সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টে চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের হাতে আইনজীবীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আইনজীবী মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আইনজীবীদের যেমন যে কোনও মামলা গ্রহণের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনই যে কোনও অভিযুক্তেরও বিচার পাওয়ার অধিকার সংবিধানসম্মত। দোষী না নির্দোষ, আদালতের বিচারে তা সাব্যস্ত হওয়ার আগেই বলপূর্বক কোনও অভিযুক্তের আইনজীবীকে মামলা থেকে সরতে বাধ্য করা হলে, বা মামলা গ্রহণের কারণে নিগ্রহ করা হলে অভিযুক্তের সুবিচার লাভের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, ক্ষুণ্ণ হয় পেশাজীবীর স্বাধীনতাও।
এই ঘটনায় অনেকে রাজনৈতিক অভিসন্ধির গন্ধ পাচ্ছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক চাকরি হারানোর পর থেকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী-সহ শাসক দলের নেতা-কর্মীরা যে ভাবে বিরোধী দলগুলোকে নিশানা করছেন এবং কয়েকজন আইনজীবীকে ‘চাকরিখেকো’ বলে প্রচার করে আসছেন, আইনজীবীদের উপর আক্রমণ তারই ফল। শিক্ষা দফতরের ভারপ্রাপ্ত প্রাক্তন মন্ত্রী থেকে শুরু করে দফতরের তৎকালীন আমলাকুলের এক বড় অংশ দুর্নীতির দায়ে কারান্তরালে। অনেকেই মনে করছেন, সততার যে বিজ্ঞাপনে ভর করে শাসক দল রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল, তার ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকলেও যোগ্য শিক্ষকদের জীবিকা ও সম্মান রক্ষার্থে মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া ‘প্রকৃত যোগ্য শিক্ষক’ এবং ‘ঘুষের বিনিময়ে চাকরি-ক্রেতা’দের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ করতে পারত। অন্যথায় আদালত যাঁদের ‘নন-টেন্টেড’ বলে স্বীকার করেছে, অন্তত সেই শিক্ষকরা যোগ্য, এমন শংসাপত্র দিলেও অন্যের দুর্নীতির দায়ে নিষ্কলুষদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না। পঠনপাঠনের বিপর্যয় থেকে স্কুলগুলিও বাঁচত।
কিন্তু সে পথে না হেঁটে শুরু থেকেই নিজেদের পাপ আড়াল করতে শাসক দল নানা অসত্য প্রচারে মত্ত। চাকরিহারা শিক্ষকদের পথে নামা ছাড়া কী-ই বা করার ছিল? অথচ, তাঁরা পথে নামলেই সহমর্মিতার পরিবর্তে এসেছে আক্রমণ। কসবা ডিআই অফিসের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুলিশ। বুটের লাথি ও লাঠির আঘাতে আহত হন নিরীহ শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তার ঠিক আগেই মুখ্যমন্ত্রী চাকরিহারাদের নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে আমন্ত্রণ করে কিছু আশ্বাস দিয়েছিলেন। অবশ্য একই সঙ্গে তিনি দোষী ও নির্দোষদের পৃথক তালিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যোগ্যদের স্বার্থরক্ষার চেয়ে অযোগ্যদের চাকরি বাঁচানোর আগ্রহ অনেক বেশি। চাকরিচ্যুত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষাকর্মীদের জন্যে যথাক্রমে পঁচিশ ও কুড়ি হাজার টাকা মাসিক ভাতা প্রদানের ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত সেই অনৈতিক অভিপ্রায়কেই সিলমোহর দিল।
এই পরিস্থিতিতে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের হতাশা ও ক্ষোভ অসঙ্গত নয়। বিশেষত রাজ্য শিক্ষা দফতরের তরফে শিক্ষক নিয়োগের জন্য নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতির কথা জানার পর তাঁদের ফের পথে নামা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু বিকাশ ভবনের গেটে তাঁদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান চলাকালে বিধাননগর পুলিশ শিক্ষক ও সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের যখন নির্বিচারে কিল, চড়, ঘুষি, লাথি মেরে এমনকি হেলমেট দিয়ে আঘাত করল, তখন সেখানে উপস্থিত বিধাননগর পুরনিগমের প্রধান ও পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের নিরস্ত করার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ দেখা যায়নি। উপরন্তু এই আক্রমণে লজ্জিত হওয়া দূরে থাক, মাননীয় জনপ্রতিনিধির ‘বেশ করেছে’, ‘যেমন চারপেয়ে, তেমনই মুগুর’ মন্তব্যে যে নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের বহিঃপ্রকাশ সেটাও যদি স্রেফ ভূমিকা হয়ে থাকে, আসল ব্যাপার শুরু হয় সন্ধে নামতেই: পুলিশের প্রহারে হাত-পা ভেঙে গেল আন্দোলনরত শিক্ষকদের। তাদের ব্যাটনের আঘাতে দৃষ্টি হারাতে চলেছেন কেউ কেউ। ছিন্নভিন্ন পোশাকে রক্তাক্ত শিক্ষকদের কাঁদতে দেখা গেল।
নিজের দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে নিজেকে নিষ্কলুষ জাহির করার রোগটি যে শুধু রাজনীতির কারবারিরাই রপ্ত করেননি, প্রমাণ পাওয়া গেল এই ঘটনায় ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে পুলিশকর্তাদের বক্তব্যে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, সরকারি কাজে বাধাদান-সহ একগুচ্ছ জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে যাবতীয় দায় আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপরে চাপিয়ে তাঁরা যে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ ও ‘ন্যূনতম বলপ্রয়োগ’-এর তত্ত্ব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন, যন্ত্রণা ও অনিশ্চয়তায় দিশাহারা চাকরিহারা শিক্ষকদের পাশাপাশি রাজ্যবাসীর সঙ্গেও সে যে এক চরম রসিকতা, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
হয়তো এক দিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে। হয়তো চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের মধ্যে যথার্থ যোগ্যরা আবার বিদ্যালয়ে ফিরবেন। কিন্তু দুর্নীতির ঘূর্ণিপাকে যে ভাবে তাঁদের সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত হল, কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মনে শিক্ষকদের হেনস্থার যে স্থিরচিত্র প্রোথিত হল, তা মুছবে কিসে? জনমানসে শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে যে অবিশ্বাসের বীজ অঙ্কুরিত হল, তাতে সরকার-পোষিত বিদ্যালয় থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চিরতরে মুখ ফেরানোর শঙ্কাটা কি অমূলক?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)