পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নাম রয়েছে। রাজ্য সরকার কোনও পদক্ষেপ করেনি।”— না, শুভেন্দু অধিকারী নন। অভিযোগ তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভায় দাঁড়িয়ে। কুড়ি বছর আগে। ২০০৫ সালের ৪ অগস্ট। পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর সমস্যা নিয়ে আলোচনার দাবি গৃহীত না হওয়ায় তিনি লোকসভার ডেপুটি স্পিকার চরণজিৎ সিংহ অটওয়ালের টেবিলে হাতের কাগজপত্র ছুড়ে মেরেছিলেন।
বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাবরের অভিযোগ ছিল, সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ঢুকিয়ে নির্বাচনে জেতে। ১৯৯৩ সালে যুব কংগ্রেসের নেত্রী হিসেবে তাঁর একুশে জুলাইয়ের আন্দোলনের দাবি ছিল, ভোটারদের সচিত্র পরিচয়পত্র। ‘নো আইডেন্টিটি নো ভোট’। যাতে সিপিএমের ভুয়ো ভোটার বাদ যায়। ওই আন্দোলনে ১৩ জনের মৃত্যুকে স্মরণ করে তৃণমূল প্রতি বছর একুশে জুলাই শহিদ দিবস পালন করে।
সময়ের চাকা ঘুরেছে। রাজনৈতিক অবস্থানও বদলে গিয়েছে। সে দিনের বিরোধী নেত্রী আজ মুখ্যমন্ত্রীর আসনে। আর আজকের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সে দিনের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই দাবি তুলছেন, পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় এক কোটির বেশি বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী, রোহিঙ্গা রয়েছেন। তাঁদের ভোটেই নাকি তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনে জিতছে!
১৯৯৩ সালে তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন দেশ জুড়ে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র চালুর উদ্যোগ করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় সকলের জন্য সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবি তুলেছিলেন। শেষনের লক্ষ্য ছিল, ভোটার তালিকা থেকে ভুয়ো ভোটার, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বাদ দেওয়া। মৃত বা ঠিকানা বদলে ফেলা ভোটারদের হয়ে যাতে অন্য কেউ ভোট দিতে না পারেন, তার ব্যবস্থা করা। আজ বর্তমান মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর শুরু করেছেন। তাঁরও ঘোষিত উদ্দেশ্য বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী, রোহিঙ্গা বা নেপালিদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। মৃত, স্থানান্তরিত বা ‘ডুপ্লিকেট’ ভোটারদের নাম কাটা। যাতে তাঁদের হয়ে অন্য কেউ ভোট দিতে না পারে।প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন ২০০২-২০০৩’এ শেষ বার এসআইআর করে ফেলেছিল। বাইশ বছর পরে আবার এসআইআর-এর কথা মনে পড়ল কেন?
বিরোধীরা এর পিছনে বিজেপি ও জ্ঞানেশ কুমারের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে দাবি করছেন। সঙ্গে এও ঠিক, গত ২২ বা ২৩ বছরে কোনও মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণের উদ্যোগ করেননি। কোনও রাজনৈতিক দলও এই দাবিতে সরব হয়নি। কারণ ভুয়ো ভোটার সব দলেরই প্রিয়। যেখানে যে দল শাসকের আসনে বা যার যেখানে সাংগঠনিক শক্তি বেশি, সেখানে তারা ভুয়ো ভোটারের সুবিধা নেয়। ভোটার তালিকায় মৃত বা গরহাজির ভোটারদের হয়ে ভোট দিয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তথা বামদলগুলি ক্ষমতায় থাকতে একে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। বিরোধীরা যার নাম দিয়েছিলেন ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’। তৃণমূলের জমানাতেও একই কাণ্ড চলছে। ২০২২-এ বিধাননগরে পুর নির্বাচনের সময় ২০১৮ সালে প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের হয়ে কেউ ভোট দিয়ে গিয়েছিলেন। তা নিয়ে বিরোধীরা হইচই করেছিলেন। কিন্তু কী ভাবে কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর চার বছর পরেও তাঁর নাম ভোটার তালিকায় থেকে যায়, ভোটার আইডি কার্ড থাকতেও কেউ কী ভাবে অন্যের ভোট দিয়ে যান, তার উত্তর মেলেনি।
১৯৯৩-এ টি এন শেষন সচিত্র পরিচয়পত্রের কাজ শুরু করেছিলেন। ২০০২-এ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জে এম লিংডো যখন এসআইআর করিয়েছিলেন, সে সময় দেশের মাত্র ৫ শতাংশ ভোটারের সচিত্র পরিচয়পত্র ছিল। লিংডোর পরে গত কুড়ি বছরে ১৩ জন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এসেছেন। তাঁদের মধ্যে এন গোপালাস্বামী, নবীন চাওলা, এস ওয়াই কুরেশি, সুনীল অরোরা, রাজীব কুমারের মতো স্বনামধন্য মুখ্য নির্বাচন কমিশনারও ছিলেন। অথচ তাঁরা ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করার উদ্যোগ করেননি। কোনও দল প্রশ্ন তোলেনি, কেন বছরের পর বছর ভোটার তালিকায় মৃত বা ঠিকানা বদলে ফেলা ভোটারের নাম থেকে যাবে?
গত বাইশ বছরে নিয়মিত ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে যদি মৃত, স্থানান্তরিত বা ‘ডুপ্লিকেট’ ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হত, তা হলে এখন এসআইআর করতে হত না। আমজনতাকে বাইশ বছর আগের ভোটার তালিকায় বাপ-ঠাকুর্দার নাম ছিল কি না, তা খুঁজতে হত না। এখন এসআইআর-এর ফলে মানুষের ঘুম ছুটে গিয়েছে। কারণ বাইশ বছর আগের ভোটার তালিকায় বাপ-ঠাকুর্দার নাম না থাকলে জবাবদিহি করতে হবে। ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ গেলে নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ হিসেবে ভবিষ্যতে কী খেসারত দিতে হবে, কেউ জানে না।
এত মানুষের হেনস্থা করে যে লক্ষ্যে এই এসআইআর নামক রাজসূয় যজ্ঞ, সেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাবে তো?
পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১২টি রাজ্যে এসআইআর-এর আগে বিহারে এসআইআর হয়েছিল। বিহারের ভোটার তালিকাতেও নাকি লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি, নেপালি, রোহিঙ্গা ছিলেন। বিহারে ৭.৮৯ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রথমেই খসড়া তালিকায় ৬৫ লক্ষের নাম বাদ পড়েছিল। তার মধ্যে ২২ লক্ষ মৃত, ৩৬ লক্ষ স্থানান্তরিত আর ৭ লক্ষ ‘ডুপ্লিকেট’, যাঁদের একাধিক জায়গায় নাম ছিল। তিনটি সংখ্যা যোগ করলে ওই ৬৫ লক্ষ। তা হলে অনুপ্রবেশকারীরা গেলেন কোথায়? চূড়ান্ত তালিকায় আরও ৩.৬৬ লক্ষ নাম বাদ পড়েছিল। তার মধ্যেও কত জন অনুপ্রবেশকারী, উত্তর মেলেনি। কমিশন সূত্রে বলা হয়েছিল, ৩.৬৬ লক্ষের মধ্যে ২ লক্ষ স্থানান্তরিত, ৬০ হাজার মৃত ও ৮০ হাজার ডুপ্লিকেট। বাকি থাকে ২৬ হাজার। নাম বাদ যাওয়া মোট ৬৮.৬৬ লক্ষ ভোটারের মধ্যে এই ২৬ হাজার অনুপ্রবেশকারী ছিলেন? উত্তর মেলেনি।
বিহারে ভোটার তালিকার ৭ কোটি ৮৯ লক্ষ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৮.৭% ভোটারের নাম বাদ গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শেষ ভোটার তালিকায় ৭ কোটি ৬৬ লক্ষ নাম ছিল। যদি বিহারের অনুপাতেই পশ্চিমবঙ্গে নাম বাদ যায়, তা হলে প্রায় ৬৬ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ যাবে। তার মধ্যে কত জন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, কমিশন জানাবে তো?
আরও বড় প্রশ্ন, এসআইআর করেও কি ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটার রোখা যাবে?
কমিশন ভোটার তালিকা থেকে মৃত, স্থানান্তরিত, ডুপ্লিকেট ভোটার ও অনুপ্রবেশকারীদের বাদ দিতে চাইছে। কিন্তু ভুয়ো ভোটার বা ভিন রাজ্যের ভোটার যোগ হওয়া রোখা যাবে কী ভাবে?
গত বছর মহারাষ্ট্রে লোকসভা নির্বাচন থেকে বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে ছয় মাসে ভোটার তালিকায় ৩০ লক্ষ ভোটার যোগ হয়েছিলেন। এত ভোটার ছয় মাসে কোথা থেকে এসেছিলেন? বিহারে এসআইআর পর্বে ২১.৫৩ লক্ষ নতুন ভোটার যোগ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৪.১ লক্ষ নবীন ভোটার। সদ্য আঠারো পেরোনো। বাকি ৭.৪৩ লক্ষ নতুন ভোটার কারা? যাঁরা বাদ পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে? না কি ভিন রাজ্যের ভোটার বিহারে গিয়ে নাম লিখিয়েছিলেন? প্রশ্ন উঠেছে, কারণ বিহারে ভোটের পরে দেখা গিয়েছে, একাধিক বিজেপি নেতা, কর্মী গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পরে আবার নভেম্বরে বিহারে গিয়ে ভোট দিয়েছেন। তাঁরা আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে ভোট দেবেন না, তার কী গ্যারান্টি?
এসআইআর-এর বিরোধিতায় নেমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তাঁর প্রিয় ‘বিরোধী নেত্রী’-র জার্সিটা পরে ফেলেছেন। শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপির বাংলাদেশি ভোটারের অভিযোগের জবাবে মমতা বলছেন, বিজেপি ও নির্বাচন কমিশন মিলে হিন্দি বলয়ের লোক বাংলার ভোটার তালিকায় ঢোকাবে। বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাতের কেউ যদি পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে আপাতত বসবাসের কোনও ঠিকানার প্রমাণ জোগাড় করে নতুন ভোটার হিসেবে সরাসরি অনলাইনে আবেদন করেন, তাঁদের কী ভাবে রোখা যাবে? কমিশনের কাছে উত্তর নেই। নির্বাচন কমিশন ভুয়ো ভোটার বাদ দিতে চাইছে। ভুয়ো ভোটার যোগ হওয়ার রাস্তা কী ভাবে বন্ধ হবে? না কি এটাই নতুন ‘রিগিং’?
ভুয়ো ভোটার বাদ দেওয়ার রাজসূয় যজ্ঞে যদি ভুয়ো ভোটার যোগ হয়, তা হলে এত মানুষের হেনস্থা করে, নাগরিকত্ব চলে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে কী লাভ!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)