E-Paper

বাংলা নামে দ্বেষ

বাংলা-বাঙালির মানমর্যাদার প্রশ্নটা এখন অত্যন্ত জরুরি করে তোলা দরকার— শুধু ভোটের রাজনীতিতে নয়, আরও বড় করে প্রতি দিনের রাজনীতিতে।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৫ ০৫:২৯

নাসিমার এখন দিন কাটছে গভীর আতঙ্কে। কবে থেকে সে বাড়ি বাড়ি কাজ করে দুই ছেলে মানুষ করে দিন কাটিয়েছে। আজ এ কী কাণ্ড শুরু হল। কাগজ দেখিয়ে ভোটের নাম তুলতে হবে, এ দিকে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড নাকি চলবে না। যেখানে সে থাকে, পঁচিশ বছর আগেও তার বাবা-মা ওখানেই থাকত। তারও পঁচিশ বছর আগে বাবা-মা কোথায় ছিল, অত কথা নাসিমা জানে না, তারাও আর বেঁচে নেই। বলতে বলতে দুশ্চিন্তায় কাঠ হয়ে যায় সে, ‘কী হবে দিদি’। আবার লজ্জাও পায় এত কথা বলে ফেলে। আশ্বাস দেওয়ার ছল করি, বোঝাই যে, সে একা নয়। ‘ভেবো না নাসিমা, আমাদের সকলেরই তো কাগজ দেখাতে হবে।’ নাসিমার চোখে সে আর আমি কখনও এক নই, তাই জড়োসড়ো ভাবে উল্টে সে আমাকেই প্রবোধ দেয়: ‘দিদি তোমাদের বাঙালিদের চিন্তা নেই, আমরা মুসলমান বলেই যে এত গোলমাল।’

থমকে যাই। ‘কী বলছ নাসিমা, আমরা বাঙালি, তুমি বাঙালি নও? তুমি কী তবে?’ চোখে জল এসে যায় তার, ‘কী বলব দিদি, আমি তো জানতাম আমি বাঙালি, বাংলা ছাড়া কিছু জানি না, হিন্দি বলতে পারি না, কিন্তু পাড়ায় যে সকলে বলছে মুসলমানরা বাঙালি নয়, আমাদের তাড়িয়ে দিতেই এত কিছু?’

সেই নাসিমাই পরের দিন আবার দৌড়ে আসে। হরিয়ানায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে তার ছেলে জাহির, তাকে নাকি এমন পিটিয়ে বস্তি থেকে বার করে দিয়েছে যে সে এখন গুরুতর আহত। অনেক লোক মিলে ওকে মেরেছে ‘বাঙালি’ বলে, বলেছে এখনই বাংলাদেশে না চলে গেলে ‘জানে মেরে দেবে’।

ব্যবস্থা তা হলে ভালই। রাজ্যে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে নাসিমারা, ‘বাঙালি নয়’ বলে। আর অন্য রাজ্যে ভয়ে দিশাহারা নাসিমার ছেলেরা, ‘বাঙালি’ বলে। ঘরে-বাইরে ‘বাঙালি’ পরিচয় নিয়ে এই টানাটানির রাজনীতি— ১৫ অগস্ট বাংলা ভাগের ৭৮ বছরে পশ্চিমবঙ্গকে এখানে নিয়ে এল ভারত।

এ ‘কৃতিত্ব’ আমাদের শাসকদের, হিন্দুভারতের উদ্গাতাদের। ‘মুসলমান’ বিষয়টা দিয়ে তাঁরা দেশবাসীকে এমন অন্ধ করে দিয়েছেন যে, যেখানে যা মিলছে, সেটাকেই চেপে ধরে রাজনীতির অস্ত্র বানিয়ে শাণ দেওয়া চলছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এক অস্ত্র, পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে আর এক।

অন্ধ না হলে বাংলায় লেখা সরকারি পরিচিতিপত্র নিয়ে পুলিশ বলতে পারে, এটা বাংলাদেশি ভাষা, বাংলাদেশে চলে যাও? অন্ধ না হলে বিনা তদন্তে শ্রমজীবী মানুষদের ও তাঁদের পরিবারকে তুলে নিয়ে আটকে রাখে দিনের পর দিন? জোর করে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া যায়?

বাংলা ভাষাকে কেন বাংলাদেশি বলা হবে, এই নিয়ে এখন উত্তাল রাজ্য। আটাত্তর বছরের পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে বাঙালির সম্মান ও অধিকার রক্ষা করতে পারে, দেখা যাক। ‘বাঙালি অস্মিতা’ কথাটার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সৌজন্য’-এ এখন দলীয় রাজনীতির কড়া গন্ধ, কিন্তু তবুও, এত বড় শব্দ চয়ন না করেও স্পষ্ট বলা চাই: বাংলা-বাঙালির মানমর্যাদার প্রশ্নটা এখন অত্যন্ত জরুরি করে তোলা দরকার— শুধু ভোটের রাজনীতিতে নয়, আরও বড় করে প্রতি দিনের রাজনীতিতে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের বার্তা: কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা-সাম্রাজ্যবাদী অভিযান ঠেকাতে হবে এখনই।

কিন্তু এই লড়াইয়ে (বা, এই রাজনীতিতে) অন্য একটা কথাও এসে পড়ে যে! ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের জের তো দেখছিই, পরীক্ষায়, সরকারি কাজে আঞ্চলিক ভাষার বদলে হিন্দি চাপানো হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা, হরিয়ানা দিল্লি রাজস্থান মহারাষ্ট্রে বাঙালিদের উপর যে নির্যাতন চলছে, তামিল তেলুগু ওড়িয়াদের উপরে কিন্তু তেমন নেই। কেন, সেটা ভাবতে গিয়ে স্ট্যালিনের কথাটা ‘ঠিক’ হলেও ‘যথেষ্ট’ নয়। না, এ শুধু ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের বিষয় নয়। ভিন রাজ্যে বহু ‘বাঙালি’ কাজ করছে অনেক কাল ধরে। আজ যা ঘটছে, তার মূলে যে তীব্র ক্রোধ, বিদ্বেষ, ঘৃণার বিষাক্ত উদ্গিরণ, কার দিকে তার অভিমুখ, সেও কি আর বলে দিতে হয়?

মুসলমান। সত্যিটা এখানেই। বাংলা/বাঙালির উপর আজ যে দেশজোড়া আক্রমণ, তার প্রধান কারণ, বাঙালির সঙ্গে মুসলমান পরিচয় আজ এক হয়ে যাচ্ছে। বাংলাভাষী মানেই মুসলমান, তাই, হয় সে বাংলাদেশি, নয়তো এখনই তার বাংলাদেশি হওয়া উচিত। এর মধ্যে যতটা ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’, ততটাই, বা তার থেকে বেশি ‘হিন্দু সাম্রাজ্যবাদ’। এই ভাবনা থেকেই দিল্লিতে অমিত মালবীয় বলেন, বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই, আছে কেবল বাংলাদেশি ভাষা। আর পশ্চিমবঙ্গে বসে, মুসলমান মানেই যথেষ্ট বাঙালি নয়— এটা বোঝাতে শমীক ভট্টাচার্য বলেন, হিন্দুর বাংলা আর মুসলমানের বাংলা আলাদা। যেন তিনি বা তাঁরা আদৌ বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবিত! যেন তাঁদের আদৌ সেই ভাবনার অধিকার আছে! যেন মুসলমান কাঁটা ওপড়ানো আর সেই সূত্রে সমগ্র বাঙালি সমাজের উপর চাপ দেওয়া ছাড়া তাঁর ও তাঁদের আর একটিও কাজ আছে!

এইখানে এসে নাসিমা আর জাহিরের গল্পগুলো মিলে যায়। তারা মুসলমান, তাদের আলাদা বা ‘অপর’ করে দেওয়ার জন্য অস্ত্র চাই। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, সেই অস্ত্র বানিয়ে নিতে হবে বাংলা ভাষাকে। আর পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে, সেই বাংলা ভাষাকেই অস্ত্র করে মুসলমানকে কেটে ফেলে দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অমুসলমান বাঙালিও বিপন্ন হয়ে পড়ছে। আরও পড়বে, কেননা পুরো পশ্চিমবঙ্গের উপরেই এখন বিজেপি ভারত ক্রোধান্ধ। তবে আক্রমণের মূল লক্ষ্য কে বা কারা, তা নিয়ে সন্দেহ চলে না।

এই পরিস্থিতিতে বাঙালি মুসলমান কী করবে, এটা বড় প্রশ্ন। কিন্তু বাঙালি হিন্দু কী করবে, সেটা আরও বড় প্রশ্ন। চার দিকে এখন সাজো-সাজো রব, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্তিমিত, প্রায় অস্তমিত, প্রবাহ যেন আবার গতি পেয়ে প্রবল বেগে বহমান। সেই স্রোতে এই কথাটাকেও কিন্তু সমান গুরুত্বে, সমান সম্মানে ভাসতে দিতে হবে, এড়িয়ে গেলে চলবে না যে— বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান বাঙালি সমাজ ও বাংলা ভাষার সমান অংশীদার, ‘স্টেক-হোল্ডার’। এ কোনও জনসংখ্যার শতাংশের হিসাব নয়, এটা অনেক শতকের ইতিহাসের হিসাব, এই ভাবেই বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে, এ কোনও কাব্যসাহিত্য সঙ্গীতসংস্কৃতির সত্য নয়, এটা একেবারে মাটির সত্য, শ্রমের-ঘামের সত্য, গ্রামজীবন শহরজীবনের প্রাত্যহিকতার সত্য।

এর পরেই যে প্রশ্নটা ধেয়ে আসছে, তার উত্তরটা এখনই দিয়ে রাখা দরকার। হ্যাঁ, দেশভাগ আর বাংলাভাগের পরও এই হিন্দু-মুসলমান যৌথ বা মিশ্র চরিত্রটা রয়েই গিয়েছে বাংলা ও বাঙালির মধ্যে। ১৯৪৭-পূর্ব অবিভক্ত বাংলার মতোই ১৯৪৭-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গেও অগণিত মুসলমান বাঙালির বাস— স্বাভাবিক ভাবেই, কেননা পাকিস্তান দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সে দিন যে দেশভাগ হয়, তাতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রতিশ্রুতিটিই জ্বলজ্বল করছিল। তার চেয়েও বড় কথা, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর অনুপাত বদলালেই ভাষা সংস্কৃতি সমাজের চরিত্র বদলে যায় না। অনেক দিনের পাশাপাশি চলার ফলে তা তৈরি হয়। বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে আজ সংখ্যালঘুর সংখ্যা হঠাৎ শূন্য হয়ে গেলেও দুই দিকেই বাঙালি জীবনের হিন্দু-মুসলমান মিলিত ঐতিহ্য খোদাই করা থাকবে।

ঠিক এই কারণেই, পরাধীন ভারতে ধর্ম-ধর্ম উন্মাদনার পরও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ-ভাগাভাগিটা সম্পূর্ণ করা যায়নি, কেননা ওই ভাবে মাটির ভিতরে শিকড়ে-শিকড়ে জড়ানো সমাজ-সংস্কৃতি উপড়ে ফেলা অসম্ভব। উনিশশো বিশ-ত্রিশ-চল্লিশের দশকে বাংলার ইতিহাস এও বলে, সে দিন যখন ধর্মের অন্ধতা তীব্র হয়ে উঠছিল, তখন বাঙালির এক বিরাট অংশ— হিন্দু ও মুসলমান দুই সমাজেই— এই ভাষাসংস্কৃতির যোগের জোরে বাংলা সত্তার কথা বলছিলেন। দেশভাগের পরিকল্পনায় বড় বাধা ও বিরোধিতা তৈরি হয়ে উঠেছিল বাংলাতেই, ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রের কথা উঠে এসেছিল প্রবল ভাবে, যে কথাগুলি ব্রিটেন ও দিল্লির যুগপৎ ঔপনিবেশিক চাপে দ্রুত হারিয়ে যায়। বাংলাই সেই ভাষা-সংস্কৃতি, যা নিয়ে পোস্ট-কলোনিয়াল যুগেও ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ দেখেছে এই উপমহাদেশ।

এই সব ইতিহাস আজ ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে যে, অনেক চ্যালেঞ্জ ও সংঘাত মধ্যেও ১৯৪৭-এর পর ভারতীয় রাষ্ট্র দিতে চেয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, ভাষানিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার পরিসর। আর এখন আমরা দেখছি উগ্র অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদে ফেরার ডাক। সেই ডাক এখন পশ্চিমবঙ্গেও। ঠিক যেমন ইসলামি মৌলবাদ বার বার বাংলা ভাষাকে ‘হিন্দু’ বলে দাগিয়ে উর্দু চাপানোর চেষ্টা করেছে, আজ হিন্দু মৌলবাদ বাংলা ভাষাকে ‘মুসলমান’ বলে দাগিয়ে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা করছে। শমীক ভট্টাচার্যরা মুখে যতই বলুন, এই বাংলাকে ‘বাংলাদেশ হতে দেব না’, আসলে ঠিক উল্টোটাই তাঁরা করছেন, বাংলাদেশের মধ্যে আজ যে উগ্র ইসলামি রাজনীতি, তারই আয়না-প্রতিফলন তাঁদের ভাবনায়।

সুতরাং, এ কেবল বাঙালি অস্মিতার সাংস্কৃতিক প্রশ্ন নয়। ভাষা-সংস্কৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার চলছে, চলুক। তবে, এটা এখন পশ্চিমবঙ্গেরই অস্মিতার রাজনৈতিক প্রশ্ন। তাই বিচারটাকে হতে হবে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। কোন রাজনীতি চাই, কোনটা চাই না, সেইটাই আজ আসল কথা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Bengali Migrant Worker Minority

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy