয়ে সাপ্লিমেন্ট আকারে দেওয়া হল, শেষ মুহূর্তে র্যাপিড রিডার বইতে জুড়ে দেওয়া হল এক পিস রবীন্দ্রনাথ, ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস শুরু হওয়ার পরও বেশ কিছু কাল অবধি বই হাতে দেওয়া গেল না, এক বার দিয়েও ফিরিয়ে নিতে হল। বেশ একটা জাগলিং খেলার মতো বোধ হতে থাকল ব্যাপারটা।
উক্ত র্যাপিড রিডার বইটি হাতে নিলে, তার প্রচ্ছদ দেখে অবশ্য চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। বইয়ের ভিতরে গল্পাকারে থাকা ওথেলো নাটকের একটি চিত্রায়ণ রয়েছে প্রচ্ছদে, কেবল শেক্সপিয়রের রচনাকে বদলে ফেলা হয়েছে খানিকটা, ছবিতে দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ ওথেলো গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করছে শ্বেতাঙ্গিনী ডেসডিমোনাকে। অথচ নাটকে শেক্সপিয়র দেখিয়েছিলেন অন্য রকম— নায়িকাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল মুখ্যচরিত্র ওথেলো! এই ধরনের অমনোযোগ কল্পনা করতেও কষ্ট হয়, তবে একে সামগ্রিক ঔদাসীন্য এবং হঠকারিতার রূপক হিসাবে ধরে নিলে মন্দ হয় না!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)