সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত ওবিসি সংরক্ষণ সংক্রান্ত জটিলতা কাটল। কিন্তু, ইতিমধ্যেই রাজ্যের কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি প্রক্রিয়া অতিশয় বিলম্বিত। শিক্ষা মহলের ধারণা, এর জেরে চলতি শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে পড়ার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পড়ুয়া পাওয়া যাবে না। আশঙ্কাটিকে কোনও মতেই অমূলক বলা চলে না। দ্বাদশ শ্রেণির ফল প্রকাশের দীর্ঘ দিন পরেও ভর্তির কূলকিনারা না পেয়ে বহু পরীক্ষার্থী ভিনরাজ্যমুখী; অথবা রাজ্যেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি নিয়েছে রাজ্যের স্বশাসিত এবং সংখ্যালঘু কলেজগুলি। এই সব কলেজ অভিন্ন পোর্টালে ভর্তি প্রক্রিয়ার অধীন নয়। যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে রাজ্যের সিংহভাগ কলেজের যে অধিকাংশ আসন শূন্যই থাকবে, তা এক রকম নিশ্চিত। তবে চলতি বছরের এই পরিস্থিতি কি একেবারে নতুন? তা বোধ হয় নয়। বছর কয়েক ধরে দেখা যাচ্ছে এই আসন শূন্য থাকার প্রবণতা। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর কলেজে আসনসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু ছাত্র ভর্তির আগ্রহ বাড়েনি। উপরের সারির কলেজের আসন কোনও ক্রমে ভরে গেলেও তার পরের সারির কলেজগুলিতে ক্লাসঘর প্রায় ফাঁকা পড়ে থাকা গত কয়েক বছর ধরে দস্তুর হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে দেখা যাচ্ছিল যে, দর্শন, সংস্কৃতের মতো বিষয়ে আসন ভরছে না। স্বভাবতই তখন ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছিল, যে বিষয় পড়ে জীবিকার রাস্তা সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়, সেই বিষয় কেউ পড়তে চান না। ধীরে ধীরে রাজ্যের মধ্য মানের কলেজগুলিতে অর্থনীতি বা পদার্থবিদ্যা, রসায়নের মতো বিষয়েও আসন ফাঁকা থাকতে শুরু করে। শহরতলির এক কলেজে গত দু’বছর অর্থনীতির স্নাতক কোর্সে এক জন পড়ুয়াও ভর্তি হননি। এই ধরনের উদাহরণ অজস্র।
গত শিক্ষাবর্ষ থেকে এই রাজ্যে অভিন্ন পোর্টালের মাধ্যমে স্নাতক স্তরে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে দেখা যায়, এই পোর্টালের প্রায় সাড়ে ন’লক্ষ আসনের মধ্যে সাড়ে চার লক্ষ আসনই ফাঁকা। অভিজ্ঞতা বলছে, এ রাজ্যের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ডিগ্রি কোর্স পড়েন মূলত স্কুল-শিক্ষকতা করার জন্য। গত কয়েক বছরে এই রাজ্যে স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগের যে দুর্নীতির ঘনঘটা, তাতে শিক্ষক হওয়ার আশা বহু পড়ুয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়াও রাজ্যে অন্য চাকরির সুযোগ খুবই কম।
অধ্যক্ষদের পর্যবেক্ষণ, যাঁরা কলেজে ভর্তি হন, হালে তাঁদের অনেককেই কলেজে আর দেখা যায় না। অধ্যক্ষদের একাংশের বক্তব্য, যাঁরা ভর্তি হন, তাঁদের একটা বড় অংশ সরকারের যে সব স্কলারশিপ রয়েছে সে সব পেতেই ভর্তি হন। পাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হলে আর তাঁদের কলেজে দেখা যায় না। তিন দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক কলেজ শিক্ষিকা সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেছেন, যেখানে তাঁর প্রশ্ন, তিনি পড়ুয়াদের কাছে সহজবোধ্য ভাবে পড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করার পরেও তাঁর ক্লাস ফাঁকা থাকে কেন? পড়ুয়াদের কাছে কি তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমছে? না কি অন্য কোনও আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে? দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক কলেজের অধ্যক্ষ জানালেন, তাঁর মনে হয়েছে পড়ুয়াদের ক্লাসে ফেরাতে যদি এলাকায় মাইকিং করা যায়, তাতে হয়তো কিছুটা সুফল ফলতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উৎসাহের ঘাটতি কী ভাবে শিক্ষকদেরও প্রভাবিত করছে, তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই তার উদাহরণ মেলে।
চলতি বছর ওবিসি সংক্রান্ত মামলার জেরে ভর্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়েছে। আদালতের রায় জানতে না পেরে বার বার আবেদনের দিন বাড়ানো হয়েছে— সোমবার ২৮ জুলাই শেষ অবধি অচলাবস্থা কাটল। তবে তাতে আবেদনের সংখ্যায় বিরাট কোনও হেরফের হবে না বলেই অভিজ্ঞদের মত। এমনকি দেশের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও কলা ও বিজ্ঞান বিভাগে এ বার আবেদনের সংখ্যায় ভাটা। বেশকয়েক বছর ধরে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বিষয়ে আসন ফাঁকা থাকছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধীন এক কলেজের অধ্যক্ষ জানালেন, তাঁর কলেজে মোট আসন ১৫০০। আবেদনের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, সাকুল্যে ২০০ জনের মতো এই কলেজে ভর্তিকে প্রথম পছন্দে রেখেছেন।
এর সঙ্গে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী এখন অনার্স কোর্স তিন বছরের পরিবর্তে চার বছরের। চাকরিই যদি না পাওয়া যায়, তা হলে কলেজে চার বছর পড়ে কী হবে— এই ভাবনাও কাজ করছে। ফলে কলেজগুলি ক্রমে ছাত্রশূন্য হয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের বাইরে গিয়ে পেশাগত কোর্সে পড়ার ঝোঁক কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু হালে ডিগ্রি কোর্স করতেও অনেকে পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে। যাঁরা তাও পারছেন না, অথবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোটা টাকা দিয়ে ভর্তি হতে পারছেন না, তাঁরা কী করবেন? তাঁরা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)