E-Paper

নিজস্ব এক নীড়

বাংলায় দলিত সাহিত্যের সূত্রপাত মনে করা হয় ১৯৯২-এ চুনি কোটালের আত্মহননের ঘটনার পর থেকে। ১৯৯২-এর সাহিত্য সম্মেলনকেই মূলত বাংলা দলিত সাহিত্যের সূচনা বলে ধরা হয়।

অভিজিৎ হালদার

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৫ ০৫:৫২

বা ‌ংলা দলিত সাহিত্যের শুরু নিয়ে খানিকটা ধোঁয়াশা আজও রয়ে গেছে। বাংলা দলিত সাহিত্যের শুরুর চর্চিত ইতিহাস বলে— ১৯৯৪ সালে সংগঠিত ‘দলিত সাহিত্য সংস্থা’র মুখপত্র হিসাবে চতুর্থ দুনিয়া পত্রিকার প্রকাশই বাংলা দলিত সাহিত্যের শুরু। তবে ইতিহাসের পূর্বধারা অন্য কথা বলবে।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সমগ্র ভারত জুড়ে প্রবল ভাবে ছড়িয়ে পড়ে দলিত সাহিত্যের স্রোত। মহারাষ্ট্রে একের পর এক পত্রপত্রিকা দলিত সাহিত্য আন্দোলনের বীজ বপন করতে শুরু করেছে তত দিনে। সমাজের তথাকথিত ‘পিছিয়ে পড়া’ ‘অস্পৃশ্য বর্গ’ নিজেদের স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনে নেমে পড়ে— আর তার হাতিয়ার হিসাবে প্রকাশ পায় নানা পত্রপত্রিকা। জনতা, আমহী, নিকায়, জাতক, কোনডি, সিংহগর্জন, সুগাবা, দলিতক্রান্তি, সংসদ, সমাজ, বিদ্রোহ, অস্তিত্ব, প্রমেয়, সমুচিত প্রভৃতি পত্রিকার মধ্য দিয়ে মহারাষ্ট্রের দলিতবর্গ গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আন্দোলন শুরু করেন। পরে ১৯৬৭ সালে অস্মিতাদর্শ পত্রিকাকে সামনে রেখে দলিত আন্দোলন স্বীকৃতি পেয়েছিল; এবং তার পর ১৯৭২ দলিত প্যান্থার আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি মহারাষ্ট্রের দলিতদের। স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ভারতীয় দলিত সাহিত্যের পথ।

বাংলায় যে তখনও দলিত সাহিত্যের বীজ বপন একেবারেই হয়নি, তা-ই বা বলা যাবে কী করে! উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে অবিভক্ত বাংলায় তথাকথিত নিম্নবর্গের আন্দোলন স্পষ্ট রূপ পায়। ১৯০৭ সালেই প্রকাশিত হয় বাংলায় নিম্নবর্ণের প্রথম পত্রিকা নমঃশূদ্র সুহৃদ, আদিত্য কুমার চৌধুরীর সম্পাদনায়। তার পর একের পর এক নিম্নবর্ণের পত্রিকা— নমঃশূদ্র দর্পণ (১৯০৯), নমঃশূদ্র দ্বিজ তত্ত্ব (১৯১১), সমাজচিত্র (১৯১৩), তাম্বুলি (১৯১৪), পতাকা (১৯১৪) প্রভৃতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলায় নিম্নবর্ণের আন্দোলন বিস্তৃতি পেয়েছিল। কিন্তু তখনও বাংলায় তথাকথিত ‘দলিত’ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়নি; ‘দলিত’ শব্দের ছত্রছায়ায় আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। বাংলায় দলিত সাহিত্যের সূত্রপাত মনে করা হয় ১৯৯২-এ চুনি কোটালের আত্মহননের ঘটনার পর থেকে। ১৯৯২-এর সাহিত্য সম্মেলনকেই মূলত বাংলা দলিত সাহিত্যের সূচনা বলে ধরা হয়। তবে সে-ও বা এত নিশ্চিত করে বলা যাবে কী করে, ইতিপূর্বে ১৯৮১ সালে বেঙ্গালুরু থেকে প্রকাশিত দলিত ভয়েস পত্রিকার সূত্র ধরে বাংলায় ১৯৮৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় পত্রিকা দলিত কণ্ঠ, সম্পাদক ছিলেন নকুল মল্লিক। বাংলা দলিত সাহিত্যের প্রকৃত শুরু সম্ভবত এই পত্রিকার হাত ধরেই।

১৯৯২ সালের ৫ ও ৬ ডিসেম্বর প্রথম দলিত সাহিত্য সংস্থার সভা অনুষ্ঠিত হয় নদিয়ার ভায়ানাতে। সভার উদ্বোধক ছিলেন অমলেন্দু দে, সভাপতি জগদ্বন্ধু বিশ্বাস। এই প্রথম ‘বার্ষিক সঙ্গীতি’-র পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লিখেছিলেন যতীন সরকার, দৈনিক ওভারল্যান্ড পত্রিকায় (২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯২)। এই সভাতেই ঠিক করা হয়, প্রতি বছর একটি করে ‘সঙ্গীতি’-র আয়োজন করা হবে। পরের বছর উত্তর চব্বিশ পরগনার হৃদয়পুরে সঙ্গীতি-সভা হয়েছিল। ১৯৯৪-এ হয় হুগলি জেলার খন্যানে, তার পরের বছর মালদহের পাকুয়াহাটে, আর ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রঘুনাথপুর হাই স্কুলে। বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থার মুখপত্র হিসাবে চতুর্থ দুনিয়া পত্রিকার আবির্ভাব এই সময়কালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথম কবে এই পত্রিকার প্রকাশ তা নিয়ে নানা মত রয়েছে; মান্য মত বলে, ১৯৯৪ সালের জুন-জুলাই নাগাদ প্রথম বেরোয় এই পত্রিকা। সঙ্গে এই দাবিও করা হয় যে, এই পত্রিকার হাত ধরেই বাংলা দলিত সাহিত্য নির্মিত হয়েছে।

বলে রাখা ভাল, বাংলায় দলিত সাহিত্য আন্দোলনের আগে যে নিম্নবর্ণের সাহিত্য আন্দোলন হয়েছিল, তার ধারাটি কিন্তু থেমে যায়নি। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক ও তার পরের দিকেও একের পর এক নিম্নবর্ণের পত্রিকা এবং মতুয়া পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, যেমন পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় সমাচার (১৯২৪) (সম্পাদনা: মহেন্দ্রনাথ করণ ও ক্ষীরোদচন্দ্র দাস), সত্যযুগ দীপ্তি (১৯৩০) (সম্পা: সুরেশচন্দ্র বয়াল), সঙ্ঘ (১৯৩৫) (সম্পা: রাজেন্দ্রনাথ সরকার), পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় বান্ধব (১৯৫১) (সম্পা: দিগম্বর সাহিত্যরত্ন), বন্দে মাতরম্ (১৯৬৪) (সম্পা: ভূতনাথ মণি), এখনও সচল পত্রিকা সমাজদর্শন (শুরু ১৯৭০, বর্তমান সম্পাদক শ্যামলকুমার প্রামাণিক) প্রভৃতি।

পত্রিকা আসলে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের স্বপ্ন ও শ্রমের ফসল। তবে দলিতের কাছে তা হাতিয়ারও। দলিত সাহিত্যপত্রিকা মূলত দলিত চেতনাকে প্রসারিত করে, দলিত জীবনের অভিজ্ঞতা, বিদ্রোহ, আত্মপরিচিতির নির্মাণকে প্রতিষ্ঠা দেয়। বাংলায় পুরুষ দলিত সাহিত্যিকদের প্রকাশিত পত্রিকার পাশাপাশি বাঙালি দলিত নারীদের পত্রিকাও সমান ভাবে বাংলার দলিত আন্দোলনের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বাংলা দলিত নারীদের প্রথম পত্রিকা হল নীড়। সম্পাদক কল্যাণী ঠাকুর, সহ-সম্পাদক স্বস্তি আচার্য ও ইন্দ্রাণী দত্ত; প্রথম প্রকাশ ইংরেজি ১৯৯৪ সালে। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “ফুসফুস ভরা হাসির দিন বুঝি ফুরাল! মেকী হাসির দিন পড়েছে। সবই যান্ত্রিক। হাসতে হয় তাই হাসা। ভাল না থাকলেও ভাল আছি বলা। সবকিছু ভুলতে বসেছি। বাস্তবের সাথে লড়তে গিয়ে মানবিক কোমলবৃত্তিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া কিছু কর্মজীবী মেয়ের মানবিক তাগিদে এ পত্রিকার জন্ম— এই শতাব্দীর (১৪০১, ১লা বৈশাখ) প্রারম্ভে। লোনাধরা দেওয়ালে। আমাদের ভবিষ্যৎ যেন এক একাকীত্বের সমাজ। ক্রম বিভাজ্য। এখানে ব্যক্তিত্বের সংঘাত অহরহ। সবসময়ে মেনে নেওয়া দায়।” পত্রিকায় ছিল বিভিন্ন হস্টেলের আবাসিক মেয়েদের লেখা। যে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় প্রথম সংখ্যার শিরোনামপৃষ্ঠা দেখলে।

তৃতীয় সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে লেখা হল: “যাঁদের পাশ কাটিয়ে ইতিহাস রচিত হয়, শতবর্ষ পরে এমন মানুষদের স্মরণ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। সাঁওতাল কবি সাধু রামচাঁদ মুর্মু তাঁদের অন্যতম। নেতাজী সুভাষের মূল্যায়ন হয়েছে তাঁর সহকর্মীর কলমে। শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতৃত্বকেও স্মরণ করা হয়েছে। স্মরণে এসেছে শ্রীমৎ অনির্বাণের মতো পথের টানে ঘর ছাড়া কবিকে! সার্ধ-শতবর্ষে ঠাকুর গুরুচাঁদ ও মৃত্যু-উত্তীর্ণ শতবর্ষে কাঙাল হরিনাথের মতো পুরুষদের স্মরণ করা হয়েছে, যাঁরা মধ্যবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও নারীর মর্যাদা আদায়ের আন্দোলনে লিপ্ত ছিলেন অথচ ইতিহাসে তাঁদের কোনরকম মূল্যায়নই হয়নি। সেই সত্যাবগুণ্ঠিত ইতিহাস রচয়িতাদের উত্তরপ্রজন্ম হয়ে যদি তার বিন্দুমাত্র প্রায়শ্চিত্ত করতে পেরে থাকি তবেই সার্থক হবে আমাদের শ্রম।”

তিন দশক পেরিয়ে এখনও সচল নীড় পত্রিকা, সম্পাদনার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল। নামের শেষে ‘চাঁড়াল’ শব্দটিকে সংযুক্ত করার মধ্যেই আছে দলিত আত্মপরিচিতির সপাট প্রতিষ্ঠার ভঙ্গিটি, যে কারণে পরে নিজের আত্মকথার নামও তিনি দেন আমি কেন চাঁড়াল লিখি। এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে বাঙালি দলিত নারীরা তাঁদের সমাজ-অস্বীকৃত জীবনের বয়ান নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। দলিত পুরুষ ও দলিত নারীর জীবনের নিপীড়ন তথা লাঞ্ছনার বয়ান যে ভিন্ন হতে পারে, তা তাঁরা স্পষ্ট করেছেন এই পত্রিকার লেখালিখির মধ্য দিয়ে। নীড়-এর নানা সংখ্যায় বেরিয়েছে বাঙালি দলিত নারীদের জীবন-আখ্যান, পরে তা থেকে জন্ম নিয়েছে বেশ কিছু বাঙালি দলিত নারীর আত্মজীবনী। আরও কয়েকটি জীবনকথা লেখা চলছে, অচিরেই প্রকাশিত হবে। একটি ছোট্ট সাহিত্যপত্রিকা যে বাঙালি দলিত নারীদের আন্তরিক মুখপত্র হয়ে ওঠার তাৎক্ষণিক ভূমিকাটির পাশাপাশি বৃহত্তর অর্থে বাংলার দলিত আন্দোলনের সাহিত্যগত প্রয়োজনটিও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পারে, এ যেন তারই প্রমাণ— ভাবে, ভাষায়, অক্ষরে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dalit Literature

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy