কোনও ধর্মের সঙ্গেই চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সঙ্গতিসাধন সহজ নয়। আমাদের ধর্মমুগ্ধ দেশে তো বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে বিষয়টি একেবারে বাদ দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। মহান ধর্মনিষ্ঠ নেতারা বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে এমন সব চমৎকার যুক্তি দিয়ে থাকেন— কেউ কি কোনও দিন বানরের পেট থেকে মানুষের বাচ্চাকে জন্মাতে দেখেছে! সত্যি তো, কস্মিন্কালেও কেউ দেখেনি। ক্ষীরের পুতুল বা বুদ্ধু-ভূতুমের গল্পে অবশ্য মানুষ-মায়ের বানর-ছানার কথা আছে, কিন্তু সে সব হল রূপকথা, সত্যি তো নয়! (এটা লিখেই অবশ্য মনে প্রশ্ন জাগল, পুরাণ যদি ঐতিহাসিক সত্য হয়, রূপকথাই বা নয় কেন?) যা-ই হোক, ইদানীং গোটা পৃথিবীতেই যা ঘটছে, তাতে চার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, মানুষের আচরণই— বিশেষত ধর্মাচরণ— ডারউইনকে নতুন করে সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে।
বিবর্তনবাদীরা মানবসমাজের আধিপত্য-অধীনতা এবং সংঘাত-সংঘর্ষের শিকড় খুঁজতে গিয়ে অব্যবহিত পূর্বসূরি প্রাইমেট-সমাজের দিকে তাকান। বানরদের ‘পালের গোদা’ তথা ‘আলফা মেল’ যে সবার উপর মাতব্বরি করে সে তো সুবিদিত। শিম্পাঞ্জি-সমাজে ছোট ছোট ‘হায়ারার্কি’ থাকে। প্রত্যেকেই সমাজে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ‘এলিট’রা আত্মপ্রত্যয়ী হয়। নিম্নবর্গীয়রা উদ্বেগ-আতঙ্কে ভোগে, নইলে নেতার চেলা বনে যায়। শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাও চলে। প্রাইমেটোলজিস্ট ফ্রান্স দে ওয়াল ‘শিম্পাঞ্জি ম্যাকিয়াভেলিজ়ম’-এর কথা বলেছেন। রীতিমতো হিংস্র লড়াইয়ে ‘আলফা মেল’কে হয়তো ক্ষমতাচ্যুত করে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী শিম্পাঞ্জি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা।
কখনও আবার বিপ্লবও ঘটে। তানজ়ানিয়ার গোম্বে ন্যাশনাল পার্ক বহু প্রাইমেটোলজিস্টের গবেষণাক্ষেত্র, সেখানে এক বার মাইক নামে একটি ক্ষুদ্রাকৃতি কিন্তু বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জি ক্ষমতা দখল করে নেয় বেশ একটা মজাদার উপায়ে। গায়ের জোরে পারবে না বুঝে সে প্রাইমেটোলজিস্টদের ক্যাম্প থেকে ক্যানেস্তারা নিয়ে এসে সজোরে পেটাতে থাকে— আর তাতেই ক্ষমতাসীন ‘আলফা মেল’ ঘাবড়ে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
মাইকের ঘটনাটার কথা প্রথম পড়ি আমাদের কোনও এক নির্বাচনের মুখে। তখনই অনিবার্য ভাবে মানুষ-নেতাদের নির্বাচনী রোড শো, জনসভার বক্তৃতার কথা মনে আসে— নেতাদের পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসার মরিয়া উদ্যোগ! (মাইক অবশ্য রাজত্ব করেছিল তারও বেশি, বছর ছয়েক)। মানুষের রাজনীতির মূল প্রবণতায় বানরদের সঙ্গে সাদৃশ্য ভুল করার নয়। যতই গণতন্ত্রের গর্ব করি, প্রভুত্ব-দাসত্বভিত্তিক হায়ারার্কির সুগভীর মূল্যবোধ যাবে কোথায়! আর লক্ষ করতেই হয়, এমন একটি মতাদর্শের পূজ্য প্রতীকসমূহ নিয়ে উৎসব যাপনে ক্রমবর্ধমান ব্যগ্রতা। দলের সীমানা ছাড়িয়ে যায় এই উৎসবের বাধ্যবাধকতা— প্রবল প্রতিযোগিতামূলক ধর্মীয় রাজনীতির আবহে। তা ছাড়া অনুকরণ তো বানরের স্বভাবও বটে। অতএব রাম মন্দিরের পাল্টা জগন্নাথ মন্দিরও স্বাভাবিক। সব দেখেশুনে বিবর্তন তত্ত্বে সন্দেহ ঘুচে যেতে বাধ্য।
ধর্ম বিষয়টি মানুষেরই বিশিষ্ট উদ্ভাবনা। কিন্তু তার রাজনীতিকৃত চেহারাটা অন্য প্রাইমেট সমাজের হালচালেরই মতো। নেতাদের আগ্রাসন, চেলাদের অনুসরণ বা অনুকরণ। নেতারা প্রায়শ ভগবানেরই অবতার বলে গণ্য হন— কোনও নেতা তো নিজেকে ‘নন-বায়োলজিক্যাল’ বিশেষণ দিয়ে তেমনটাই দাবি করেন। না কি নেতারা রামদাস, আর চেলারা দাসানুদাস? নানা কিসিমের রাজনীতিতেই দেখি, যুযুধান নেতৃবৃন্দ মারা এবং মরার জন্য কেমন অনুপ্রাণিত করেন অনুচরদের। পক্ষ-প্রতিপক্ষের বানরসেনাদের চিৎকৃত আস্ফালন, দাঁত খিঁচিয়ে আর নিজের বুকে চাপড় মেরে পরস্পরকে ভয় দেখানো চলে। প্রাইমেট সমাজে এটাই হয়— স্বীয় গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে, অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে। বিভিন্ন দল ও স্তরের মানুষ-নেতা আর তাদের দাসদের দেখে আমাদের এই বিবর্তনিক উত্তরাধিকারটি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি না করে উপায় কী!
অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে অবশ্য স্বগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বগুলি একটু চাপা পড়ে যায়, সবাই মিলে ‘কামেন ফাইট, কামেন ফাইট’ করতে থাকে। লেগেও যেতে পারে একটা রক্তারক্তি লড়াই। মানুষের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভাজনের চেতনাসমন্বিত রাজনীতি সেই আগ্রাসনকে মহত্ত্ব ও বীরত্বের ব্যঞ্জনায় মণ্ডিত করতে পারে, এই মুহূর্তে দু’টি পাশাপাশি দেশে যার সাড়ম্বর প্রকাশ দেখছি। আর একটি দিকও লক্ষণীয়— কোনও গোষ্ঠীর কেউ/কয়েকজন একটা গর্হিত কাজ করলে তার/তাদের গোটা মহল্লাতেই আগুন লাগিয়ে দাও, দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে পুড়ে মরুক; রাবণকে শায়েস্তা করতে হনুমান যেমন স্বর্ণলঙ্কা পুড়িয়েছিল।
দে ওয়াল-এর লেখা পড়লে বোঝা যায়, আমরা মানুষরা একেবারে কপিবুক প্রাইমেট। বেবুন-শিম্পাঞ্জিরা আমাদের ভাই-বেরাদর। না, শুধু ভাই নয়, বোনও বটে। বেবুন-সমাজ অনেকটা মাতৃতান্ত্রিক, অন্তত ‘ম্যাট্রিলোকাল’— ‘আলফা মেল’-এর শাসন থাকলেও মেয়েরাই সমাজগোষ্ঠীর স্থায়ী সদস্য। সেখানেও ক্ষমতাশালিনী বেবুনরা অন্য মেয়েদের উপর আধিপত্য করে। শেষোক্তরা আতঙ্কে থাকে, তাদের প্রজননক্ষমতা কমে যায়, সেটা ক্ষমতাশালিনীদের আরও সুবিধে করে দেয়।
এটাও লক্ষণীয়, বানর-সমাজে যারা আধিপত্যকারী, অধীনদের দমন করার পাশাপাশি তারা কিন্তু কিছু পুরস্কারও দেয় নিজেদের ক্ষমতার স্থায়িত্বের লক্ষ্যে— আর, আমরা মানুষরা সে ব্যাপারটাও উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছি। সমাজবিজ্ঞানীদের জ্ঞাতার্থে বলি, ফুকোর ‘বায়োপাওয়ার’-এর মতো গ্রামশির ‘হেজেমনি’ও শুধু আধুনিকতা-প্রণোদিত নয়, দুটোরই শিকড় রয়েছে আমাদের গভীর ইতিহাসে। গোম্বেতে প্যাশন নামে একটি স্ত্রী-শিম্পাঞ্জি তার মেয়ে পমের সঙ্গে জুটি বেঁধে অন্যদের উপর দেদার অত্যাচার চালাত। তারা অন্য মায়েদের বাচ্চা কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলত, আর পরমুহূর্তেই শোকার্ত মায়েদের গায়ে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিত। প্যাথলজিক্যাল আচরণ? কেন, আমাদের শাসকরা ঠিক এ রকমটাই করেন না কি? এক দিকে শোষণ-পীড়ন, অন্য দিকে দয়াদাক্ষিণ্য এবং উৎসবে মাতিয়ে রাখা! আর ধর্ম হল উৎসবের সর্বোৎকৃষ্ট উপলক্ষ— অলঙ্ঘনীয়, অবশ্যপালনীয়। ধর্ম করতে গিয়ে যদি কুম্ভমেলার মতো স্ট্যাম্পিড হয়ে মরি, তা-ও সই!
একটাই ভাল খবর— আধিপত্য-অধীনতা মানুষের স্থায়ী প্রবণতা (‘হার্ডওয়্যার্ড’) নয়। আর পারস্পরিক দমন-পীড়নের প্রবণতা যদি বানর-পূর্বসূরিদের কাছ থেকে আমরা পেয়ে থাকি, মানুষ কিন্তু অনেক দিন শিকারি-জীবনও যাপন করে এসেছে। বানরের মতো ফলমূল সংগ্রাহকদের থেকে বাঘ-সিংহের মতো শিকারি প্রাণীরা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। শিকারের প্রয়োজনে সমঝোতা, সহযোগিতা তাদের মধ্যে খুব বেশি। এমনকি অত্যন্ত মারকুটে প্রাণী শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও বেশ বড় রকমের পারস্পরিকতা ও সহযোগিতা থাকে (স্ত্রী-শিম্পাজিদের মধ্যে বেশি থাকে)। মানুষ-প্রাইমেটেও এই গুণটি কিছুটা বর্তেছে বলেই মনে হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক ক্রিস্টোফার বোওম দেখিয়েছেন, প্রস্তরযুগেও দিব্যি গণতন্ত্র ছিল। তারা যে খুব ভালমানুষ ছিল তা নয়, অন্য গোষ্ঠীর লোকদের সঙ্গে খুব মারপিট করত, কিন্তু নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ দাপট দেখানোর চেষ্টা করলে সবাই মিলে তাকে আটকাত। কাজেই গণতন্ত্রও আমাদের উত্তরাধিকার বইকি!
একটা প্রশ্ন তবু থেকেই গেল। বিবর্তন তত্ত্ব নাহয় প্রতিপন্ন হল, কিন্তু বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মোটের উপর আমরা এগোচ্ছি না পিছোচ্ছি? খাড়া হয়ে দাঁড়ালাম, লেজ খসে গেল, ক্যানাইন দাঁত ছোট হয়ে গেল, সর্বোপরি মগজের আয়তন বাড়ল। কিন্তু ইদানীং আবার মানুষ থেকে বাঁদর হয়ে যাচ্ছি না তো? না কি, সেই অ্যামিবার আমল থেকেই স্বভাবচরিত্র ও জীবনদর্শনের দিক দিয়ে কখনওই খুব একটা এগোইনি আমরা? প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছড়াটাই কি উত্তর? “কালে কালে কতই হল/ সেই অ্যামিবা মানুষ হল/ মরার বাড়া গাল জানে না/ তবু ওড়ায় ঘুড়ি/ কোনও কালে থামবে কি তার আদিম সুড়সুড়ি?/ চোখ গজাল কান গজাল/ আরও কত কি!/ পণ্ডিতেরা বলে সবই ভস্মে ঢালা ঘি!/ কিছুই হয় না মানে।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)