E-Paper

আজ তবে কোন উত্তেজনা?

খবরের সত্যাসত্য বিচারের আগেই তা সমাজমাধ্যমের দেওয়ালে তুলে দেওয়া হয়। পরে যদি জানা যায় খবর ভুল, দেওয়াল থেকে মুছে দিলেই হল! এর বেশি তো কিছু নয়।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৫ ০৬:৪৩

আজকের বিষয়টা তা হলে কী? আজ দিনভর কী নিয়ে উত্তেজনা চলবে? যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব কমেছে। সন্তানের মৃত্যুর সঙ্গে মায়ের দ্বিতীয় বিয়েকে জুড়ে দেওয়াও এখন পুরনো খবর। চাকরিহারা শিক্ষকদের উপর পুলিশের লাঠি? সেটা নিয়ে তো তার পরের ২৪ ঘণ্টা অনেক তোলপাড় চলল। কিন্তু এর পর? পরবর্তী বিষয় খোঁজার জন্য তাই এখন বিষম তাড়া। এ ভাবেই চলছে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিস্থিতি থেকে প্রৌঢ় রাজনীতিকের বিয়ে, বাদ যাচ্ছে না কোনও কিছুই। সমাজমাধ্যম শিখিয়েছে, সব ব্যাপারে আমার মতামত দেওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে। প্রমাণের দায় নেই। যুক্তি প্রতিষ্ঠার গরজ নেই। যে বিষয়ের বিন্দুবিসর্গও বুঝি না, সে বিষয় নিয়েও অবলীলায় বিশেষজ্ঞের মন্তব্য করার গণতান্ত্রিক অধিকার খণ্ডাবে এমন সাধ্য কারও নেই।

‘অধিকার’ আছে বলেই না কারও মৃত্যু সংবাদ সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার সময়েও এমন মরিয়া প্রতিযোগিতা চলে। কে আগে পোস্ট করবে, আগের দু’বার অমুক পেরেছে, এ বারটা যেন আমার হাত থেকে ফস্কে না যায়! তাই খবরের সত্যাসত্য বিচারের আগেই তা সমাজমাধ্যমের দেওয়ালে তুলে দেওয়া হয়। পরে যদি জানা যায় খবর ভুল, দেওয়াল থেকে মুছে দিলেই হল! এর বেশি তো কিছু নয়।

আমাদের জীবনে বোধ হয় ভাবনার অবকাশ এবং অভ্যাস এখন এতটাই কমে গিয়েছে যে, কোন পরিস্থিতিতে কোন মন্তব্য কাকে কোন খাদের মুখে ঠেলে দিতে পারে তা আমরা ভেবেই দেখি না। কিংবা এও হতে পারে সবটা ভেবেচিন্তেই করি, যাতে একটা মানুষকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হতে দেখার তৃপ্তিটা কোনও ভাবে ফস্কে না যায়।

আমাদের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হতে হতে কি পুরোটাই মরে যাচ্ছে? না হলে যে মহিলার একমাত্র সন্তান অকালে, আকস্মিক ভাবে চলে গেল, তাঁকে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কটু কথায় জর্জরিত করতে কারও বাধেনি। অন্য কিছু নয়, শুধুমাত্র মায়ের দ্বিতীয় বিয়েই যে এই মৃত্যুর কারণ, এই ‘শেষ বিচার’ শোনাতে কেউ দু’মিনিটও সময় নেননি। মায়ের বিয়েই সন্তানকে গভীর অবসাদে ঠেলে দিয়েছিল, তাই সে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মৃতদেহের ময়না তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই এই ‘সত্যের খোঁজ’ পেয়ে গিয়েছিল জনতা। সমাজমাধ্যমের দৌলতে একের সমর্থনে অন্যের মন্তব্যে ভেসে গিয়েছিল অজস্র দেওয়াল। কেউ কেউ যে এর প্রতিবাদ করেননি তা নয়, কিন্তু তাঁরা এতটাই সংখ্যালঘু যে, স্রেফ একঘরে হয়ে থেকে যেতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু অবসাদে আত্মহত্যার তত্ত্ব খাড়া করা জনতা যখন ওই তরুণের প্যাংক্রিয়াসের অসুখে মৃত্যুর খবর পায়, তখন সমাজমাধ্যমের দেওয়ালে তার ছবির পাশাপাশি, তার মায়ের বিয়ের ছবি রেখে পর পর পোস্ট দেওয়া কি তাদের আদৌ লজ্জায়, গ্লানিতে অধোবদন করেছে? সম্ভবত করেনি।

সাম্প্রতিক আর জি কর আন্দোলনও এর থেকে রেহাই পায়নি। বার বার বিভিন্ন ভাবে সমাজমাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘আসল উদ্দেশ্য’ নিয়ে কটাক্ষ হয়েছে। এমনকি বাদ যাননি ওই চিকিৎসক-পড়ুয়ার বাবা-মাও। ঠিক কতটা নির্মম ও সহানুভূতিহীন হলে এমন ঘটনাতেও বাবা-মা কদর্য বাক্যবাণ থেকে রেহাই পান না, সে উত্তর জানা নেই।

সমাজমাধ্যমের সুবিধা হল, মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় না, একটা আড়াল থাকে। আর সেই আড়ালের সুযোগ নিয়েই মিলে যায় যা খুশি তাই বলে যাওয়ার নির্লজ্জ স্বাধীনতা। একটু প্রভাবশালী বা নামডাকওয়ালা হলে, সাধারণ সময়ে অন্যের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে এই আক্রমণের সুখ যেন আরও বেড়ে যায়। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “শিকার কিছুমাত্র সুখের হইত না, যদি মৃগ যেখানে-সেখানে থাকিত এবং ব্যাধকে দেখিয়া পলাইয়া না যাইত। মৃগের উপরে আমাদের আক্রোশ আছে বলিয়াই যে তাহাকে মারি তাহা নহে, সে বেচারা গহন বনে থাকে এবং পলায়নপটু বলিয়া তাহাকে মারিতে হয়।”

বস্তুত এমন পরচর্চার ট্র্যাডিশন তো সেই কবে থেকেই চলছে। চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডা, পুকুর পাড়ের গুলতানি, কলতলার ঝগড়া, নামগুলো হয়তো আলাদা। কিন্তু অন্যের জীবনে ঢুকে পড়ে যাবতীয় শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, বিচারবুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে বিদ্ধ করা, জনসমক্ষে হেয় করা, নীতিপুলিশের ভূমিকা নিয়ে তার আচরণের কাটাছেঁড়া করা, এ সব আগেও ছিল, এখনও চলছে। তবে এখন এর ব্যাপ্তি অনেক বেশি আর ‘সফিস্টিকেশন’-এর মোড়কটা বেশ জমকালো।আর এই জমকালো মোড়ক আমাদের সংবেদনশীলতাকে এতটাই পঙ্গু করে রেখেছে যে, অন্যের বিপর্যয়ে আমরা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কারও চোখের জল আর বিশেষ নাড়া দেয় না। ব্যক্তিগত না পাওয়া, সাহসের অভাবে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, অপূর্ণতার কষ্ট ঢাকতে অবলীলায় অন্যের জীবনে নাক গলিয়ে অন্যকে ছোট করে ফেলতে পারি। শুধু ছোট করা নয়, আমাদের দাঁত-নখ এমন ভাবে বেরিয়ে থাকে যে, যে কোনও সুযোগে অন্যকে ক্ষতবিক্ষত করতে না পারলে আমাদের স্বস্তি হয় না। পথ-দুর্ঘটনায় শিশুর মৃত্যু হলে, তার বাবা-মা কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন সে কথা বলি।স্কুলপড়ুয়ার আত্মহননে দায়ী করি বাবা-মায়ের ব্যস্ততা কিংবা বাড়ির লোকের বকুনিকে। স্বামী বা স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে দায় বর্তায় অপর জনের ‘আত্মকেন্দ্রিকতা’র উপর।

শুধু কি এক দিনের আক্রমণ? সমাজমাধ্যমের দৌলতে সে তো চলতেই থাকে দিনের পর দিন। যার পোশাকি নাম ‘ট্রোলিং’। পহেলগামে নিহত নৌসেনার স্ত্রী হিমাংশী নারওয়ালকেও ট্রোলিংয়ের নিশানা করতে কারও বাধেনি। বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রীর কথাও ধরা যাক। শত্রুর তালিকায়এক নম্বরে ছিল পাকিস্তান। কিন্তু যে মুহূর্তে বিক্রম যুদ্ধ বিরতির কথা নিশ্চিত করলেন, সেই মুহূর্তেই নেট জনতার একটা অংশ পাকিস্তানকে দু’নম্বরে রেখে মুহূর্তে এক নম্বরে বিক্রমকে বেছে নিয়েছিল শিকার হিসাবে। তাঁকে বিশ্বাসঘাতক তকমা দিয়ে, তাঁর পরিবার নিয়ে কুৎসা করে, তাঁর মেয়ে সম্পর্কে অশালীন কথা বলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ‘অপরাধ’-এর শোধ তুলেছিল তারা।

ইদানীং এই প্রবণতা আরও বেশি করে উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে, কারণ বহু ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যম অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবিত করছে মূল ধারার মিডিয়াকেও। যুদ্ধের খবর হোক বা নীতি পুলিশি, সমাজমাধ্যমের প্রভাব মূল স্রোতের মিডিয়ার একটা অংশকেও গ্রাস করছে। তাই সেখানেও সংবাদমাধ্যমের ব্যাকরণ না মেনে বিচারের আগেই কাঠগড়ায় তোলার নজির সামনে আসতে শুরু করেছে। সংবাদমাধ্যমের একাংশও এখন কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যমের ‘ট্রেন্ড’ অনুসরণ করে চলছে। দর্শক/পাঠক বাড়ানোর তাগিদে ঠিক কী কী করা সম্ভব, তা সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বড় বেশি প্রকট করে দেখিয়ে দিয়েছে। যাচাই না করেই পরিবেশিত হয়েছে একাধিক খবর। ভুল তথ্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

মনে আছে, শাহিন বাগ আন্দোলনের সময় সম্পূর্ণ অন্য এক শহরের অন্য এক সময়ের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়েছিল আন্দোলনস্থলে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর মদের বোতল ও কন্ডোম। আর একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে দাবি করা হয়েছিল আন্দোলনকারীরা লাইনে দাঁড়িয়ে কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। এই ভুয়ো ভিডিয়োর ফাঁদে পা দিয়েছিল কয়েকটি মূল ধারার মিডিয়াও। ভুল খবর প্রচার করে পরে আবার তা তুলেও নিতে বাধ্য হয় তারা। কিন্তু তাতে কি কারও স্বভাব বদলেছে? নাকি বদলায়?

আমরা ঘটনা থেকে শিক্ষা নিই না। ফের সেই একই রকম আক্রমণের নেশায় মেতে উঠি। যত দিন যাচ্ছে, সমাজের সমস্ত স্তরে এই নিয়ন্ত্রণহীনতা যেন আরও লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। ভয় একটাই, অন্যের হাহাকারকে বিদ্ধ করতে করতে, অন্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে করাতে কখনও তা আমাদের দিকেও ফিরে আসবে না তো?

আমাদের মধ্যে যাদের এখনও শুভবুদ্ধি অবশিষ্ট আছে, চুপ থেকে শুধু দর্শকের ভূমিকা পালনের বিলাসিতা করার কিন্তু তাদেরও আর জো নেই। যে যার মতো করে এই প্রবণতা রোখার চেষ্টা করতেই হবে। পায়ের তলার মাটি কিন্তু আলগা হচ্ছে ক্রমশ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fake News reaction

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy