কিছু দিন আগে ভুবনেশ্বরে একটি সাহিত্য আসরে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল অনুবাদ সাহিত্য ও তার ভবিষ্যৎ। ওই মঞ্চ থেকে অন্তত পঞ্চাশটি বইয়ের অনুবাদ বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া, ওড়িয়া, মরাঠি, নেপালি, গুজরাতি, মৈথিলী, তামিল, বড়ো, কাশ্মীরি ও রাজস্থানি ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পর যে আলোচনা হল, তা বেশ কয়েকটি চিন্তার উদ্রেক ঘটাল। প্রসঙ্গত, আলোচনাটি মঞ্চ থেকে একপাক্ষিক হল না, প্রশ্ন-উত্তর পর্বে ছাত্রছাত্রীরা যেমন সক্রিয় ভাবে এগিয়ে এসে অনুবাদ সংক্রান্ত আলোচনায় যোগ দিল, তা সত্যিই আশা জোগানোর মতো। এতটা অংশগ্রহণ দেখে মনে হয়, অনুবাদ হয়তো শুধুই সাহিত্যের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, দৈনন্দিন জীবনেরও অংশ হয়ে দাঁড়াতে পারে, এখনও। হয়তো তার কারণটি অর্থনৈতিক। এই কাজটির সঙ্গে বহু মানুষের রুজি-রোজগারের বিষয়টি জুড়ে আছে এখনও।
আগে একটা ধারণা ছিল, সাহিত্যসংক্রান্ত অনুবাদ যাঁরা করেন, তাঁরা পৃথক পেশার পাশাপাশি অনুবাদে হাত দেন, ব্যক্তিগত ভাল-লাগার জেরেই। সেখানে অর্থনৈতিক চাহিদার বিষয়টি যুক্ত থাকে না বলে তাঁরা পরিশ্রম করে এই কাজ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তার মান নিয়ে ভাবিত হন না, কোনও মতে অনুবাদ শেষ করে প্রকাশ করতে চান। অনেকেই আবার সেই কারণে অনুবাদে এতটাই স্বাধীনতা নিয়ে নেন যে মূল টেক্সটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে দেখা যায়, প্রায় অর্ধেকটাই তিনি নিজের মতো করে নিয়েছেন। আবার এ কথাও অনেকে ভাবতেন যে, মেয়েরা বেশি অনুবাদ করেন। কারণ, তাঁরা বাইরে কাজ করেন কম, অথচ বিবাহসূত্রে হয়তো নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য কোনও প্রদেশে গিয়ে ভাষাটা শিখতে হল। তখন তাঁর অবসর কাটে অনুবাদে। ফলে ‘ভাষা’র ‘ভাসা ভাসা’ ধারণার মধ্যে অনুবাদ হল ঠিকই, কিন্তু প্রাণপ্রতিষ্ঠা যেন বাকি থেকে গেল।
কবিতার ক্ষেত্রে আবার বিষয়টা একেবারেই উল্টো। ভাল অনুবাদে সম্পূর্ণ একটি নতুন কবিতা হয়ে উঠতে পারে অনূদিত অংশটি। আবার মন্দ অনুবাদ তাকে এতটাই নীরস করে দিতে পারে যে, কবিতা বলে তাকে আর অনুভব করা যায় না। তবে এগুলো কোনওটাই পুরো সত্য নয়। অনুবাদ কোনও নির্দিষ্ট শর্ত মেনে চলে না। ভাল অনুবাদ মানে অবধারিত ভাবে মূল সাহিত্যের থেকে দূরে সরে যাওয়া, এও পুরো ঠিক নয়। আসলে অনুবাদের একটি বড় সমস্যা দেশ-কাল স্থান-পাত্র’র প্রেক্ষিতে ভাষার মানে বদলে যাওয়া। হয়তো যে ভাষায় লেখা হয়েছে, তার অভিধানে আছে আঞ্চলিক কিছু শব্দ যা সেই ভাষাভাষীরা সচরাচর ব্যবহার করেন এক রকম অর্থে; অথচ যখন অন্য ভাষায় তা অনুবাদ হচ্ছে সেখানে সেগুলির কাছাকাছি অর্থের শব্দ নেই। সে ক্ষেত্রে মূল ভাষাটি খুব ভাল ভাবে না জানলে উপযুক্ত শব্দ পাওয়া মুশকিল। এই জায়গাতেই বিড়ম্বনা তৈরি হয়। অনুবাদক সচেতন ভাবে জায়গাটি বাদ দিয়ে দেন বা পাল্টে দেন।
এত কিছুর পরেও অচেনা ভাষার অপরিচয় থেকে চেনা ভাষার রূপান্তরের মধ্য দিয়ে মানব-অভিজ্ঞতার বৈচিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে অনুবাদই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পথ। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত নাটকে বিদূষক বা দাসীর সংলাপ পর্যন্ত প্রাকৃতে অনূদিত হয়ে বৃহত্তর বলয়ে ছড়িয়ে পড়ত। রামায়ণ, মহাভারত তো অনুবাদের মাধ্যমেই দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তী কালে বিদেশি লেখকেরা জনপ্রিয় হলেন অনুবাদের মাধ্যমে। শেক্সপিয়র, টলস্টয়, ও হেনরি, মপাসাঁ, ওয়াল্টার স্কট, ভিক্তর উগো, আর্থার কোনান ডয়েল, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, চার্লস ডিকেন্স, এইচ জি ওয়েলস, ম্যাক্সিম গোর্কি, জুল ভার্ন, মার্ক টোয়েনের পর গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ওরহান পামুকদের নিয়ে ভারতের নানা অঞ্চলে যথেষ্ট আলোড়ন হয়েছে। কিন্তু তুলনায় পিছিয়ে থেকেছে অন্যান্য ভারতীয় ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ।
এই কাজটিকে কেন যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না, সে কথা আলোচনা করা দরকার। সে কি আমাদের মনে উপনিবেশ-মানসিকতা থেকে যাওয়ার কারণে? সে কি অন্য ভারতীয় ভাষার আপাত-দুরূহতার কারণে? এ কথা ঠিকই যে, ভারতীয় ভাষা নিয়ে কাজ করা অনেক কঠিন। ইংরেজি-হিন্দিকে বাদ দিলে ভারতের এক অঞ্চলের মানুষ অন্য আঞ্চলিক ভাষা জানেন, এই উদাহরণ আজও খুব কম। তা ছাড়া বিদেশি ভাষা শিখে চাকরির সুবিধা মেলে, ভারতীয় ভাষা জেনে ততটা নয়।
সমস্যা যতই থাকুক, অনুবাদ ছাড়া যখন অন্য সাহিত্য-সংস্কৃতিকে জানার কোনও পথ নেই, সেখানে এ কাজের গুরুত্ব অনুভব করতেই হবে। কৃষণ চন্দর, প্রেমচন্দ, মান্টো, ইসমত চুগতাই-এর মতো করেই চিনতে ও চেনাতে হবে পরবর্তী কালের বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার লেখকদের। এ এক গুরুদায়িত্ব। অবশ্য আগ্রহী বলয়ের মানুষেরা এই দায়িত্বের কথা বুঝে সেই চর্চায় সময় দিচ্ছেন, নানা আলাপ-আলোচনা সভা-বৈঠক তা বলে দেয়। বইমেলা বলে দেয়, আগ্রহী পাঠকও আছেন। দরকার কেবল এগিয়ে এসে এই দুরূহ কাজটি করা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)