রক্ত আর জল কখনও এক সঙ্গে বইতে পারে না— ২০১৬ সালে উরি-র সেনাছাউনিতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ১৮ জন সেনার মৃত্যুর পরে সিন্ধু জল চুক্তি (আইডব্লিউটি) নিয়ে এ কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে এর পরেও এই চুক্তি অব্যাহত ছিল। শেষে পহেলগাম কাণ্ড দাঁড়ি টানল দুই দেশের সিন্ধু-সমঝোতায়।
জঙ্গি হামলার প্রত্যুত্তর হিসেবে আপাতত সিন্ধুর জলকেই হাতিয়ার করছে দিল্লি। জানিয়ে দিয়েছে, যত ক্ষণ না পাকিস্তান ‘বিশ্বাসযোগ্য’ এবং ‘অপরিবর্তনীয়’ ভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার সমর্থন তুলে নেয়, তত ক্ষণ সিন্ধু জল চুক্তি ‘স্থগিত’ থাকবে। এই মুহূর্তে, বাগলিহার বাঁধের মাধ্যমে চন্দ্রভাগার জল আটকানো হয়েছে। একই পরিকল্পনা রয়েছে বিতস্তার উপনদীর উপর কিসানগঙ্গা বাঁধ নিয়েও। আর এ সব দেখে পাকিস্তানের পাল্টা হুঁশিয়ারি— দিল্লির এই সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবেই দেখা হবে।
১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত হয় সিন্ধু চুক্তি, যদিও তার সূত্রপাত সেই ১৯৪৭ সালের অগস্টেই। সিন্ধু নদের উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে রয়েছে ভারত, আর নিম্ন অববাহিকায় পাকিস্তান। ফলে, প্রয়োজনে নদীজলের প্রবাহ ভারত যে নিয়ন্ত্রণ করতেই পারে, প্রথম থেকেই পাকিস্তানের সেই আশঙ্কা ছিল। সেই কারণেই সিন্ধুনদের জলবণ্টনের চুক্তিটি হয়েছিল— দুই দেশের কৃষি, জল এবং শিল্পের কথা ভেবে। টানা নয় বছর ধরে আলোচনার পরে বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু-র মধ্যে করাচিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘আইডব্লিউটি’।
চুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তানের অধিকার সিন্ধু ও তার দুই উপনদী বিতস্তা এবং চন্দ্রভাগার উপর। আর, পূর্ব দিকের তিন উপনদী বিপাশা, শতদ্রু ও ইরাবতীর উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধা না দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির অনুমতি ছিল ভারতের কাছে, যদিও জলাধার বাঁধ তৈরি ছিল নিষিদ্ধ।
ক্রমশ দু’টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হয়ে উঠল বিবাদের সূত্র: ২০১৮ সাল থেকে চন্দ্রভাগার উপনদীর উপর চালু হওয়া কিসানগঙ্গা, আর বিতস্তার উপনদীর উপর নির্মীয়মাণ রতলে। সম্প্রতি চুক্তি স্থগিত রাখার পর এখন ভারত তার ওই প্রকল্পগুলি দ্রুত সম্পন্ন করতে চাইতে পারে, বাড়তি জল সঞ্চয়ের জন্য প্রকল্প দু’টির নতুন নকশাও বানাতে পারে। অন্য দিকে, পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলির বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও এমন পরিকল্পনা করা যেতে পারে। তা ছাড়া, ভারত তার জলাধার থেকে পলি অপসারণও করতে পারে, কিসানগঙ্গার ক্ষেত্রে যার সুযোগ রয়েছে। মনে রাখা দরকার, সিন্ধুর মতো হিমালয়-জাত নদীতে পলির পরিমাণ বেশি, যা বাঁধে জমা হয়, এবং হঠাৎ ভেসে এসে নিম্ন অববাহিকায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে।
এ দিকে, ভারতের দিকে চন্দ্রভাগা নদীর উপর বাগলিহার বাঁধ দীর্ঘ দিন ধরেই দুই দেশের বিরোধের কারণ। অতীতে এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের হস্তক্ষেপও চেয়েছিল পাকিস্তান। অভিযোগ ছিল, এই বাঁধ দিয়ে পাকিস্তানের জল আটকাতে চাইছে ভারত। সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করে এ বার সেই বাঁধ দিয়েই জল আটকানো হল। ভারতের বাঁধে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের পরিদর্শন কিংবা জলের তথ্য আদানপ্রদানও এখন বন্ধ হতে পারে। স্বভাবতই, আগাম তথ্য না পেলে পাকিস্তানে খরা বা বন্যার ঝুঁকি বাড়বে।
সিন্ধু অববাহিকা পাকিস্তানের জীবনরেখা। সেচ থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন, এবং দেশের মোট মিষ্টি জলের প্রায় ৯০ শতাংশের জন্য এই নদীগুলির উপর তার নির্ভরতা। পঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশে এই নির্ভরতা তুলনায় বেশি। শুধু তা-ই নয়, সে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনও এই নদীগুলির উপরে নির্ভরশীল। এত কাল ধরে দুর্বল সেচ, জল-নিবিড় ফসল উৎপাদন ইত্যাদির জেরে সে দেশের জলসঙ্কট এমনিতেই তীব্র, গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থাও গুরুতর। এর মাঝে যদি দেশে জল সরবরাহও ব্যাহত হয়, তবে জনরোষ কোথায় পৌঁছবে তা বিলক্ষণ জানে পাক সরকার।
আসল প্রশ্ন অন্য। সত্যিই কি ভারত সিন্ধু অববাহিকার জল আটকে রাখতে বা অন্য পথে ঘুরিয়ে দিতে পারে, যার ফলে পাকিস্তান তার এই ‘জীবনরেখা’ থেকে বঞ্চিত হবে? উত্তর হল, ভবিষ্যতে তা হতেও পারে, কিন্তু আপাতত তার সম্ভাবনা কম। উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে ভারতীয় বাঁধগুলির এখনও বিপুল জল ধারণের ক্ষমতা নেই। শুধু তা-ই নয়, এই অঞ্চলে তেমন বিস্তৃত খালও নেই যা দিয়ে এই জল অন্য কোথাও সরানো যায়। ফলে, পাকিস্তানের জলভাগ সত্যিই ব্যাহত করতে হলে ভারতের দিকে চাই— ব্যাপক পরিকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিরাট বিনিয়োগ।
অন্য দিকে, চিন, বাংলাদেশ এবং নেপালের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের এই পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট। তিব্বত থেকে ভারতে প্রবাহিত নদীজলের তথ্য ভাগাভাগিতে পরিবর্তন আনতে পারে চিন। পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্রের উপরে চিনের বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান ও যুক্তিগুলিও সে ক্ষেত্রে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আগামী দিনে সিন্ধু নদ কতখানি সংঘাতের কারণ হতে চলেছে, তার উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে কিশতওয়ারের ধ্বস্ত পাহাড়, পঞ্জাবের তৃষ্ণার্ত খেত, আর হিমালয়ের হিমবাহসমূহের মধ্যে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)