আগামী মাস থেকে ইউনিভার্সিটি অব সাদাম্পটন তাদের ভারতীয় ক্যাম্পাসে স্নাতক স্তরে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি শুরু করবে। দেশে স্বাধীন ভাবে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের এটা প্রথম ক্যাম্পাস হবে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী যখন ঘোষণা করেন যে, এ রকম পনেরোটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ভারতে তাদের ক্যাম্পাস খুলবে, তখন স্বভাবতই ভারতের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের একটা বড় দিকচিহ্ন বলে মনে করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতে ক্যাম্পাস তৈরি করার পরিকল্পনা নতুন নয়। ২০১০-এর ‘ফরেন এডুকেশন বিল’ থেকে সাম্প্রতিক জাতীয় শিক্ষানীতি সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ। মনে রাখা প্রয়োজন যে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এর আগেও ভারতে এসেছে। নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকলেও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতায় বিদেশি ডিগ্রি দেশে থেকেই পাওয়া যেত। কিন্তু সেগুলির কোনওটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার প্রধান কারণ, এই ডিগ্রিগুলোর ইউজিসি-স্বীকৃতি ছিল না।
২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে ভারতে প্রদত্ত বিদেশি ডিগ্রিগুলি এখন থেকে ইউজিসি-অনুমোদিত হবে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে— সরকারি চাকরি পাওয়াতে থাকবে না বিধিনিষেধ। অপর দিকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য ভারত থেকে যে বহুল অর্থ বিদেশে পাড়ি দেয়, সেই অর্থ দেশেই বিনিয়োগ হবে। এই কথা মাথায় রেখেই বিশ্বের প্রথম ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে— ভারতের সংরক্ষণ নীতি, প্রবেশিকা পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা এবং ফি নিয়ন্ত্রণের বাইরে— এই নতুন উদ্যোগকে নীতিনির্ধারকরা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে দেখছেন। তাঁদের মতে, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় উচ্চশিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দেওয়া যাবে, আর মেধা-প্রবাহের পথ উল্টে দেওয়া সম্ভব হবে।
ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারতের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলিও কার্যত কল্কে পায় না। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ কয়েক দশকের প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা। পাঠ্যক্রম ও পরিকাঠামো এখনও আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক দূরে থেকে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই অনাকর্ষণীয় বেতন ও গবেষণার সুযোগ না থাকায় উচ্চ মানের শিক্ষকরা নিজেদের সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করতে পারছেন না। কিন্তু, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এলেই কি এ সব সমস্যার সমাধান হবে? এই উদ্যোগ কতটা দীর্ঘমেয়াদি, কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক, এবং আদৌ ভারতীয় উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারবে কি?
ভারতে কলেজ-পড়ুয়া জনসংখ্যা বিপুল, এবং তা ক্রমশ বাড়ছে। দেশ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আসনসংখ্যার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবল চাপের মুখে। সেই দিক থেকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাস পরিপূরক ভূমিকা নিতে পারে। ব্যবসা, প্রযুক্তি কিংবা কারিগরি শিক্ষায়— যে বিষয়েই হোক না কেন, প্রতিটি নতুন ক্যাম্পাস মানে অতিরিক্ত আসন, যা এক দিকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার চাহিদা কমাতে পারে, অন্য দিকে দেশের মধ্যেই অপেক্ষাকৃত কম পছন্দের বিকল্পে পড়তে বাধ্য হওয়া বহু শিক্ষার্থীর জন্য একটি নতুন বিকল্প খুলে দিতে পারে। প্রতিযোগিতা বাড়লে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলিরও মান উন্নত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়বে, আর তার হাত ধরেই আসবে সামগ্রিক উন্নয়ন— অর্থনীতির এই মৌলিক তত্ত্ব এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না, তা বুঝতে গেলে কয়েকটি বিষয় দেখা দরকার। বিদেশে পড়তে যাওয়ার চেয়ে দেশে বসেই বিদেশি শিক্ষা পরিষেবা পাওয়ার খরচ তুলনায় কম হলেও, দেশের অন্য সব প্রতিষ্ঠিত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থেকে তার মূল্য উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি হবে। আগে আসা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ডিগ্রি ইউজিসি-অনুমোদিত না হলেও তাদের টিউশন ফি নামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির চেয়েও দু’তিন গুণ বেশি হত। এখনও তেমনই হবে। অর্থাৎ এই ডিগ্রিগুলো খুব মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্তরই নাগালে আসবে। সমস্যা হল যে, সমাজের এই স্তরের মানুষরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের শুধুমাত্র বিদেশি ডিগ্রির সিলমোহরের জন্য বাইরে পাঠান না, বরং বিদেশে বাস করার সামগ্রিক অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রাখেন। বিদেশের লেকচার-থিয়েটারে বিভিন্ন জাতি, ভাষা, রাষ্ট্রীয়তার যে উদ্দীপক মিশ্রণ, সেটা খুব সহজে দিল্লি বা গুজরাতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। আগেকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ক্যাম্পাসগুলি কেন সফল হয়নি, তার অন্যতম প্রধান কারণ এটি।
পশ্চিমি দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে লেখাপড়া মূলত গবেষণাধর্মী। সেখানকার শিক্ষকদের প্রধান কাজ তাঁদের মৌলিক গবেষণা। সেই গবেষণার মান দিয়েই তাঁদের মূল্যায়ন করা হয়, এবং তাঁদের গবেষণার পরিকাঠামো এই সব বিশ্ববিদ্যালয় জোগান দেয়। নিজেদের দেশে গবেষণার মানদণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মূল্যায়ন হলেও, ভারতীয় ক্যাম্পাস এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমে এখন অভিবাসন-বিরোধী হাওয়া বইছে এবং নানা কারণে তাদের অর্থনীতি চাপে থাকায় কর্মসংস্থানও সে ভাবে বাড়ছে না। অতএব নিজেদের দেশে তাদের ছাত্র-নিয়োগ বাড়ানো মুশকিল হয়ে উঠছে। ভারতীয় ক্যাম্পাস তৈরি করার পিছনে তাদের মূল লক্ষ্য মূলত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে ছাত্র-নিয়োগ বাড়ানো। কাজেই, ভারতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তৈরি হলেই যে সেখানেও পশ্চিমি দেশগুলির ক্যাম্পাসের মতো গবেষণা-ধর্মী লেখাপড়ার প্রচলন হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলির নিজস্ব দায়বদ্ধতার উপরে ভরসা না করে প্রয়োজন আমাদের দেশীয় পরিকাঠামো গঠন করা, ও এই ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা। এর কোনও সংস্থান কিন্তু নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে নেই।
যে কোনও শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড হল শিক্ষকদের গুণমান, এবং তাঁদের যথাযথ মর্যাদা। আমাদের দেশের প্রথম সারির ছেলেমেয়েদের শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার হার ক্রমশ কমছে। গত কয়েক দশক কারিগরি শিক্ষায় জোর দেওয়ার ফলে মৌলিক গবেষণার পরিকাঠামো মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে নেই। এর ফলে গবেষণা-ধর্মী অধ্যাপকের জোগান এই মুহূর্তে কম, এবং এই জোগান তৈরি করা সময়সাপেক্ষ। এই চাহিদা-জোগান বৈষম্যের একটা সমাধান হল, বিদেশ থেকেই অধ্যাপক নিয়োগ করে তাঁদের যথাযথ পারিশ্রমিক দিয়ে কিছু বছরের জন্য ভারতীয় ক্যাম্পাসে বদলি করা। চিনের সরকারের নির্দেশিকা মেনে লিভারপুল বা নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি তাদের চিনা ক্যাম্পাসের জন্য এ ভাবেই অধ্যাপক নিয়োগ করে থাকে। ভারতের শিক্ষানীতিতে আগে এমন কোনও নির্দেশিকা ছিল না, এখনও নেই। এর ফলে আগে আসা পশ্চিমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের ভার ছিল স্বল্প-বেতনের স্থানীয় অধ্যাপকদের উপরে। নিরলস প্রচেষ্টা থাকলেও তাঁদের সঠিক প্রশিক্ষণ বা পরিকাঠামো কোনওটাই ছিল না, যার ফলে শিক্ষার মান আশাপ্রদ হয়নি। এ বার কি তার ব্যতিক্রম হবে?
যদি আমরা ধরে নিই যে, বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়বে, তা হলে আমাদের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলির পরিকাঠামোগত সাহায্য প্রয়োজন। না হলে সার্বিক ভাবে শিক্ষার মান উন্নত না হয়ে, তার পুনর্বণ্টন হবে। এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ পুনর্বণ্টনের প্রবাহ হবে নগরকেন্দ্রিক, আর্থিক ভাবে সচ্ছলদের দিকে। ভবিষ্যতের সামাজিক বৈষম্য এর ফলে আরও প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তার জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে সুদূরপ্রসারী প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা দরকার।
শিক্ষা ভোগ্যপণ্য নয়, বিনিয়োগ-পণ্য। এতে প্রতিযোগিতা বাড়লে গুণগত মান যে বাড়বেই, তা স্বতঃসিদ্ধ নয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিবার শিক্ষার মাধ্যমেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা খোঁজে। সেই শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতির জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি দায়বদ্ধতা— শিক্ষক প্রশিক্ষণে ও গবেষণার পরিকাঠামো তৈরি করতে বিনিয়োগ, কারিগরি শিক্ষার প্রসার এবং গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য বিশেষ সহায়তা। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলোর সমাধান আরও বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিনগেন, নেদারল্যান্ডস।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)