খাটিয়া-পাতা ধাবার দিন গিয়েছে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ধারে এখন মেলে এসি-শীতল রেস্তরাঁ। মেনুতে কর্নফ্লেকস, সুইট কর্ন সুপ। অতিথিদের দরজা খুলে দেন উর্দি-পরা কর্মী। তেমন এক তরুণীকে ‘কত ক্ষণ ডিউটি?’ প্রশ্ন করতে সে নিচু গলায় বলল, “সকাল দশটা থেকে রাত ন’টা।” সে কী, এগারো ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকো? “না না, সাত ঘণ্টা দরজায়, চার ঘণ্টা অফিসে।”
মেয়েটি আশ্বাসের সুরে কথাটা বলল বটে, কিন্তু ভরসা মিলল কই? শপিং মলের রক্ষী, ঝলমলে দোকানে বিক্রেতা, বাড়িতে মাল ডেলিভারি দেওয়ার সংস্থার প্যাকিং-কর্মী, এঁদের চেয়ার দেওয়াই হয় না। ডিউটি মানে দাঁড়িয়ে ডিউটি। দিনের শেষে পা, কোমর, পিঠের অবস্থা কেমন হয়, আন্দাজ করা এমন কিছু কঠিন নয়।
নতুন চারটে শ্রম বিধির (লেবার কোড) একটার বিষয়, পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রের পরিস্থিতি (ওএসএইচডব্লিউ, ২০২০)। প্রথম ধাক্কা— ৮৬ পাতা দীর্ঘ বিধি দেশের ৮৬ শতাংশেরও বেশি শ্রমিককে রেখে দিয়েছে তার আওতার বাইরে। কোনও কর্মসংস্থায় (এস্টাবলিশমেন্ট) অন্তত দশ জন কর্মী, বা কারখানায় অন্তত কুড়ি জন (আগে ছিল দশ জন) থাকলে, তবেই বিধি মানতে বাধ্য হবে। ষষ্ঠ আর্থিক সেনসাস (২০১৩-১৪) অনুসারে, দশ জনের কম কর্মী কাজ করেন, এমন কর্মসংস্থা বা কারখানায় কাজ করেন শ্রমিকদের ৯৮ শতাংশ। ভারতে ছাপ্পান্ন কোটি রোজগেরে মানুষ, মাত্র সাত-আট কোটি সংগঠিত ক্ষেত্রে। বাকিদের কী হবে?
দ্বিতীয় ধাক্কা, কী হবে ঠিকাদারের মাধ্যমে নিযুক্ত কর্মীদের? মাটি কাটা, বাড়ি নির্মাণ থেকে ঝাঁ-চকচকে অফিসের ক্যান্টিন, সাফাই, এমনকি গেরস্তের আবাসনে পাহারা, সব কাজে এখন ঠিকাদারের মাধ্যমে লোক নিয়োগ হয়। আগে কুড়ি জন কর্মীকে নিয়োগ করলেই ঠিকাদারকে সরকারের কাছে নিজের নাম নথিভুক্ত করতে হত। নতুন বিধিতে গেরো আরও ফস্কা হয়েছে— ঊনপঞ্চাশ জন অবধি ছাড়। ঠিকাদার বৈধ না হলে তাঁর মাধ্যমে নিযুক্ত শ্রমিকও অবৈধ, অসুরক্ষিত। তার উপর শ্রম বিধিতে পরিযায়ী শ্রমিক আইন (১৯৭৯) ঢুকে পড়ে নিয়মের আশ্চর্য মায়াজাল তৈরি হয়েছে। ধরুন, আপনি ঠিকাদার ধরে চলেছেন তামিলনাড়ুতে সোনার গয়না তৈরির কাজ করতে। নতুন বিধি বলছে— যদি গয়না কারখানার মালিক দেখায় যে তাঁর কাছে কুড়ি জনের বেশি কর্মী কাজ করেন, যদি আপনার রোজগার আঠারো হাজার টাকার কম হয়, আর যদি আপনার ঠিকাদার সরকারের থেকে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট নিয়ে থাকেন, তবেই আপনি পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বৈধ, তাই কাজের জায়গায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দাবির হকদার। এ কি আইন, না উপহাস? এ সব শর্তের কোনটার উপর শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে?
আইনকে কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে না দিলে কী হয়, তার নিদর্শন পশ্চিমবঙ্গের ইটভাটা। দূরের গ্রাম, ভিন রাজ্য থেকে দাদন-নেওয়া হতদরিদ্র মানুষ কাজ করতে আসেন সেগুলোতে। ভাটার ভিতরে ছ’ফুট বাই সাত ফুট ঘরে থাকেন, যার দেওয়াল মানে ইটের পাঁজা, ছাদে ভাঙা টালি। প্রচণ্ড দাবদাহেও বেলা তিনটেয় কাঁচা ইট রোদে দেন। আজ অবধি কোনও ঠিকাদার সরকারি নথিতে নাম তোলেননি।পুরুষ মজুরদের নাম শুধু ঠিকাদারের খাতায় থাকে, মহিলা ও শিশু মজুরদের নাম কোথাও থাকে না। যাঁরা অদৃশ্য, তাঁদের আবার সুরক্ষা কী? শ্রম বিধি আইনের গণ্ডি ছোট করে আরও বেশি নারী-পুরুষের শ্রমকে অদৃশ্য করে দিল। তাঁদের সুরক্ষা আরও দুঃসাধ্য হয়ে উঠল।
আইনের সঙ্গে ন্যায়ের যদি বিন্দুমাত্র সম্পর্ক থাকে, তা হলে বলা দরকার ছিল যে এক জনও শ্রমিক যেখানে কাজ করেন, এমনকি শ্রমিক যেখানে নিজেই মালিক, সেই কর্মক্ষেত্রকেও হতে হবে স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত। ন্যূনতম মজুরিতে সব ধরনের শ্রমিকের অধিকার রয়েছে, এত অবধি মেনেছে শ্রম বিধি (মজুরি বিধি, ২০১৯)। অথচ, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা যে একটা ন্যূনতম প্রয়োজন, এমনকি অপরিহার্য, সে অবধি এগোতে পারল না। গিগ কর্মীরা সামাজিক সুরক্ষা বিধিতে স্থান পেলেও, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধিতে স্থান পাননি। দশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনলাইন অর্ডারের মাল দ্রুত ব্যাগে ভরছে তরুণ-তরুণীরা, যাতে দশ মিনিটে ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে যায় দুধ, ডিম, শ্যাম্পু, ব্যাটারি।
পুরনো শিল্পেও সঙ্কট বাড়ছে বর্তমানে। চিনা তাঁত আসার পর চটকল কর্মীরা এক সঙ্গে ছ’টা মেশিন চালান (আগে ছিল দুটো)। টার্গেট পূরণের চাপে ছ’সাত ঘণ্টা বসতে তো পারেনই না, শৌচাগারেও যেতে পারেন না। ‘নাইট ডিউটির পরে মনে হয়, পায়ে যেন প্যারালিসিস হয়ে গেছে,’ বলেছিলেন এক মহিলা চটকল কর্মী। ‘বাথরুমের কাজ বাড়ি থেকে সেরে আসবেন,’ শুনতে হয়েছে সোনারপুরের একটি কাপড়কলের মহিলা কর্মীদের। ‘সহজে ব্যবসা করা’ (ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস) সূচকে রাজ্যের এক-একটি ধাপ এগোনোর পিছনে রয়েছে কত না এমন যন্ত্রণাবিদ্ধ দিনরাত। এঁদের কি চিরকাল আইনের চৌকাঠের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে এই দুর্ভাগা দেশ?
তা কেন, রাজ্যের হাতেও তো রয়েছে আইন করার ক্ষমতা। কেরল ও তামিলনাড়ু— দুটো রাজ্য তো আইন করেছে যে শাড়ি-গয়নার শোরুমে, সুপারমার্কেটে কর্মীদের বসার চেয়ার দিতে হবে। ‘শপ্স অ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্টস অ্যাক্ট’ রাজ্যের আইন, শ্রম কোডের আওতার বাইরে। তামিলনাড়ু ওই আইনের সংশোধনীতে (২০২১) বলেছে, দশ ঘণ্টা পায়ের উপর দাঁড়িয়ে কাজ করায় পায়ের শিরা ফুলে, জড়িয়ে, ‘ভেরিকোজ় ভেন’ উপসর্গ দেখা দেয়। তাই কর্মীদের চেয়ার দিতে হবে। কেরলের সংশোধনীতে (২০১৮) বলা হয়েছে, প্রতিটি কর্মীর বসার ব্যবস্থা না করলে জরিমানা হবে নিয়োগকারীর। পশ্চিমবঙ্গে এই আইনের শেষ সংশোধনে (২০১৫) কর্মী ছাঁটাইয়ের আগে নোটিস দেওয়ার নির্দেশ যোগ হয়েছিল। স্বাস্থ্য-সুরক্ষার নির্দেশ মূল আইনে (১৯৬৩) ছিল না, এখনও নেই।
পশ্চিমবঙ্গের শ্রম দফতরের প্রাক্তন আধিকারিক, অধ্যাপক কিংশুক সরকার বলেন, “ন্যূনতম মজুরি সবার জন্য আবশ্যক করার উল্লেখ ছাড়া, আর কোনও ভাবে চারটি শ্রম বিধি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সুরক্ষা দেয়নি। শ্রমিক আন্দোলনেও তেমন জোর দেখা যাচ্ছে না, যা কেন্দ্রকে আইন বাতিল বা বদল করতে বাধ্য করবে। এখন একমাত্র উপায়, বিধানসভায় আইন করে অসংগঠিত শ্রমিকের মজুরি, ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।” এ বিষয়ে ‘মডেল’ হল মোট বাহক-সহ সব কায়িক শ্রমিকদের জন্য মহারাষ্ট্রের একটি আইন (মাথাদি হামাল আইন, ১৯৬৯)। যে শ্রমিকরা অপর কোনও আইনের দ্বারা সুরক্ষিত নন, তাঁদের যথাযথ মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে এই আইন।
পশ্চিমবঙ্গ কী করছে? শ্রম কোড মানবে না রাজ্য, বিধানসভায় বলেছেন শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। তাতে তো কথা ফুরিয়ে যায় না। আজ ঝালাই-মিস্ত্রি থেকে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, সকলেই চুক্তির কাজ, অ্যাপ-ভিত্তিক চাহিদা-নির্ভর কাজ, ঠিকাদার বা এজেন্ট-এর মাধ্যমে কাজ করছেন। এই বিস্তৃত, বিচিত্র কর্মক্ষেত্রের কেন্দ্রে স্থাপন করা চাই প্রতিটি কর্মীর সুস্থ থাকার অধিকার। কী শর্তে নিয়োগ, কে নিয়োগকর্তা, কত রোজগার, এ সব প্রশ্ন সরকারের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে নাম লেখানোর সময়ে করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে তা অর্থহীন। যেখানে এক জন মাত্র শ্রমিক কাজ করেন, সেখানেও তাঁর নিরাপত্তার অধিকার একশো শতাংশ। পরিবারকে দাঁড় করাতে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বসার চেয়ার দিতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)