Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
অতিমারির ইতিহাস থেকে মানুষ সতর্কতার কোনও শিক্ষা নেয়নি
Pandemic

প্রাণ বাঁচাবে প্রাণের ভয়

অতীতে এর চেয়েও প্রাণঘাতী মহামারি পৃথিবী দেখেছে। কিন্তু তার ব্যাপ্তি ছিল তুলনায় সীমাবদ্ধ। আবার এর চেয়ে অধিক সংক্রামক মহামারিও এসেছে।

সুগত লাহিড়ী
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২২ ০৪:২৫
Share: Save:

ভুবনবিদিত সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দ্য লেসনস অব দ্য প্যানডেমিক’ শীর্ষক একটি নিবন্ধের ভূমিকার অংশটুকু অনুবাদ করলে এ রকম দাঁড়াবে: পৃথিবীব্যাপী সদ্য বয়ে যাওয়া অতিমারির ঝড়টি এক কথায় নজিরবিহীন। অতীতে এর চেয়েও প্রাণঘাতী মহামারি পৃথিবী দেখেছে। কিন্তু তার ব্যাপ্তি ছিল তুলনায় সীমাবদ্ধ। আবার এর চেয়ে অধিক সংক্রামক মহামারিও এসেছে, কিন্তু তাদের মারণক্ষমতা ছিল অপেক্ষাকৃত সীমিত। বন্যা, ভূমিকম্প, মন্বন্তর, আরও নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ পৃথিবীর বুকে তাদের ধংসের ইতিবৃত্ত লিখে গিয়েছে, কিন্তু এত অকস্মাৎ, এত সর্বব্যাপী বিপর্যয় এর আগে কখনও আসেনি। সহসা কোথা থেকে এর উৎপত্তি, রোগটির প্রকৃত স্বরূপ কী, আর কী করেই বা এর নিবারণ সম্ভব, পুরোটাই যেন আগাগোড়া রহস্যাবৃত। এর পরের ঢেউয়ের আশঙ্কায় দুশ্চিন্তার শেষ নেই আজ।

এই পর্যন্ত পড়ে ভাবতেই পারেন, এ আর নতুন কথা কী? গত দু’বছরে কোভিডের দুর্বিপাকে জীবন ও জীবিকা দুই-ই হারিয়ে, এ তো মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। এমন কথা ভাবলে তা যুগপৎ ঠিক এবং ভ্রান্ত। ভ্রান্ত, কারণ সায়েন্স পত্রিকার এই নিবন্ধটি কোভিড-১৯’এর প্রসঙ্গে লেখা নয়। এটি প্রকাশিত হয়েছিল শতাধিক বছর আগে, স্প্যানিশ ফ্লু নামক বিধ্বংসী অতিমারির পর। লেখক জর্জ সোপার সেই সময়ের এক প্রখ্যাত মহামারি বিশেষজ্ঞ। ১৯২৩ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত সোপার ‘আমেরিকান সোসাইটি ফর দ্য কন্ট্রোল অব ক্যানসার’-এর কর্ণধার ছিলেন।

আবার পাঠকের এই ধারণা ঠিকও বটে, কারণ প্রকৃতপক্ষে কিছুই বদলায়নি। এই একশো বছরে আমরা স্টিম ইঞ্জিন থেকে সার্চ ইঞ্জিনে পৌঁছেছি, বিজ্ঞান এগিয়েছে আলোকসদৃশ গতিতে, কিন্তু দীর্ঘ শতবর্ষ পেরিয়েও কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিল যে, আর একটি শ্বাসবাহিত অতিমারির সামনে আমরা সমান বেসামাল, অসহায়। যদি এ কথা অতিশয়োক্তি মনে হয়, তবে একটি মাত্র দৃষ্টান্তের দিকে তাকালেই আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থাটি পরিষ্কার বোঝা যাবে। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত জর্জ সোপারের নিবন্ধটিতে যে কয়েকটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একটি হল, শুধুমাত্র সংক্রমিত, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরই মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন, বাকিদের নয়। সুতরাং জনসাধারণের জন্য মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা অনুচিত হবে। আর ইতিহাসের ঠিক এই পাতাটি কুড়িয়ে নিয়েই কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই শুরু হল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মহল থেকে পরামর্শ দেওয়া হল যে, শুধুমাত্র সংক্রমিত ব্যক্তিই যেন মাস্ক ব্যবহার করেন, বাকিদের মাস্ক ব্যবহার অপ্রয়োজনীয়। জোর দেওয়া হল শুধু দূরত্ববিধি এবং হাত ধোয়ার উপরে। যখন কয়েক জন বিজ্ঞানী শ্বাসবাহিত রোগে সকলের জন্য মাস্কের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন, তখন এল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেই ঐতিহাসিক টুইট-ঘোষণা, যাতে বলা হল কোভিড-১৯ বাতাসবাহিত রোগ নয়। এ রোগ মূলত ছড়ায় ‘ড্রপলেট’ বা ক্ষুদ্র তরলকণার মাধ্যমে। এরোসল বিশেষজ্ঞ এবং অন্য বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানীদের প্রভূত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের কণা যে মূলত এরোসল স্প্রে-র মাধ্যমে ছড়ায় এ কথা বুঝতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোলের লেগে গেল দীর্ঘ এক বছর।

সর্বাপেক্ষা পরিতাপের বিষয়টি হল, সোপারের সেই নিবন্ধে যে দু’টি বিষয় ছিল বিশেষ অনুধাবনযোগ্য, সেগুলির প্রতি আমরা সম্পূর্ণ উদাসীন রইলাম। তার মধ্যে একটি হল, এই ধরনের শ্বাসবাহিত মহামারি ঠেকাতে প্রয়োজন বিজ্ঞাননির্ভর, যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের পর দীর্ঘ এক শতাব্দী অতিক্রান্ত, তবুও কোভিডের আক্রমণের সামনে প্রায় প্রতিটি দেশের প্রশাসনের অপ্রস্তুত অবস্থাটি বুঝতে বাকি রইল না। ইটালি, স্পেন, ব্রিটেন, এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশেও হুহু করে ছড়িয়ে পড়ল কোভিড। বিজ্ঞানবিমুখতার চূড়ান্ত নিদর্শন পাওয়া গেল যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দিলেন কোভিডের চিকিৎসায় শৌচালয় পরিষ্কারের জীবাণুনাশক তরলটির ইঞ্জেকশন দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে। ট্রাম্পের মতো অতখানি না হলেও আমরা খুব পিছিয়ে থাকিনি। এক দিকে হাজার হাজার চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীকে পিপিই কিটের ন্যূনতম সুরক্ষা ছাড়াই কোভিড যুদ্ধে নামিয়ে দেওয়া হল, অন্য দিকে আমরা কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে আর প্রদীপ দেখিয়ে করোনা বিতাড়নের চেষ্টা করলাম। কোনও রকম পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ লকডাউন করে দেওয়া হল। পরিণাম— অভূতপূর্ব দুর্ভোগ ও মৃত্যু।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি সম্পর্কে সোপার বিশেষ ভাবে সতর্ক করেছিলেন, তা হল রোগ প্রতিরোধের জন্য আবশ্যক সতর্কতাবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে মানুষের অনীহা। জর্জ সোপারের মতে এটিই হল সংক্রমণ প্রতিরোধের পথে প্রধান অন্তরায়। গত দু’বছরে আমরা বারংবার দেখলাম যে, বহু মানুষ সমস্ত সতর্কতাবিধি তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। মাস্কটি শিকেয় তুলে অথবা সেটিকে চিবুক-ত্রাণ করে পালা-পার্বণে তো বটেই, কারণে-অকারণে বৃথা-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়াটাই আশু কর্তব্য জ্ঞান করছে।

গত কয়েক দশকে মনস্তত্ত্বের গবেষণা নিশ্চিত বিপদের মুখে মানুষের অসতর্ক আচরণের রহস্য অনেকটাই উন্মোচন করে দিয়েছে। সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই আমেরিকার ‘ন্যাশনাল টিউবারকিউলোসিস অ্যাসোসিয়েশন’ এবং আমেরিকান সরকারের ‘পাবলিক হেলথ সার্ভিস’-এর যৌথ গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, স্বাস্থ্য এবং সতর্কতাবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে শুধু প্রচারই যথেষ্ট নয়। যত ক্ষণ না মানুষের মনে বিপদের আভাস এবং শঙ্কাবোধ তৈরি হচ্ছে, তত ক্ষণ অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীন থাকে। আমেরিকান সরকারের ‘পাবলিক হেলথ সার্ভিস’-এর এই গবেষণার মডেলটির প্রয়োগ পরে ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিয়ো, ক্যানসার, এইচআইভি-সহ নানাবিধ রোগের ক্ষেত্রে হয়েছে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে এই মডেলটি প্রয়োগ করা যায় কি না, সেই বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গত দু’বছরে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। এ দেশেও অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি ও আইআইটি মাদ্রাজের গবেষকদের একটি দল কোভিড-১৯’এর প্রথম পর্যায়ের লকডাউনের সময় এই বিষয়ে গবেষণা চালান। গত বছর আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত সেই গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, কোভিড সতর্কতাবিধি মেনে না চললে সহজেই সংক্রমণ হতে পারে, এই তথ্যটুকু জানালেই যে মানুষ সতর্ক হবে, এমনটা নয়। এর জন্য প্রয়োজন শঙ্কাবোধ ও বিপন্নতার অনুভূতি। বিপদের সচেতন বিশ্লেষণ নয়, বিপদের অনুভূতিই মূলত নির্ধারণ করে দেয় কে কতটা সতর্কতাবিধি মেনে চলবেন।

স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারির সময় ইনফ্লুয়েঞ্জার কোনও কার্যকর প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয়নি। কোভিড-১৯’এর সময়েও দীর্ঘ এক বছর আমাদের আয়ুধে কোনও টিকা ছিল না। পরের এক বছরে কোভিড-১৯’এর টিকা আমাদের হাতে এসেছে, এবং তার বিপুল প্রয়োগও হয়েছে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হাজির হয়েছে কোভিড-১৯’এর নতুন নতুন রূপ, যেগুলির বিরুদ্ধে প্রথম প্রজন্মের প্রতিষেধক আর ততটা কার্যকর নয়। আজ পিছনে তাকিয়ে দেখলে মনে হয় জর্জ সোপার যে জোর দিয়েছিলেন মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতাবিধির উপর, এবং এটিকেই অতিমারির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ বলে উল্লেখ করেছিলেন— তা অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু আমরা সে পাঠ বিশেষ নিয়েছি বলে মনে হয় না। বিগত কয়েক দশকে এই বিষয়ে গবেষণালব্ধ তথ্যের প্রয়োগ আমরা কোভিড-১৯’এর ক্ষেত্রে দেখলাম কোথায়?

সার্স এবং মার্স মহামারি ঘটে গিয়েছে গত কুড়ি বছরে। সৌভাগ্যের কথা যে, এর কোনওটিই মহামারি থেকে অতিমারিতে পরিণত হয়নি। পরবর্তী অতিমারির আক্রমণের আগে ইতিহাস থেকে শিক্ষা যদি আমরা গ্রহণ না করি, তবে থেকে যাব সেই তিমিরেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pandemic World
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE