E-Paper

শেকল ছিঁড়ে যেতে পারো না

ব্যক্তিগত জীবন ছিল অনিয়ন্ত্রিত। খাদ্যাখাদ্য ও পানীয় নির্বাচনে কোনও বিচার থাকত না।

জয়দীপ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৫
প্রয়াত জ়ুবিন গার্গ।

প্রয়াত জ়ুবিন গার্গ। ফাইল চিত্র।

হাজার জনতার সামনে মঞ্চ থেকে শিল্পী সি-শার্প’এ ঘোষণা করছেন, “আমার কোনও জাতি নেই/ আমার কোনও ধর্ম নেই/ আমার কোনও ভগবান নেই/ আমি মুক্ত/ আমিই কাঞ্চনজঙ্ঘা।” তিনি জ়ুবিন। জ়ুবিন গর্গ। ‘জেন-জ়ি’র প্রাণের শিল্পী ‘জ়ুবিনদা’। কিন্তু অসম এবং উত্তর-পূর্বের তিনি হৃদয় সম্রাট। আজন্ম বোহেমিয়ান, বেহিসাবি ও উচ্ছৃঙ্খল মানুষটি কারও কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াননি কখনও। পিতৃকুলের পদবি ‘বরঠাকুর’ ছেড়ে হয়েছিলেন ‘গর্গ’। বিশ্বাস করেননি কখনও মানুষে মানুষে বিভাজনে। তাঁর তেত্রিশ বছরের সফল কেরিয়ারে যে সৃষ্টি তিনি রেখে গিয়েছেন এর সবটাই ধর্ম-জাতি-ভাষার ঊর্ধ্বে ওঠার আহ্বান। এক উন্নত মানবতার অন্বেষণ। তিনি প্রচারক নন। যা বিশ্বাস করতেন তা নিজের জীবনে পালন করতেন। বলেননি কখনও। বলতেই পারতেন, ‘আমার জীবনই আমার বাণী’।

ব্যক্তিগত জীবন ছিল অনিয়ন্ত্রিত। খাদ্যাখাদ্য ও পানীয় নির্বাচনে কোনও বিচার থাকত না। রাতের পর রাত ঘুমোতেন না। অনুরাগীদের দেওয়া তাঁর আদরের নাম, তাই, ‘নিশাচর’। তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকজন জানতেন, যত ক্ষণ পা টলছে না, জ়ুবিন মঞ্চে উঠবেন না। কিন্তু অসমের মানুষ জ়ুবিনের এ রকম ‘ছোটখাটো’ দুষ্টুমি চিরটাকাল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখে এসেছেন। তিনি যে ‘অসমর রাইজর ঘরর লরা’! চল্লিশটি ভাষায় আঠারো হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন জ়ুবিন। বাজাতে পারতেন বিভিন্ন ধরনের বারোটি বাদ্যযন্ত্র।

বাবা ছিলেন অসম সিভিল সার্ভিসে। সেই সুবাদে নানা জায়গায় থেকেছেন। জন্ম মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে। শৈশব-কৈশোর, প্রাক্-যৌবনের এক নাতিদীর্ঘ পর্ব কাটিয়েছেন বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ শহরে। ঝরঝরে বাংলা বলতেন।

উদ্ধত, দুর্বিনীত, আপসহীন ও নির্ভীক জ়ুবিনকে রাষ্ট্রযন্ত্রও কখনও ঘাঁটানোর সাহস করেনি। এই ক্ষুদ্র রচনাটি যখন তৈরি করছি, গুয়াহাটিতে জনজোয়ারে ভাসছেন নিথর জ়ুবিন। হিমন্তবিশ্ব শর্মা সমাজমাধ্যমে লিখছেন, জনসমুদ্র যেন, জ়ুবিনের গানের কথায়, উচ্চারণ করছে “শেকল/ ছিঁড়ে তুমি/ যেতে পারো না।” অথচ পরম পরাক্রমী মুখ্যমন্ত্রীকেও কখনও রেয়াত করেননি জ়ুবিন। কিছু দিন আগেই এক অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে জনতাকে তিনি বলেছেন, “এ বার সরকার পাল্টেই দেব।” গুয়াহাটিতে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। জ়ুবিনের মর্মন্তুদ মৃত্যুর পর ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে দীর্ঘ দিনের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার জানিয়েছেন জ়ুবিনকে নিয়ে এক অজানা কথা। ২০০৮ সালে গুয়াহাটিতে ভয়ঙ্কর বোমা বিস্ফোরণের প্রতিবাদে গণনাট্য সঙ্ঘ পথে নেমে মানবতা-বিরোধী এই হিংস্রতার প্রতিবাদ করে। খবরটি পেয়ে সুদূর মুম্বই থেকে ছুটে আসেন জ়ুবিন। খ্যাতির চূড়া থেকে গণনাট্যের খোলা ট্রাকে নেমে আসতে তিনি দু’বার ভাবেননি। তিনি কিন্তু গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য নন। সম্ভবত কখনও ছিলেন না। ডান-বাম-মধ্য কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিই তাঁর কোনও পক্ষপাতিত্ব ছিল না। কিন্তু সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টিশীল মানুষটি ঠিক জানতেন কখন কোথায় তাঁকে প্রয়োজনে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।

মিশে যেতে পারতেন জনতার মুখরিত সখ্যে। আমার এক তরুণ সহকর্মী হেমন্ত বরা সে দিন জ়ুবিনকে নিয়ে তাঁর এক অভিজ্ঞতা জানালেন। সে অনেক বছর আগের কথা। মধ্য অসমের নগাওঁয়ে তাঁদের একটি নাট্যগোষ্ঠী ছিল। সে বার তাঁরা জ়ুবিনের নির্বাচিত কিছু কবিতা নিয়ে নতুন নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছেন। অনুমতির জন্য যোগাযোগ করেছেন জ়ুবিনের সঙ্গে। সবটা শুনে জ়ুবিন তো উচ্ছ্বসিত। বললেন, “শোন, তোদের নাটকের মিউজ়িক আমিই করে দেব। নাটকের দিন হলেও থাকব। শুধু আগাম জানিয়ে রাখিস কবে তোদের মঞ্চায়ন। আর হ্যাঁ, আমি যে যাচ্ছি তা কাউকে জানাস না। লোকজন জেনে নিলে তোদের সাধের নাটক ভোগে যাবে।” লোকটা কথা রেখেছিলেন। ঠিক সময়েই মিউজ়িক ফাইল পাঠিয়েছিলেন। টলমল পায়ে এসে পিছনের সারিতে বসে নাটকও দেখে গিয়েছেন। ভাবা যায়! তখন জ়ুবিন খ্যাতির মধ্যগগনে। এ যেন ‘গল্প হলেও সত্যি!’

সারা জীবন নিজ শর্তে কাটিয়েছেন। মৃত্যুও যেন নিজের শর্তেই ডেকে এনেছেন। না হলে কেন লিখে যাবেন, “আকাশের গায়ে গায় যে-মন/ সাগরতলে শোবে সেই-মন”? নগাওঁ থেকে লামডিং আসার পথে গাড়িতে বসে জ়ুবিন লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় পঙ্‌ক্তি— “আমার প্রতিবাদী সত্তার পরিধি/ তোরা বুঝবি না/ আমি নদী থেকে সাগরে যেতে পারি/ আবার সাগর থেকে নদীতে ফিরতে পারি।”

এ বার আর ফিরতে পারেননি নদীতে। সাগরেই বিলীন হলেন মহাবিদ্রোহী ‘লুইত কণ্ঠ’। মৃত্যুর আগের রাতেই নাকি জ়ুবিন গাইছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন, “উড ইউ নো মাই নেম/ ইফ আই স’ ইউ ইন হেভেন?” যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়— যদি স্বর্গে তোমাকে দেখি/ তুমি আমায় নামে চিনবে কি? প্রশ্ন জাগে ওই গানই কেন? উত্তরও যে জানা। ওই গানেই তো আছে সেই কলকণ্ঠে ঘোষণা, “আই মাস্ট বি স্ট্রং/ অ্যান্ড ক্যারি অন/ ’কজ় আই নো আই ডোন্ট বিলং/ হিয়ার ইন হেভেন।” বাংলা তর্জমায়— কাজটা করে যেতে হবে/ নিজেকে শক্ত রেখে/ কারণ আমি জানি/ আমি তো এই স্বর্গের বান্দা নই।

সত্যিই তো! অসমের মাটির সোঁদা গন্ধে যে শিল্পীজীবন কাটিয়েছেন, অসহায় মানুষের ঘাম-রক্ত যাঁর তনুমনে ছড়িয়ে আছে, তিনি কি পারেন স্বর্গের বৈভবে নিজেকে মেলাতে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Zubeen Garg

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy