Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Year Ender 2023

২০২৩: ভিড়ের মাঝেও যে মুখের ছবি তাড়া করে ফিরছে

প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। কিন্তু সেই মুখ ভুলতে পারছে না, পাপোশের মতো ব্যবহার-করা কম্বল ধুয়ে আনার হুকুম দিয়েছিল এক দাগি আসামী। ভুলতে পারছে না ‘মাস্টারমশাই’-দের লক্ষ্য করে সহবন্দিদের টিকাটিপ্পনি।

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:০০
Share: Save:

হিজিবিজি ছবি সাজিয়ে বসে আছি। একটা আস্ত বছর চলে গেল! বহতা নদীর মতো। এলোমেলো বাতাসের মতো। প্রাচীন টেপ রেকর্ডারের মতো জীবনের স্পুল ঘুরিয়ে চলে-যাওয়া সময়টাকে পিছনে নিয়ে গিয়ে দেখছি, এই শেষবেলায় এসে কোন ছবিটা মনে থেকে গেল। চোখ বুজলে কাদের মুখ সরে সরে যাচ্ছে বায়োস্কোপের স্লাইডের মতো। আর কোন ছবিটা যেতে চাইছে না কিছুতেই!

২০২৩ সালে কারা সবচেয়ে বেশি আলোচিত বাংলা এবং বাঙালি পরিসরে? ভাল-মন্দে মিলিয়ে-মিশিয়ে কাদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছি, কাদের নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা? মহুয়া মৈত্র? মহম্মদ শামি? সুচেতন ভট্টাচার্য? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? ঐহিকা মুখোপাধ্যায়? জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক? সুব্রত রায়? নাকি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়?

ভেবে দেখার মতো।

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

২০২৩ সালে আলোচিত বাঙালিদের মধ্যে উপরের দিকেই থাকবেন মহুয়া মৈত্র। পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডি অতিক্রম করে সারা দেশে আলোচিত তিনি। এমনকি, আপাত-উন্নাসিক ইংরেজরাও বিলেতের খবরের কাগজে তাঁকে নিয়ে একাধিক নিবন্ধ লিখেছে (অবশ্য বন্যেরা যেমন বনে সুন্দর, মহুয়া তেমনই ইংরেজি পরিসরে)। তাঁর মোদী এবং আদানির বিরোধিতা, বেঢপ রোদচশমা, হাতে ঝোলানো বিদেশি ব্র্যান্ডের ভ্যানিটি ব্যাগ, কপালের টিপ থেকে শুরু করে প্রাক্তন বান্ধব, তাঁর পোষ্য রটওয়েলার, শিল্পপতি বন্ধু, সংসদের পোর্টালে তাঁর লগ-ইন পাসওয়ার্ড, এথিক্স কমিটি থেকে তাঁর উচ্চকিত ওয়াক-আউট এবং অতঃপর সংসদ থেকে বহিষ্কার— চলে-যাওয়া বছরে যে সমস্ত রাজনীতিককে আতশকাচের তলায় সবচেয়ে বেশি পড়তে হয়েছে, মহুয়া তাঁদের অন্যতম। তিনি যে ভাষায় বেশি স্বচ্ছন্দ, তাতে বলতে গেলে, ২০২৩ সালে ‘শি হ্যাড অ্যারাইভড!’ করিমপুরের বিধায়ক থেকে কৃষ্ণনগরের সাংসদ হয়েছেন বটে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে দেশের রাজনীতি এতখানি উথালপাথাল হবে বলে তিনি নিজেও কি ভেবেছিলেন? হয়তো চেয়েছিলেন। কিন্তু ভেবেছিলেন কি? কিন্তু যেটা বলার, রাজনীতির কুম্ভীপাকে পড়েও রাষ্ট্রের চাপে দমে যাননি। ব্যক্তিগত জীবন এবং যাপনকে রাজনীতির পরিসরে টেনে এনে আলোচনা হলেও সিঁটিয়ে যাননি।

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

মহুয়ার মতোই তাঁরও ব্যক্তিজীবন নিয়ে মুচমুচে আলোচনা হয়েছিল। হয়। ভবিষ্যতেও হবে (সেটা অবশ্য যে কোনও সফল মানুষের ক্ষেত্রেই হয়েছে, হয় এবং হবে)। কিন্তু ২০২৩ সালে বাংলার মহম্মদ শামি ভারতের ক্রিকেটাকাশে ধুমকেতুর মতো পুনরুত্থিত হয়েছেন। জনৈক তারকা অলরাউন্ডার গোড়ালির চোটে দল থেকে ছিটকে না-গেলে বিশ্বকাপের প্রথম একাদশেই আসা হত না তাঁর। শামি সেই নিছক ঘটনাচক্রের ‘আগমন’কে অধ্যবসায়, অনুশীলন এবং একমুখিতা দিয়ে ‘আবির্ভাব’-এ রূপান্তরিত করেছেন। সেই রূপান্তর বছরের শেষে এসে এক রূপকথার মতোই লাগে বৈকি!

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

তবে ২০২৩ সালে রূপান্তরের যে আখ্যান সবচেয়ে তীব্র অভিঘাত তৈরি করেছিল বাঙালির সমাজজীবনে, তা দৈহিক। যে লিঙ্গপরিচয় মনের আয়নায় আজন্ম প্রতিফলিত, পরিণত বয়সে এসে তাকে সর্বসমক্ষে জানান দেওয়া মুখের কথা নয়। তা আরও কঠিন হয় যদি সেই রূপান্তরকামী হন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সন্তান। আরও আরও কঠিন হয়, যদি সেই মুখ্যমন্ত্রী হন সিপিএম নামক একটি গোঁড়া, কট্টর, সন্দেহপ্রবণ এবং নিজেদের গোষ্ঠী এবং গোত্রের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের সংবেদনশীল দলের শীর্ষনেতা। সুচেতন (আগে ছিলেন ‘সুচেতনা’) ভট্টাচার্য সেই বিরল সাহস দেখিয়েছেন। এবং সবচেয়ে বড় কথা, তিনি খুব খোলাখুলি জানিয়েছেন, তাঁর বাবা (বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) প্রথম থেকেই বিষয়টি জানতেন। তিনি তাঁর সন্তানের মুখ চেপে ধরার কোনও চেষ্টা করেননি। পরিবার, পরিজন, রাজনীতি এবং সমাজকে কার্যত অগ্রাহ্য করেই সুচেতন তাঁর যৌনচেতনার কথা প্রকাশ্যে বলার সৎসাহস দেখিয়েছেন এবং চরাচরে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন। পারিবারিক পরিচয়ের কথা ভাবলে সুচেতনের সাহস বাঙালি সমাজে বিরল তো বটেই, অদৃষ্টপূর্ব!

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

পারিবারিক পরিচয়কে ছাপিয়ে আরও একজন নিজের রাজনৈতিক যাত্রা নিজে লেখা শুরু করেছেন ২০২৩ সালে। তিনি বাংলার শাসকদলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। দলের যুব সভাপতিও ছিলেন। ২০২১ সালে তাঁকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়ে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকেই দলের অন্দরে ‘সংস্কার অভিযান’ শুরু করেছিলেন অভিষেক। সেই প্রয়াস নিয়ে শাসক শিবিরের অন্দরে মন্থন এখনও অব্যাহত। কিন্তু চলে-যাওয়া বছরে ‘ভাইপো’ পরিচয়ের বেড়া ডিঙিয়ে গিয়েছেন অভিষেক। কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে বকেয়া অর্থের দাবিতে বিজেপি-বিরোধী যে রাজনৈতিক আখ্যান নির্মাণ তিনি শুরু করেছিলেন বছরের দ্বিতীয় মাসে, তা তাঁর ‘নবজোয়ার যাত্রা’ হয়ে দিল্লির রাজপথ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ২০২৩ সালের অভিষেক নিজস্ব ঘেরাটোপ থেকে বাইরে বেরিয়ে-আসা নেতা। দিল্লির রাজঘাট এবং যন্তর মন্তরে ধর্না-অবস্থানের পরে কলকাতার রাজভবনের অদূরে টানা ধর্না— তৃণমূলের অন্দরে অভিষেককে নেতা হিসেবে যেমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, তেমনই শহুরে জনতার বড় অংশের কাছে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ, দৃঢ়চিত্ত বক্তব্য এবং তারুণ্যের তেজ। তৃণমূলের অন্দরে তো বটেই, দলের বাইরের রাজনৈতিক পরিসরেও অভিষেক ঈপ্সিত অভিঘাত তৈরি করতে পেরেছেন।

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

যেমন খেলাধুলোয় অভিঘাত তৈরি করেছেন নৈহাটির ছাব্বিশ বছরের কন্যা ঐহিকা মুখোপাধ্যায়। ২০২৩ সালে এশিয়াডে ব্রোঞ্জ জিতেছেন টেবিল টেনিস ডাবল্‌সে। ‘অর্জুন’ পুরস্কারের জন্যও তাঁর নাম মনোনীত হয়েছে। ঐহিকার জন্যই কি বাংলা দেখল, টেবিল টেনিসে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যগত এবং একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন গিয়াছে?

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

২০২২ সাল যদি হয়ে থাকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত, তা হলে ২০২৩ তাঁর সহকর্মী জ্যোতিপ্রিয় ‘বালু’ মল্লিকের। তৃণমূল শুরুর সময়ের কারিগর জ্যোতিপ্রিয় সম্পূর্ণ ভুল কারণে আলোচনায় রইলেন। ২০১১ সালে ‘পরিবর্তন’-এর সময় থেকেই তিনি রাজ্যের মন্ত্রী। দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর ‘আস্থাভাজন’ও বটে। কিন্তু রেশন দুর্নীতির চোরাগলিতে তাঁকে ধরে ফেলল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। তখনই জানা গেল, রক্তে অতিরিক্ত শর্করার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে আইন এবং অ্যাকাউন্ট-বহির্ভূত অর্থও জমিয়ে ফেলেছেন জ্যোতিপ্রিয়। এমনিতে খুবই মাটির কাছাকাছি থাকা রাজনীতিক। কিন্তু ২০২৩ সাল-উত্তর বাংলার রাজনীতি তাঁকে একটু অকরুণ দৃষ্টিতেই দেখবে। ২০২৩ সাল কি তাঁর বিদায়ের বছর হয়ে রইল? জ্যোতিপ্রিয় কি পাকাপাকি ভাবে অন্তরালেই চলে গেলেন?

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

যেমন দীর্ঘ দিন রোগজ্বালায় জর্জরিত হয়ে সুব্রত রায় চলে গেলেন লোকান্তরে। কিন্তু এমন নিশ্চুপে বিদায় কি তাঁর প্রাপ্য ছিল? উত্তরপ্রদেশের এই বাঙালি জায়গা পেয়েছেন নেটফ্লিক্সের সাম্প্রতিক সিরিজ়ে। খুব ভাল কারণে নয় যদিও। বিজয় মাল্য এবং নীরব মোদীর সঙ্গে তাঁকে একই বন্ধনীতে রেখেছে ‘ব্যাডবয় বিলিওনিয়ার’ সিরিজ়। সেই জীবনীনির্ভর নাট্যে তিন ভারতীয় ‘দুষ্টু’ লোকের এক জন তিনি। একটি ল্যামব্রেটা স্কুটার এবং চেয়ার-টেবিল নিয়ে ব্যবসা শুরু করে সহারার যে সাম্রাজ্য তিনি গড়েছিলেন, তার সিংদরজার বাইরে লাইন দিতেন দেশের তাবড় খ্যাতনামীরা। ক্রিকেটার থেকে ফিল্মস্টার। সচিন তেন্ডুলকর থেকে অমিতাভ বচ্চন। পুণেতে নিজের নামে স্টেডিয়ামও তৈরি করেছিলেন সুব্রত। বিখ্যাত হওয়ার, সর্বেসর্বা হওয়ার কী দুর্মর আকাঙ্ক্ষা! অথচ কী অদ্ভুত চুপিচুপি এবং প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে তাঁর জীবন থেকে প্রস্থান! ২০২৩ সাল ‘সহারাশ্রী’কে মুছে ফেলল জগৎ থেকে।

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। শুধুমাত্র একটি বিবাহ করার ‘দায়ে’ বাঙালি তাঁকে নিয়ে যা আলোচনা (সমালোচনামূলক কটূক্তি বলাই ঠিক হবে) করল এবং যে ভাষায়, তাতে সেরা সময়ের ‘শনিবারের চিঠি’কেও বেবিফুড-পোষ্য মনে হয়েছে। পরমের ‘অপরাধ’ কী? না, তিনি বাংলার এক খ্যাতনামীর প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে প্রণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং সেই প্রণয়কে পরিণয়ে পরিণতি দিয়েছেন। বেশ করেছেন! পরম বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন। পরিচালনাও করেন। হিন্দিতেও অভিনয় করেছেন। খুব খারাপ করেছেন, এমন কেউ বলেছেন বলে শুনিনি। পরম নিজ পরিশ্রম এবং নিজ অধিকারে মাপমতো সফল। সম্ভবত সেই কারণেই বাঙালি জ্যাঠামশাইদের তাঁর উপর এত ক্রোধ। যে কদর্য ভাষায় পরমকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণ করা হয়েছে, তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরে অনধিকার প্রবেশ করে তাঁর জীবন এবং যাপনকে দু’পায়ে মাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে, তার নজির সাম্প্রতিক অতীতে নেই। আমরা ঠিক কতটা নীচে নামার ক্ষমতা রাখি, ২০২৩ সাল ‘পরম-যত্নে’ সেটাও দেখিয়ে দিয়ে গেল।

The faces of Bengal in 2023 & the unemployed youth released on bail from Jail Custody

তবু, তবুও এই সব ছবির ভিড়ে সকলকে ছাপিয়ে যে মুখটি অহরহ তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সেটি বেলঘরিয়ার বাসিন্দা এক বত্রিশের যুবকের। পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর এবং গৃহবধূর মধ্যবিত্ত সংসারের সন্তান। পদার্থবিদ্যায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ২০১৩ সালে গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকে প্রাইভেট টিউশন করেন এ দিক-ও দিক। সরকারি আপার প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরিপ্রার্থী। বছরশেষে যাঁকে কালীঘাটের এক রাস্তা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। চার দিন জেলে কাটিয়ে জামিন পাওয়ার পরে আলিপুর আদালতের চত্বরে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর তিন সঙ্গীর সঙ্গে। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। কাচের ও পারের চোখ ছলছল। ক্যামেরার সামনে যিনি হাতজোড় করে বলছিলেন, ‘‘আমি ভগবানে খুব বিশ্বাস করি। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের সকলকে বলি ভগবানে বিশ্বাস রাখতে। আর আমার সঙ্গেই এমন হল? আমি তো কিছু করিনি! আমি তো শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়েরা চাকরি চেয়ে আন্দোলন করতে গিয়েছিল। আমরা কয়েক জনও গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা তো আন্দোলন করতে যাইনি। আমরা গিয়েছিলাম মেয়েদের ফিরতে যদি রাত হয়ে যায়, ওর যদি কোনও বিপদে-আপদে পড়ে, সেই জন্য। আমাদের তো কোনও দোষ ছিল না!’’

সেই মুখ চ্যানেলের স্টুডিয়োয় বসে স্ক্রিনের অন্য উইন্ডোয় মাকে দেখে আর্তনাদের মতো ডাকতে থাকে, ‘‘মা! ও মা! তোমরা ঠিক আছ তো? বাবা ঠিকমতো ওষুধ খেয়েছে তো?’’

প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। কিন্তু জেলের রাতটা ভুলতে পারছে না সেই মুখ। ভুলতে পারছে না, পাপোশের মতো ব্যবহার-করা কম্বল ধুয়ে আনার হুকুম দিয়েছিল এক দাগি আসামী। সেই মুখ ভুলতে পারছে না ‘মাস্টারমশাই’-দের লক্ষ্য করে সহবন্দিদের টিকাটিপ্পনি। ঈষৎ কম্পিত গলায় সেই মুখ বলছিল, ‘‘আমি ভিতু নই। কিন্তু ওই জায়গাটা ভয়ের। তাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’’ বলছে, ‘‘বাড়ি ফেরার পরে বাবা একটু বকুনি দিয়েছেন। উনি বলেছিলেন, এ সব ঝামেলায় না-যেতে।’’

সেই মুখ কি আর যাবে আন্দোলন করতে? সেই মুখ থেকে নির্গত কণ্ঠ বলল, ‘‘আন্দোলন নিয়ে আর কিছু ভাবছি না। ট্রমাটা এখনও আছে। কিছুতেই যাচ্ছে না!’’

ফোন ছাড়ার আগে সেই কন্ঠ আকুল প্রশ্ন করল, ‘‘জামিন পেয়েছি ঠিকই। কিন্তু মামলাটা তো চলছে। জীবনে একটা লাল দাগ পড়ে গেল! আচ্ছা, মামলাটা কি সারা জীবন চলবে? ঠিক বুঝতে পারছি না!’’

জবাব দিতে পারিনি। শুনতে শুনতে অন্য সব ছবি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। মুছে যাচ্ছিল। ধুয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, রথচক্র গ্রাস করে নিয়েছে মেদিনী। প্রাণপণ চেষ্টা করছি চাকাটা মাটি থেকে খুঁড়ে তুলতে। পারছি না। অসহায়ের মতো দেখছি, ঘাতক-বাণ শনশন করে বাতাস কাটতে কাটতে ধেয়ে আসছে। সিস্টেমের কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ করছি। নামহীন, গোত্রহীন ছায়ামানব সব আমরা।

সারা বছরের সফল-অসফল, ভাল-মন্দ মুখের ভিড় ছাপিয়ে ক্রমাগত তাড়া করে যাচ্ছিল এক সুকুমার, নাচার, অসহায় মুখের ছবি। মনে হচ্ছিল ওই জোড়হাত, ওই নিরুপায় মুখ বলছে, আমরা আসলে মলিনতার সাধনা করছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE