E-Paper

সুস্থতর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে

প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের মোট উৎপাদন বাড়ছে দ্রুত হারে, সেই পরিবর্তনই সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগুলিকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে।

কৌশিক বসু

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৭

এই লেখাটা লিখছি জয়সলমেরে বসে— চোখের সামনে ঝকঝক করছে সোনার কেল্লা। সব বাঙালির মতো আমারও মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের অবিস্মরণীয় ছবিটির কথা। সোনার কেল্লা-র মুকুল ছিল জাতিস্মর— তার পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ত। আমার মনে পড়ছে পঞ্চাশ বছর আগের পৃথিবীর কথা— আজকে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সে-ও বোধ হয় পূর্বজন্মই। কম্পিউটার সায়েন্স, ডিজিটাল টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি গোটা পৃথিবীকে এমন ভাবে সংযুক্ত করেছে, সত্যজিৎ রায় বা ফেলুদা-তোপসের পক্ষে তা কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল। আজ কর্মীরা বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদে বসে নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনের সংস্থা বা গ্রাহকদের জন্য কাজ করে চলেছেন অবলীলায়। যে কোনও উৎপাদনের জোগানশৃঙ্খল আজ অনেকগুলি দেশে বিস্তৃত— প্রতিটি দেশই উৎপাদন প্রক্রিয়ার কোনও না কোনও উপাদান জুগিয়ে চলেছে, যা শেষ অবধি হয়তো বহু দূরের কোনও দেশের ক্রেতাদের হাতে পৌঁছচ্ছে। এই উন্নতির ফলে দুনিয়ার মোট উৎপাদন বেড়েছে বহু গুণ।

কিন্তু, তাতে এই পৃথিবী আগের চেয়ে একটু ভাল হয়েছে? বিশেষত যদি গত তিন-চার বছরের কথা ভাবি, তা হলে বেশির ভাগ লোকের পক্ষেই এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলা কঠিন হবে। এই সময়কালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে গিয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ— ইউক্রেনে, পশ্চিম এশিয়ায়, সুদানে এবং অন্যত্র— মারা গিয়েছেন অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ, নিহত হয়েছে শিশুরা। আমরা গোটা দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের ক্ষয় দেখছি, সামাজিক মেরুকরণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, পৃথিবী ঘৃণায় ভরে উঠছে। কেন ঘটছে এমন?

নিশ্চিত উত্তর দেওয়া মুশকিল, কিন্তু সমস্যাটা এতই ভয়ঙ্কর যে সম্ভাব্য উত্তরগুলি আমাদের খুঁজতে হবেই। তেমনই একটি সম্ভাবনা হল: যে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের মোট উৎপাদন বাড়ছে দ্রুত হারে, সেই পরিবর্তনই সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগুলিকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে।

গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের পারস্পরিক সম্পর্কের চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই কারণের শিকড়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় অসাম্য থাকা স্বাভাবিক, এবং সেই অসাম্য আর্থিক বৃদ্ধির প্রণোদনা তৈরি করে, বৃদ্ধির সহায়ক হয়। কিন্তু, আজ গোটা দুনিয়া জুড়ে অসাম্য যে স্তরে পৌঁছেছে, তা অসহনীয়। এবং, এই চূড়ান্ত অসাম্যের পাশাপাশি একটি নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে: ডিজিটাল প্রযুক্তির উত্থানের ফলে আর্থিক অসাম্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে।

এই ঘটনাটা বোঝার জন্য মনে রাখতে হবে যে, অমর্ত্য সেন তাঁর বই অন ইকনমিক ইনইকোয়ালিটি-তে দেখিয়েছিলেন, অসাম্যকে অনেক ভাবে পরিমাপ করা সম্ভব। তার মধ্যে একটি পরিমাপ-পদ্ধতিতে দেখা হয়, অতি ধনীদের আয় এবং সম্পদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের আয় এবং সম্পদের ফারাক কতখানি। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, গোটা দুনিয়াতেই এই গোত্রের অসাম্য অত্যন্ত দ্রুত হারে বাড়ছে। এর সঙ্গে সম্ভবত প্রযুক্তিগত উন্নতির একটি সম্পর্ক আছে— যা অতি ধনীদের আরও বেশি ক্ষমতাবান হতে, এবং মোট সম্পদের অধিকতর অংশ দখল করতে সাহায্য করছে।

নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রী জোসেফ স্টিগলিটজ়-এর নেতৃত্বাধীন জি২০-র একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অতি ধনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যবধান অত্যন্ত দ্রুত বেড়েছে। সারা দুনিয়াতেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তবে ভারতে তা অতি প্রকট। এই সময়কালে ভারতে শীর্ষ এক শতাংশ ধনীদের সম্পদ বেড়েছে ৬২%। ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২৬-এর তথ্য অনুসারে, ব্রিটেনের শীর্ষ এক শতাংশ ধনী যেখানে দেশের মোট সম্পদের ২১.৩ শতাংশের অধিকারী, সেখানে ভারতের শীর্ষ এক শতাংশ ধনীর দখলে রয়েছে দেশের ৪০% সম্পদ।

সম্প্রতি আরও একটি ঘটনা ঘটেছে: আর্থিক অসাম্য পরিণত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিসরে কণ্ঠস্বর ও প্রভাবের অসাম্যে। অতীতে ধনীদের বেশি সংখ্যক প্রাসাদ থাকত, অনেক গাড়ি, সোনাদানা থাকত। আজকের অতি ধনীদের সে সব তো আছেই, তার পাশাপাশি তাঁরা কিনে নিতে পারেন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, টেলিভিশন চ্যানেল। এর মাধ্যমে গণপরিসরে আলোচনা ও চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁদের প্রভাব অস্বাভাবিক রকম বেশি হয়ে উঠেছে।

বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে আমরা জানি যে, যখন কোনও গ্রামীণ আলোচনাসভায় স্থানীয় সামন্তপ্রভু উপস্থিত হতেন, তখন সাধারণ মানুষ চুপ করে যেতেন। আজ দুনিয়া জুড়ে এই ঘটনা ঘটে চলেছে। আর্থিক অসাম্যের ফলে মতপ্রকাশের অধিকারের অসাম্য তৈরি হচ্ছে— গণতন্ত্রের পক্ষে যা মারাত্মক। আর্থিক অসাম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি গণতন্ত্রের ক্ষয় ও মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব হওয়া আজকের দুনিয়ার অন্যতম বড় সমস্যা।

অতীতে অসাম্য কমানোর চেষ্টায় কিছু বড় মাপের ভুল হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল এই বিশ্বাস যে, সব কিছুকেই রাষ্ট্রায়ত্ত করে তার পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের হাতে তুলে দেওয়া বিধেয়। সোভিয়েট ইউনিয়নের উদাহরণ থেকে আমরা জানি যে, এতে কত বড় ক্ষতি হতে পারে। এ কথা মনে রাখা জরুরি যে, কোনও দেশের উদ্ভাবনী ক্ষমতা তৈরিতে এবং তার আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে বেসরকারি উদ্যোগগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাজেই, বেসরকারি ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের হাতে আরও ক্ষমতা তুলে দেওয়া কাজের কথা নয়। তার বদলে অতি ধনীদের থেকে চড়া হারে মার্জিনাল ট্যাক্স বা বাড়তি কর আদায় করতে হবে, এবং সেই টাকা সরাসরি দরিদ্র মানুষের মধ্যে বণ্টন করতে হবে।

আমার বই রিজ়ন টু বি হ্যাপি-তে আমি একে ‘অ্যাকর্ডিয়ান’ ট্যাক্স ব্যবস্থা বলেছি। এই ব্যবস্থায় বিত্তের ক্রম অবস্থান পাল্টায় না— অর্থাৎ, কর আরোপের আগে সমাজের সব মানুষকে সবচেয়ে ধনী থেকে সবচেয়ে দরিদ্র হিসাবে এক ক্রমসারণিতে সাজিয়ে নিলে সেখানে যাঁর যা অবস্থান, কর আরোপের পরও সেই অবস্থান পাল্টায় না। কিন্তু, এতে আয় বণ্টনের অসাম্যের পরিমাণ কমে। আরও বেশি বাড়ি বা সোনাদানা অথবা এরোপ্লেন চাই বলে ধনীরা পরিশ্রম করেন না— তাঁরা খাটেন, কারণ তাঁরা নিজেদের প্রতিবেশী বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে ধনী হতে চান। এই অ্যাকর্ডিয়ান কর ব্যবস্থায় সেই প্রণোদনাটি অক্ষুণ্ণ থাকবে।

প্রতিটি দেশের পক্ষেই তীব্র অসাম্য কমানো এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য অনেক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু, আজকের দুনিয়ায় যে-হেতু পুঁজি খুব সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যেতে পারে, তাই কোনও একটি দেশের পক্ষে অসাম্য কমানোর পক্ষে কত দূর যাওয়া সম্ভব, তার একটি সীমা রয়েছে। কাজেই, এক আদর্শ দুনিয়ায় আর্থিক বৈষম্য হ্রাস এবং দরিদ্র মানুষকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করার জন্য একটি বৈশ্বিক নীতি প্রয়োজন— সে দরিদ্র মানুষ যেখানেই থাকুন না কেন। উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে যে অমানবিক আচরণের সাক্ষী থাকছে গোটা দুনিয়া, তা ভয়ঙ্কর রকম অনৈতিক। কোথাও মানুষ কষ্টে থাকলে তাঁর সাহায্য ও সহমর্মিতা প্রয়োজন। তার জন্য সক্রিয়তা চাই। স্টিগলিটজ়-এর নেতৃত্বাধীন জি২০ রিপোর্টেও বলা হয়েছে, দুনিয়া জুড়ে তীব্র অসাম্যের মোকাবিলা করার জন্য বহু দেশকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

এই বৈশ্বিক সমস্যা অবশ্য সহজে মেটার নয়, কারণ রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ এই সমাধানসূত্রের সমানুবর্তী নয়। সাধারণ মানুষকেই সংগঠিত ভাবে দাবি তুলতে হবে সম্মিলিত কর্মসূচির পক্ষে।

জানি, এ সব অবাস্তব স্বপ্নের মতো লাগছে। কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষী যে, এমন বহু পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে, যা ঘটার আগে অবধি অবিশ্বাস্য মনে হত। ইতিহাসের এই সম্ভাবনা থেকেই উদ্বুদ্ধ হতে হবে, আমাদের সেরা প্রতিভাদের একত্রে কাজ করতে হবে এই পৃথিবীকে আরও একটু বাসযোগ্য করে তোলার জন্য। নতুন বছরের সূচনায় আমরা শপথ নিই যে, আমরা নিজেদের মতো করে চেষ্টা করব, যাতে প্রযুক্তি শুধু জিডিপি বাড়ানোর কাজে সহায়ক না হয়ে এই পৃথিবীকে আরও একটু ভাল, আরও ন্যায্য একটি জায়গা করে তুলতে পারে।

ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক; ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারত সরকার

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society Economy Inequality

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy