গত পয়লা মে বিলেতে লিভারপুল শহরের কাছের এক জনপদ রানকর্ন আর হেলসবি আসনে সংসদীয় উপনির্বাচন হল। সামান্য উপনির্বাচন, তবু দু’টি কারণে বহির্বিশ্বের চোখে পড়ার মতোই ঘটনা ঘটেছিল সেই রাতে। সারা পোচিন জিতলেন মাত্র ছয় ভোটে। এই স্বল্প ব্যবধানের থেকেও বেশি গুরুত্বের খবর— সারা পোচিন হলেন ‘রিফর্ম ইউকে’ দলের সদস্য। রিফর্ম ইউকে দলটি গড়ে ওঠে ২০২৪ সালের বিলেতে সাধারণ নির্বাচনের আগে; প্রতিষ্ঠাতা, দলনেতা— স্বনামধন্য নাইজেল ফ্যারাজ। দলটি তাঁর পুরাতন দল ইউকিপ (ইউ কে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি) বা অধুনালুপ্ত ব্রেক্সিট পার্টির মতোই, কোনও রাখঢাক না রেখে চরম দক্ষিণপন্থা মেনে চলে।
মে মাসের সেই প্রথম রাতে বিলেতে এক সঙ্গে আরও অনেকগুলো নির্বাচন হয়েছিল; মোট তেইশটি ছোট শহরের কাউন্সিল বা পুরসভা এবং ছ’টি বড় এলাকার মেয়র পদের জন্যও। এই তেইশটা পুরসভায় সব মিলিয়ে ১৬৪১ আসনের মধ্যে সাকুল্যে ৬৭৭টি জিতে, দশটা কাউন্সিলের দখল নেয় রিফর্ম; আর, ছ’টার মধ্যে দু’টি এলাকার মেয়র পদ। প্রসঙ্গত, সেই রাতের জয়ের পুরোটাই রিফর্ম দলের পক্ষে শূন্য থেকে শুরু।
বিলেতের সংসদে এই উপনির্বাচনে জয়ের ফলে রিফর্ম ইউকের আসনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল পাঁচ। দেশের ৬৫০-এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি আসন, তবু লক্ষণীয়, ফ্যারাজ বলেই চলেছেন, এই শুরু, রিফর্ম ইউকে আরও আরও এগোবে। অনেকেই আগে হাসতেন, পয়লা মে-র ফলাফল দেখে, তাঁরা হাসি বন্ধ করেছেন। সংবাদমাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা মেনে নিচ্ছেন, আশঙ্কা আর অমূলক নয়।
তৃতীয় দল হিসাবে লিবারাল ডেমোক্র্যাট (লিব-ডেম)-এর অস্তিত্ব থাকলেও, বিলেতের সংসদে চিরকালই দুই প্রধান দল লেবার আর কনজ়ারভেটিভের লড়াই হয়ে এসেছে। এ বারই প্রথম, এই উপনির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, বাস্তবে এখন দ্বিমুখীর বদলে পঞ্চমুখী লড়াই— গ্রিন পার্টি আর রিফর্ম ইউকে নিয়ে।
বহু দল বিশিষ্ট সংসদে আপাত-ক্ষুদ্র সংখ্যারও ক্ষমতা যে কতটা বৃহৎ হতে পারে, তা বুঝতে গেলে বিলেতের ২০২৪-এর নির্বাচনের উদাহরণটাই নেওয়া যেতে পারে। সাড়ে ছয়শো-র মধ্যে লেবার দল ৪১৩টি আসন নিয়ে একক নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা লাভ করেছিল; অর্থাৎ, ২০১৯-এর নির্বাচনের তুলনায় ২০২৪-এ ২১২টি বেশি তাদের পকেটে। অথচ মোট ভোটের হিসাবে, আগের থেকে মাত্রই ১.৬ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে তারা। কনজ়ারভেটিভরা দ্বিতীয়, লিব-ডেম তৃতীয়। কিন্তু, মজার ব্যাপার হল, মাত্র চারটি আসন জিতেও, রিফর্ম ইউকে কিন্তু সে বার দেশের মোট ভোটের প্রায় ১৪.৩ শতাংশ পেয়েছিল। অর্থাৎ শতকরা ভোটের বিচারে তারাই ছিল তৃতীয় স্থানে!
এ বছর মে মাসের গোড়ায় ঘটে যাওয়া সমস্ত নির্বাচন মিলিয়ে রিফর্ম ইউকে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, মানে, বিলেতে এখন তিন জনের মধ্যে এক জন, চরম দক্ষিণপন্থী। পরের সাধারণ নির্বাচনে, ভোটসংখ্যার এই অনুপাত যদি নাও থাকে, তা হলেও রিফর্ম ইউকে ২০-২৫ শতাংশ আশা করতেই পারে। আর তার ভিত্তিতেই, কে বলতে পারে, রিফর্ম ইউকে হয়তো কেবল গরিষ্ঠ দল নয়, মোট আসনের অর্ধেকের গণ্ডিও পেরিয়ে যেতে পারে। ভোট ভাগের অঙ্ক কী কঠিন, অজানা নয়।
গত এক বছর ধরে লেবার দলের নীতি ও কর্মপন্থায় অনেকেই বীতশ্রদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার যে বেশ চিন্তিত তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ইতিমধ্যেই, নিজের প্রধান বিরোধী হিসাবে ফ্যারাজকে ধরে নিয়ে তিনি ছায়ার বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নেমে পড়েছেন। বলতে শুরু করেছেন, আগামী দিনের নেতা হিসাবে ফ্যারাজ কতটা অপদার্থ হতে পারেন।
এখন অবধি, ফ্যারাজের নীতি মানে সবাই অভিবাসন নীতির কথাই ভাবেন; ফ্যারাজ চান বিলেতে আগত শরণার্থী, উদ্বাস্তুদের দেশে ঢুকতে না দেওয়া হোক। শুধু বিলেতে নয়, এ-হেন মতামত ইউরোপের সর্বত্রই মাথা চাড়া দিয়েছে। মুখ ফুটে কেউ জাতিবিদ্বেষী কথা বলতে না চাইলেও, এই স্পর্শকাতর বিতর্কটা আর ধামাচাপা রাখা যাচ্ছে না। সংখ্যালঘুর চিন্তা নয়, গোটা দেশই অভিবাসন নীতির পরিবর্তন চায়।
তাই, প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার বারংবার বলছেন, ফ্যারাজের প্রস্তাবিত কর্মপদ্ধতিতে আস্থা বা বিশ্বাস না রাখতে; ভবিষ্যতে ফ্যারাজ দেশের নেতা হলে বিলেতের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল সুনকের আগের স্বল্পমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী লিজ় স্ট্রসের আমলে।
স্টার্মার নিজের কৃতিত্ব হিসাবে তুলে ধরছেন সাফল্যের খতিয়ান, যার মধ্যে আছে আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতের সঙ্গে নানাবিধ বাণিজ্যচুক্তি। তাঁর মতে, এ সব চুক্তির মাধ্যমেই বিলেতের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে, ফ্যারাজের পক্ষে যা করা অসম্ভব। আবার উল্টো যুক্তিও বেশ জোরালো। আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি করার পক্ষে সেরা লোক স্বয়ং ফ্যারাজ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি।
বছরখানেক আগে অনেকেই ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এখন যা ছবি, তাতে ২০২৮-এ ট্রাম্প আবার পদের জন্য লড়তে পারেন; ২০২৯-এ তৃতীয় বার প্রেসিডেন্ট হলেও হতে পারেন। আর সেই বছরই, কে জানে, অতলান্তিকের অন্য পারে বিলেতে তাঁর বন্ধুপ্রবর নাইজেল ফ্যারাজও বিলেতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসতে পারেন। অঘটন আজও ঘটে।
অঘটন ঘটতেই পারে, সংখ্যা বলছে। কে না জানে, কথায় আছে, ডাহা মিথ্যের আগে আসে পরিসংখ্যান, তারও আগে সংখ্যার হিসাব।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)