সব মিলিয়ে আট বার। ছ’বার পূর্ণাঙ্গ, দু’বার অন্তর্বর্তী বাজেট। গত এক বছরে তিন বার। নির্মলা সীতারামনকে একই বুলি আওড়ে যেতে হচ্ছে। উপায় নেই। ওটাই যে তাঁর চাকরি! ক্লান্তি আসা, অতএব, অস্বাভাবিক নয়। এমনিতেই বহু কাল ধরে বাজেটে কোনও নীতিগত ঘোষণা থাকে না। যা নর্থ ব্লকের হাতে থাকে তা হল একগুচ্ছ নয়া প্রকল্পের নাম আর কিছু অঙ্ক। এই একই ফিরিস্তি আর ধারাপাত স্বাভাবিক ভাবেই বাজেট বক্তৃতার আকর্ষণ কমিয়ে দেয়। এ বারের বাজেটে এটা আরও স্পষ্ট।
অন্য দিকে, অর্থব্যবস্থার কিছু গুরুতর অসুখ ঢাকতেই হয় অর্থমন্ত্রীকে; নজর ঘোরানোর জন্য সামনে নিয়ে আসতে হয় নিত্যনতুন প্রকল্প। এক বছর পর যখন ফের বাজেট পেশ হয়, অনেকেই জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যাই, গত বারের প্রকল্পগুলির কী হল। যেমন, গত জুলাইয়ের বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে চালু হয়েছিল পিএম-ইন্টার্নশিপ প্রকল্প। লক্ষ্যমাত্রা: পরের পাঁচ বছরে শিক্ষিত কিন্তু অদক্ষ বেকারদের জন্য এক কোটি কর্মসংস্থান করা। দেশের পাঁচশোটি বড় সংস্থা শিক্ষানবিশ হিসাবে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েদের নেবে। তাদের মাসোহারা দেওয়ারও কথা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল চলতি অর্থবর্ষেই ১.২৫ কোটি এমন চাকরি সৃষ্টি করা। সেই মতো আবেদনের জন্য পোর্টাল খোলা হল। ছ’লাখের বেশি উৎসাহী আবেদন করলেন। গত ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই এঁদের কাজে বহাল করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা জানি না যে, শেষ অবধি কতটা কী হল। এ বারের বাজেট-ভাষণে এই প্রসঙ্গের কোনও উল্লেখ নেই। উল্টে নতুন করে এল ‘মেক ফর ইন্ডিয়া, মেক ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’। তা হলে কি স্কিল ইন্ডিয়া মিশন, প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা এবং ন্যাশনাল স্কিল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ? অর্থমন্ত্রী উত্তর দেবেন, সেই ভরসা কম।
চলতি অর্থবর্ষে রাজস্ব ঘাটতি গত বছরের প্রস্তাবিত হারের চেয়ে ০.১ শতাংশ-বিন্দু কম হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৮%। আগামী বছর তা কমে হবে ৪.৪%, বলছে বাজেট। গত বছরের তুলনায় এ বছর বাজেটে মোট বরাদ্দ বেড়েছে, কিন্তু কৃপণের বাম মুঠি আলগা করেননি অর্থমন্ত্রী। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মিডল ক্লাস’-এর জন্য দেদার কর ছাড়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে রাজকোষের ক্ষতি হয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকা যা মোট ব্যয়বরাদ্দের প্রায় দুই শতাংশ। এই টাকাটা তো কার্যত বাজেটের খরচ। আয় কমা আর ব্যয় বাড়া বর্তমান প্রেক্ষিতে অভিন্ন অর্থই খাড়া করে।
প্রতি বছর বাজেটে মোট রাজস্ব সংগ্রহ এবং মোট ব্যয়বরাদ্দের সার্বিক কাঠামোটি মোটের উপরে অপরিবর্তিত থাকে। কোথাও দুটো টাকা বেশি ঢাললে অন্য কোথাও ওই দু’টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়। কর ছাড় দেওয়ার ফলে এক লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব লোকসান বহন করার ব্যবস্থা অর্থমন্ত্রী কী ভাবে করলেন, সে-কথা বলি। গত বাজেটে মূলধনি ব্যয়ের অঙ্কটি ছিল ১১.১১ লক্ষ কোটি টাকা। এ বার সেটা কমিয়ে আনা হয়েছে ১০.১৮ লক্ষ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, এই যে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অঙ্ক হাতে এল, সেটা দিয়েই ব্যক্তিগত আয়করে ভোটমুখী খয়রাতি করা গেল। অথচ বাজেটের গায়ে আঁচড়টিও পড়ল না।
কিন্তু, এর ফলে নির্মলা-কথিত অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য কি সফল হবে? এই আধা-কেন্সীয় ব্যবস্থাপত্রে বাজারে স্বল্পমেয়াদি চাহিদা যে বাড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বিপুল অঙ্কের সম্পদ যদি মূলধনি খাতে বরাদ্দ হত, তাতে একাধিক মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যেত। প্রথম কথা হচ্ছে, স্থায়ী সম্পদ তৈরি হত, যার মাধ্যমে অর্থব্যবস্থার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ত। এই সুযোগটি মাঠে মারা গেল। অথচ এই সত্যটি কোথাও স্বীকার করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, যেখানে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ কমে আসছে, সেখানে সরাসরি-সরকারি বরাদ্দ অনেক বেশি কার্যকর হয় যা স্বীকৃত তত্ত্ব।
এই লেখার গোড়াতে যে ক্লান্তির কথা উল্লেখ করেছি, সে কথায় ফিরে যাই। এই যে প্রতিটি বাজেটে বিরামহীন পুনরুচ্চারণ, তা বুঝতে যেতে হবে বাজেটের কাঠামোগত কন্দরে। গত কয়েক বছর যদি বাজেটে প্রতি এক টাকার আপেক্ষিক উৎস ও গন্তব্যে নজরদারি চালাই, আমরা দেখব যে, অর্থব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলা হলেও বাজেটের কাঠামো অচলায়তনেই রয়ে গেছে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ২০২৪-২৫ আর ২০২৫-২৬’এর দুটো বাজেট দেখলেই চলবে। সাধারণত আয়ের আটটি উৎস ও ব্যয়ের আট-ন’টি গন্তব্যের হিসাব এক নজরে দেখে নেওয়া যায়। সব ক’টা রাজস্ব উৎস এবং ঋণ মিলিয়ে যে এক টাকা আসে, তাতে দু’টি বাজেটের মধ্যে ঈষৎ হেরফের হয়েছে শুধু দু’টি ক্ষেত্রেই— আয়কর ও অভ্যন্তরীণ ঋণ। প্রথমটিতে আপেক্ষিক অনুপাত বেড়েছে তিন শতাংশ; দ্বিতীয়টিতে সমপরিমাণ কমেছে। ব্যয়ের বেলায়ও একই চিত্র। অর্থ কমিশনের অংশ ও কেন্দ্রীয় করে রাজ্যগুলোর ভাগ বাবদ যে-টাকাটা পাঠানো হয়, অন্যান্য খরচ, সুদ মেটানো এই ক’টি ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন বাদে বাকিটা অভিন্ন।
মোদী সরকারের কোনও বাজেটই প্রকৃত প্রস্তাবে আনকোরা নয়। বাজারের ইশারায় ও সাঙাততন্ত্রের রক্তচক্ষুর ভয়ে বাজেটের অন্তরঙ্গে কখনও হাত পড়ে না। নতুন যেটুকু লাগে, তা ওই বহিরঙ্গের উতরোলে। বছরের পর বছর তেমন বাজেট পড়ে যেতে অর্থমন্ত্রী ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাঁর আর দোষ কী!
অর্থনীতি বিভাগ, কাছাড় কলেজ, শিলচর
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)