E-Paper

‘যাহা পাই তাহা চাই না’

অতিরিক্ত বিকল্প আমাদের স্থবিরও করে তোলে। অত্যধিক বিকল্প থাকলে, আমরা অনেক সময় শেষ পর্যন্ত কিছুই বেছে নিই না। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোনও দোকানে একটি পণ্যের অনেক ধরনের সংস্করণ থাকে, তখন ক্রেতারা প্রায়ই কিছু না কিনেই চলে যান।

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৫ ০৬:৩৯

মাঝে মাঝে মনে হয়, আজ থেকে একশো বছর পরে যদি আজকের সময়টাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখা হয়, তার প্রথম বাক্যটা চার্লস ডিকেন্সের আ টেল অব টু সিটিজ় থেকে ধার করে নিয়ে লেখক লিখতেই পারেন, “ইট ওয়াজ় দ্য বেস্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ় দ্য ওয়ার্স্ট অব টাইমস।”

কিছু দিন আগের কথা। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত তিন দিনের কনফারেন্স শেষ হয়েছে— ডিনার হলে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা অর্থনীতিবিদদের নরক গুলজার চলছে। সেখানেই একটা টেবিল ঘিরে বসে আমি, অলি-পেক্কা, লরা, আর গ্যাব্রিয়াল। আমি ছাড়া, বাকি সবাই ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কফির কাপে সবে চুমুক দিয়েছি, ঠিক তখনই অলি-পেক্কা বলে উঠলেন উপরোক্ত কথাটা।

আমরা উৎসুক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, “চয়েস প্যারাডক্সের কথা বলছি।” একটু থেমে বলে চললেন, “ভেবে দেখো, আমরা এক সীমাহীন বিকল্পের পৃথিবীতে বাস করছি। কী খাব, কী পরব, কী দেখব, কোন পেশা বেছে নেব, কার সঙ্গে প্রেম করব, কোথায় বেড়াতে যাব— সব কিছুর ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে আজ অসংখ্য বিকল্প। আপাতভাবে এই অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে থেকে পছন্দ করার সুযোগ পাওয়াকে মানবজাতির চূড়ান্ত অগ্রগতির ফসল বলেই মনে হয়। কারণ সীমাহীন বিকল্পই তো স্বাধীনতা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আর আর্থিক সমৃদ্ধির প্রমাণ। তাই না? কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে থেকে পছন্দ করার সুযোগ আমাদের সব সময় সুখী করে না। বরং তা প্রায়ই আমাদের বিভ্রান্ত, উদ্বিগ্ন এবং অসন্তুষ্ট করে তোলে।”

বেশ কিছু দিন কেটে গিয়েছে তার পর। সুযোগ হয়েছে অলি-পেক্কার কথাগুলো তলিয়ে ভাবার। বুঝতে পেরেছি, কী ভীষণ তাৎপর্য সেগুলোর। আধুনিক পৃথিবী এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে সবচেয়ে সাধারণ সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও অত্যন্ত কঠিন মনে হয়। মাসকাবারি বাজারের কথাই ধরা যাক। এক দশক আগে পর্যন্ত মাসকাবারি বাজার করতে আমরা যেতাম পাড়ার মুদিখানায়। তার পরিবর্তে আজ আমাদের অনেকেরই গন্তব্য কোনও না কোনও আধুনিক সুপার মার্কেট। সেগুলোয় দেওয়াল জুড়ে সারি সারি তাক— তাতে সাজানো অসংখ্য সিরিয়ালের ব্র্যান্ড, রান্নার তেলের অগণিত ধরন, অন্তত দশ রকমের দুধ এবং ফ্রোজ়েন খাবারদাবারের জন্য সম্পূর্ণ একটা আলাদা বিভাগ। এর ফলে মাসকাবারি বাজার করার মতো সহজ একটা কাজ হয়ে ওঠে এক জটিল ধাঁধা— প্রতিটি বিকল্পের সুফল ও কুফল নিয়ে ভাবতে হয় যে! অবশ্য শুধু মাসকাবারির বাজারই নয়— ফোন কেনা, নতুন চাকরি নেওয়া, কিংবা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে একটি সিনেমা বেছে নেওয়াও সমান ক্লান্তিকর হতে পারে এই একই কারণে।

অত্যধিক বিকল্পের জোগান শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তা-ই নয়, এর আরও গভীর মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে। মনোবিজ্ঞানী ব্যারি শোয়ার্টজ় তাঁর প্যারাডক্স অব চয়েস বইয়ে লিখেছেন, সীমিত বিকল্প থেকে পছন্দ করার সুযোগ মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটায়, কিন্তু অতিরিক্ত বিকল্পের মধ্যে থেকে পছন্দ করতে হলে তা চাপ, অনুশোচনা ও আত্ম-সন্দেহ সৃষ্টি করে। অত্যধিক বিকল্প সামনে থাকলে আমরা শুধু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার ভয় পাই না, আমরা যেটা বেছে নিই, তা নিয়েও অসন্তুষ্ট থাকি। সব সময় মনে হতে থাকে— আমি যে বিকল্প পছন্দ করেছি, তার থেকেও ভাল বিকল্প হয়তো ছিল বিকল্পের তালিকায়। একটা স্মার্টফোন কিনে মনে হয়, অন্য মডেলে হয়তো আরও একটু ভাল ক্যামেরা ছিল। ডেটিং অ্যাপে পছন্দের মানুষকে মেসেজ পাঠানোর পর মনে হয়, হয়তো আরও আকর্ষণীয় কেউ ছিল, আর একটু খুঁজলেই তাকে পাওয়া যেত। ফলে আমরা স্থায়ী ভাবে ‘কী হত যদি...’ নামক এক অবস্থার মধ্যে আটকে পড়ি— যেখানে কোনও সিদ্ধান্তই সম্পূর্ণ তৃপ্তি দেয় না।

অতিরিক্ত বিকল্প আমাদের স্থবিরও করে তোলে। অত্যধিক বিকল্প থাকলে, আমরা অনেক সময় শেষ পর্যন্ত কিছুই বেছে নিই না। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোনও দোকানে একটি পণ্যের অনেক ধরনের সংস্করণ থাকে, তখন ক্রেতারা প্রায়ই কিছু না কিনেই চলে যান। কারণ পঞ্চাশ রকম শ্যাম্পুর সামনে দাঁড়িয়ে সহজতম কাজ হয়ে ওঠে— চলে যাওয়া। বড় সিদ্ধান্তগুলির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। অস্বীকার করে লাভ নেই, বর্তমান সময়ে অনেক তরুণ-তরুণীই বিয়ে করা, বাড়ি কেনা বা দীর্ঘমেয়াদি কেরিয়ার নির্বাচন বিলম্বিত করেন শুধু সুযোগের অভাবে নয়, অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে থেকে একটি বিকল্প বেছে নেওয়া কঠিন বলে।

উল্লেখ্য, সমাজমাধ্যম এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা স্ক্রোল করে দেখি কারও স্বপ্নের ছুটি, কারও আদর্শ চাকরি, কারও বা নিখুঁত সম্পর্কের উদ্‌যাপন। সেগুলো দেখে আমাদের নিজের পছন্দগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। এই মেকি বাস্তবতা আমাদের মধ্যে এক ধরনের অতৃপ্তির বোধ তৈরি করে— তার ফলে যা-ই বেছে নিই না কেন, মনে হয়, কিছু একটা কম পড়ে গেল। যে প্রযুক্তির কথা ছিল আমাদের জীবন সহজ করার, সেটাই ‘তুলনার ফাঁদ’ তৈরি করে আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে দু’বার ভাবতে বাধ্য করে।

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে অনেকেই সীমিত বিকল্পের মধ্যে পছন্দ করার কথা বলে থাকেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এটা করা অত সহজ নয়। আধুনিক পৃথিবী গঠিতই হয়েছে এমন ভাবে যে, আপনি চান বা না চান, অসংখ্য বিকল্পের মধ্যে থেকেই আপনাকে পছন্দ করে নিতে হবে— বাজার প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন পণ্যে ছেয়ে যাচ্ছে, অ্যালগরিদম আমাদের সামনে আরও বেশি বেশি কনটেন্ট হাজির করছে, এমনকি সমাজও আমাদের মনে এই ধারণার জন্ম দিচ্ছে যে, যেটা বেছে নিয়েছি, তার থেকে আরও ভাল কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব আমাদের পক্ষে।

তা হলে কী ভাবে চলব এই অতিরিক্ত বিকল্পের পৃথিবীতে? একটা উপায় হতে পারে, আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতিটা পুনর্বিবেচনা করা। ‘সবচেয়ে ভাল’ বিকল্প খোঁজার পরিবর্তে ‘যথেষ্ট ভাল’ বিকল্পে থেমে যাওয়াই হতে পারে বুদ্ধিমানের কাজ। মনোবিজ্ঞানীরা এই আচরণকে বলেন ‘স্যাটিস্‌ফাইজ়িং’, যা ‘ম্যাক্সিমাইজ়িং’-এর বিপরীত। এক জন ‘ম্যাক্সিমাইজ়ার’ সমস্ত বিকল্প ঘেঁটে সেরাটা খুঁজে বার করতে চান। কিন্তু ‘স্যাটিস্‌ফাইজ়ার’ এমন কিছু বেছে নেন, যা তাঁর প্রয়োজন মেটায় এবং তার পর আর তা নিয়ে তিনি দু’বার ভাবেন না। গবেষণা বলছে, স্যাটিস্‌ফাইজ়াররা সাধারণত তাঁদের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন, আর ম্যাক্সিমাইজ়াররা যদিও ‘সর্বোত্তম’ সিদ্ধান্ত নেন, তবুও অতৃপ্তিতে ভোগেন।

আর একটি উপায়— সফলতার সংজ্ঞা নতুন ভাবে নির্ধারণ করা। অনেক বিকল্পের মধ্যে থেকে সেরাটা বেছে নিতে পারলে তবেই আমরা সফল— এটা আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু বাস্তবে সফলতা মানে ‘সেরা’ বিকল্পকে বেছে নেওয়া নয়, বরং এমন বিকল্পকে বেছে নেওয়া, যা আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে মানানসই; এবং সেই বেছে নেওয়া বিকল্পকে পূর্ণ ভাবে গ্রহণ করতে শেখা। আমরা যদি একটি পেশা বেছে নিই, তা হলে অন্য কোনও পেশা বেছে নিলে ভাল হত কি না, তা নিয়ে না ভেবে বরং সেই পেশাতেই কী ভাবে সাফল্য পাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবা ভাল। কোনও সম্পর্কে যদি অঙ্গীকারবদ্ধ হই, তা হলে সেটাকে লালন করার পরিবর্তে ‘আরও ভাল কিছু’র জন্য যেন মুখিয়ে না থাকি।

আধুনিক পৃথিবী আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন বিকল্প হাজির করতেই থাকবে। এই নিয়ম আমরা বদলাতে পারব না। কিন্তু যেটা করতে পারি সেটা হল অসম্পূর্ণতাকে গ্রহণ করতে শেখা, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অনুশোচনায় না ভোগা, এবং এটা বোঝা যে, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বিকল্পগুলোকে আমরা বেছে নিয়েছি বা নেব, সেগুলোকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারলে তবেই সুখের কাছাকাছি পৌঁছতে পারব।

অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

demands Apps Malls

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy