Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

এক অন্য যুদ্ধ জয়ের অর্ধ শতক

পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ছিন্নমূল হতভাগ্যদের উদ্বাস্তু-শিবিরে এশিয়াটিক কলেরা ঠেকাতে, পশ্চিমি ডাক্তারদের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ওআরএস-এর ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু করেছিলেন দিলীপ মহলানবিশ।

স্বাগতম দাস
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২১ ০৪:৪৭
Share: Save:

তাঁর নামে সবজান্তা গুগল-এর ভাঁড়ারেও বিশেষ তথ্য নেই। ভারতের প্রধান বিজ্ঞান সংস্থাগুলির একটিরও ওয়েবসাইটে নেই তাঁর জীবনপঞ্জি— যেমন থাকে সেই সব সংস্থার সাম্মানিক সদস্য বা ফেলো হিসেবে নির্বাচিত আরও অনেক ভারতীয় বিজ্ঞানীর। অথচ, এই মৃদুভাষী অশীতিপর ‘ডাক্তারবাবু’ দিলীপ মহলানবিশের (ছবিতে) বৈজ্ঞানিক অবদানের কেন্দ্রে যে বস্তুটি, যাকে আমরা ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া ‘ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট’ বা ওআরএস হিসেবে চিনি, সেটির প্রয়োগ আজ প্রায় সর্বাত্মক। ডায়েরিয়া, কলেরা বা সমগোত্রীয় রোগের প্রকোপে শরীরে জলীয় অংশ কমে গেলে তা সহজেই ফিরিয়ে আনতে নুন-চিনির এই মিশ্রণের জুড়ি মেলা ভার— শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলের ক্ষেত্রেই।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ছিন্নমূল হতভাগ্যদের উদ্বাস্তু-শিবিরে কালান্তক হয়ে ওঠা এশিয়াটিক কলেরা ঠেকাতে, পশ্চিমি ডাক্তারদের বিধিনিষেধ এক প্রকার উপেক্ষা করেই ওআরএস-এর ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু করেছিলেন দিলীপ মহলানবিশ এবং তাঁর সহযোগীরা। তাতে শুধু লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণই বাঁচেনি, সূচনা হয়েছিল কলেরার মতো মহামারির সহজ ও ঘরোয়া চিকিৎসার একটি নতুন অধ্যায়— ভারত, বাংলাদেশ, মিশরের মতো গরিব দেশগুলিতে, যেখানে বিধিবদ্ধ চিকিৎসক ও উপকরণ ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। ২০২১ কেবল বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধেরই নয়, দিলীপ মহলানবিশদের এই জীবন বাঁচানোর যুদ্ধেরও অর্ধশতবর্ষ।

দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে ডিহাইড্রেশনের একমাত্র চিকিৎসা ছিল ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড থেরাপি— শিরার মধ্যে দিয়ে লবণাক্ত তরল বা স্যালাইন শরীরে চালনা করা। ১৯৭০-এর শেষ থেকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে বাঙালি শরণার্থী ঢুকছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। যশোর রোডের দু’পাশে ছড়িয়ে থাকা উদ্বাস্তু-শিবিরগুলোয় মানুষের চাপ বাড়তে থাকায় সেগুলো ক্রমেই হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর ও বাস-অযোগ্য। জাঁকিয়ে বসে কলেরা, উদ্বাস্তু মানুষের মৃত্যুহার ক্রমেই সব নিয়ন্ত্রণের ওপারে চলে যেতে থাকে। চিকিৎসকদের একমাত্র হাতিয়ার আই ভি ফ্লুইড তখন প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই সামান্য, একটা স্যালাইনের বোতল থেকেই ড্রিপ চলতে থাকে ৫-৬ জন কলেরা-রোগীর, একে একে যাঁদের শরীর নিথর আর ঠান্ডা হতে থাকে।

এই সময় পেশায় শিশুচিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ ছিলেন জন্স হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর কর্মী। কিন্তু কলেরা মোকাবিলায় তাঁকে প্রতিনিয়ত বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালেও নামতে হচ্ছিল এক অসম যুদ্ধে। ১৯৫৩ সালে আর এক বাঙালি চিকিৎসক হেমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আইভি-র বিকল্প হিসেবে কলেরার চিকিৎসায় চার গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড (সাধারণ নুন যা আমরা খাই) ও ২৫ গ্রাম গ্লুকোজ়ের সঙ্গে এক লিটার জল মিশিয়ে তৈরি ওআরএস-এর কার্যকারিতা বিষয়ে জোরালো সওয়াল করেন।

হেমেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্রটি ছাপে চিকিৎসাজগতের অন্যতম সেরা জার্নাল ল্যানসেট। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমেরিকান বা ইউরোপীয় চিকিৎসকদের গতানুগতিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধতা করে, ব্যাপক ভাবে আইভি-র বদলে ওআরএস-এর প্রয়োগ করতে চাননি প্রায় কোনও প্রাচ্য চিকিৎসকই। আসলে বাঘা বাঘা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মানতেই চাননি যে, অন্ত্রে জল ও লবণের পুনঃশোষিত হয়ে রক্তে ঢোকার যে রাস্তাটা কলেরা-টক্সিন বন্ধ করে দেয়, সেটাই আবার খুলে দিতে পারে জলে গুলে খাইয়ে দেওয়া গ্লুকোজ়। কলকাতার উপান্তে নেমে আসা ১৯৭১-এর সেই হননবেলায়, শেষ পর্যন্ত এই তত্ত্বটি হাতেকলমে প্রয়োগ করার সাহস দেখিয়েছিলেন দিলীপ মহলানবিশ। সহযোদ্ধা ও বাংলাদেশের চিকিৎসক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে একযোগে, প্রাথমিক ভাবে ৩০০০ কলেরা-রোগীর উপর প্রয়োগ করেছিলেন ওআরএস। আইভি দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছিল যে রোগীদের, তাঁদের মৃত্যুহার ছিল ৩০%। যে রোগীদের ওআরএস খাওয়ানো হল, তাঁদের মৃত্যুহার নেমে গেল ৩.৬ শতাংশে। কাঁটাতারের দু’পাশেই কলেরা মোকাবিলায় ওআরএস-এর অসম্ভব কার্যকর ভূমিকাটি স্বীকৃতি পেয়েছিল— খাতায় কলমে নয়, প্রাণ বাঁচানোর পরম প্রয়োজনে।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও মহলানবিশ ও তাঁর শিক্ষকপ্রতিম চিকিৎসক ধীমান বড়ুয়াকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল সন্দেহপ্রবণ পশ্চিমি চিকিৎসাবিজ্ঞানী মহলে ওআরএস-এর ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮০-র দশকে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে কলেরা ও ডায়েরিয়ার ওআরএস-ভিত্তিক চিকিৎসাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ল্যানসেট পত্রিকা ধীমান বড়ুয়া, মহলানবিশ ও তাঁদের সহযোগীদের ওআরএস-এর ব্যাপক প্রয়োগের এই উদ্যোগকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অগ্রগতি বলেও বর্ণনা করে।

দিলীপ মহলানবিশ এর পরেও বহু বছর জড়িয়ে থাকেন সক্রিয় গবেষণায়— কখনও শিগেলোসিস-এর চিকিৎসায় ভিটামিন এ-র কন্ট্রোল ট্রায়াল নিয়ে, কখনও টাইফয়েড জ্বরের টিকাকরণ পদ্ধতি নিয়ে। ১৯৯৪ সালে তিনি আমন্ত্রিত হলেন রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর সদস্য হিসেবে, সেই কমিটি যা নোবেল প্রাপকদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে। বিদেশের মাটিতে পেয়েছেন আরও অনেক সম্মান। দেশ তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে উঠতে পারেনি। বিজ্ঞানভিক্ষু মানুষটি অবশ্য সন্তুষ্ট বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের একটি ছোট ঘরে আজীবন গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার সরকারি সুযোগটুকু পেয়েই। তিনি জানেন যে, তাঁর আজীবনের গবেষণালব্ধ ফল জায়গা করে নিয়েছে মহাকালের সোনার তরীতে।

ইলেকট্রনিক অ্যান্ড কমিউনিকেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE