মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, রাজ্যের শান্তিপ্রিয় মানুষকে তা খুবই পীড়িত করেছিল। যূথবদ্ধহানাদারদের তাণ্ডবে তিন শতাধিক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, মেয়েদের শ্লীলতাহানি, এমনকি দু’জন মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছিল। ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা নদী পেরিয়ে ঝাড়খণ্ড ও মালদহে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে গঠিত তথ্যানুসন্ধান কমিটির পেশ করা যে রিপোর্ট জনসমক্ষে এসেছে, তা শুধু বেদনাদায়কই নয়, যথেষ্ট উৎকণ্ঠার। ধুলিয়ান পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়র্ডের কাউন্সিলরের স্বামী তথা ধুলিয়ানের পূর্বতন পুরপ্রধানের নির্দেশ ও প্রত্যক্ষ মদতে ওই ঘটনা ঘটেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে, দায়ী করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিধায়কের নিষ্ক্রিয়তাকেও।
রাজনৈতিক উস্কানি ও প্রচ্ছন্ন ইন্ধন ছাড়া যে এ দেশে হিংসার ঘটনা ঘটে না, এই সত্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হানাহানি হোক বা সাধারণ নাগরিকের উপর আক্রমণ বা অন্তর্দলীয় আক্রমণ-প্রত্যাক্রমণ, যে কোনও সংঘর্ষের ঘটনা প্রতিহত করে জনজীবন স্বাভাবিক ও শঙ্কামুক্ত রাখার দায়িত্ব যাঁদের, সেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ওই রিপোর্টে বলা তথ্য এ রাজ্যের যে কোনও বাসিন্দার হৃৎকম্প হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হরগোবিন্দ দাস ও তাঁর পুত্রকে যখন আততায়ীরা প্রকাশ্য দিবালোকে কুড়ুলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করছে, তখন মাত্র তিনশো মিটার দূরে থানায় কর্তব্যরত পুলিশ আক্রান্তদের রক্ষা করতে এগিয়ে তো আসেইনি, উপরন্তু ওই এলাকায় দু’দিন ধরে চলা তাণ্ডবের সময় পুলিশের ফোন কার্যত বন্ধ ছিল।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, রাজনৈতিক প্রভুদের নির্দেশ পালনের বাধ্যবাধকতায় পুলিশ এখন আইনের শাসনের চাইতে শাসকের আইন বলবৎ করতে বেশি তৎপর। অবশ্য পুলিশের এই আচরণ রাজ্যে নতুন নয়। বাম আমলেও পুলিশ একই অভিযোগে বারংবার বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের শোধরানো দূরে থাক, নতজানু হতে হতে পুলিশের দায়বদ্ধতা প্রায় বিলীন। বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডলের হুমকি ও সাম্প্রতিক কুৎসিত গালিগালাজের পরেও তাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকায় তা স্পষ্ট।
তবে রাজনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে ওঠবস করার অভিযোগ শুধু এ রাজ্যের পুলিশের বিরুদ্ধে, এমন নয়। অন্যান্য রাজ্যেও মোটামুটি একই চিত্র। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সংস্থাগুলিও যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চালিত হওয়ার রোগ থেকে মুক্ত নয়, তাদের গতিপ্রকৃতিতেই স্পষ্ট।
সারদা, রোজ় ভ্যালি-সহ একের পর এক আলোড়ন তোলা আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলায় এ রাজ্যের তাবড় নেতার নাম জড়িয়েছিল, কেউ কেউ গ্রেফতারও হন। আশ্চর্যের ব্যাপার, আজও মামলাগুলির নিষ্পত্তি হয়নি। উল্টে যাঁরা গ্রেফতার হন তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবশালী সবাই জামিনে মুক্তি পেয়ে রাজনীতিতে স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করছেন। সৌজন্যে সিবিআই ও ইডি-র শম্বুকগতির তদন্ত। নারদা মামলায় ক্যামেরার সামনে যে নেতৃদের উৎকোচ নিতে দেখা গিয়েছিল, আজও তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
রাজ্যে স্কুলশিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় সিবিআই-এর পেশ করা রিপোর্টের ভিত্তিতে ‘টেন্টেড’ এবং ‘আনটেন্টেড’ শিক্ষকদের জন্যে সুপ্রিম কোর্ট পৃথক শাস্তির সুপারিশ করলেও সংশয়াতীত তথ্যপ্রমাণের অভাবে ২০১৬-র এসএসসি-র পুরো প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে। ওই একই দুর্নীতির ‘মানি ট্রেল’ সংক্রান্ত তদন্তে ইডি কালীঘাটের কাকু বলে পরিচিত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর নেওয়ার পর কোনও এক প্রভাবশালীর দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে সেই যে নিদ্রামগ্ন হয়েছে, জাগরণের কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। গরু পাচার মামলা, কয়লা কেলেঙ্কারি, রেশন দুর্নীতি-সহ এ রাজ্যেরই বেশ কিছু মামলার বর্তমান অবস্থা কী, সিবিআই ও ইডির তদন্ত কোন পর্যায়ে, এ সব প্রশ্ন আর বিশেষ শোনা যায় না।
আর জি করে পড়ুয়া-চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পর এখনও বছর ঘোরেনি, মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে গ্রেফতার হওয়া ওই মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন সুপার ও তথ্যপ্রমাণ লোপাটের দায়ে গ্রেফতার হওয়া টালা থানার সেই সময়ের ওসি জামিনে মুক্ত। তদন্তের গতি ও ধরনধারণে আদালত একাধিক বার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা ভর্ৎসিতও হয়েছেন। তবু সিবিআই আজও এই ঘটনায় জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট আর্থিক দুর্নীতিরও কিনারা করতে পারেনি ইডি।
কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির দীর্ঘ নিদ্রা ও রাজনৈতিক তিথিনক্ষত্র মেনে হঠাৎ জাগরণ দেখে অনেকের সন্দেহ, সেগুলি আসলে শাসকের আঙুলের অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পুতুল। হয়তো এ কারণেই ২০১৩-য় কয়লা কেলেঙ্কারির রায়দানকালে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই-কে ‘খাঁচার তোতা’ বলেছিল। লিকার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত অরবিন্দ কেজরীওয়ালের জামিন মামলার রায়দানকালেও একই মন্তব্য শোনা গিয়েছিল মাননীয় বিচারপতির মুখে।
এ সব কারণেই দানা বেঁধেছে কেন্দ্র-রাজ্যের বোঝাপড়ার গল্প। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সুশাসনের স্বার্থে এই বোঝাপড়া অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু তা যদি দুর্নীতি ও অপশাসন আড়াল করার জন্যই ঘটে, তবে সাধারণ নাগরিকের বিপন্নতা বাড়তে বাধ্য। বিপন্ন হন আইন প্রয়োগে নিয়োজিত দায়িত্বশীল কর্মিবৃন্দ। রুল বুক মেনে দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাঁরা এক দিকে হেনস্থা ও নিগ্রহের শিকার হন, অন্য দিকে পড়েন ঊর্ধ্বতনের রোষের মুখেও। এক শ্রেণির কর্তাভজারা রাজনৈতিক প্রভুর অভীপ্সা পূরণেই সদা তৎপর। এই সব ‘পাবলিক সারভ্যান্ট’দের দায়বদ্ধ করার আইন থাকলেও কার্যক্ষেত্রে বেশির ভাগই ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে পার পেয়ে যান। আর তার জন্য মাসুল গুনতে হয় সাধারণ মানুষকেই।
তা হলে উপায়? অসৎ সরকারি চাকুরেই হোক বা দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধি, যাঁদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এঁদের বাড়বাড়ন্ত, ক্ষমতার অলিন্দ থেকে তাঁদের নির্বাসনে পাঠানোর মধ্যেই হয়তো নিহিত আছে উত্তরণের চাবিকাঠি। প্রয়োজন শুধু সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐকমত্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)