Advertisement
০২ মে ২০২৪
Rat Miners in Uttarkashi Tunnel Rescue

হে কলিযুগের দধীচিগণ, নাগরিক দঙ্গলের অধম বাসিন্দার সেলাম নেবেন

একটা গোটা দেশকে জীবনের ট্রফি এনে দিলেন কতগুলো ব্রাত্য, বাতিল, আপাতদৃষ্টিতে ‘অপরাধী’ মানুষ। ইঁদুরের মতোই যাঁদের বাস সমাজের অন্ধকারে। যাঁদের উপর কোনও আলো-বাতাস পড়ে না।

Uttarkashi Tunnel Rescue Operation: The key role of the so called banned method by the Rat-hole Miners

তাঁদের ছোঁয়া এড়িয়ে চলি। হেলাফেলায় ‘তুই’ সম্বোধন করি। তাঁরাই জীবনের মহাকাব্য লিখে গেলেন। মূল ছবি: পিটিআই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:০০
Share: Save:

প্রায় চল্লিশ বছর আগে রানিগঞ্জের এক কয়লাখনিতে নেমেছিল এক নেহাতই বালক। ক্লাসমেটের বাবা ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের বড়কর্তা। তিনিই ব্যবস্থা করেছিলেন। খনির নাম চাপুইখাস। কোমরে ব্যাটারি। সেখান থেকে জোড়া তার বেরিয়ে এসে ঢুকেছে মাথার প্লাস্টিক হেলমেটে লাগানো হেডল্যাম্পে। পায়ে বেঢপ গামবুট।

বোধহয় ঘণ্টাখানেক নীচে ছিলাম। চারদিকে এবড়োখেবড়ো কয়লার দেওয়াল গুঁড়ি মেরে আছে। তার ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে মেঝেতে পাতা কয়লার ট্রলির রেললাইন। কোনও ভাবে মাথার আলো নিভে গেলে নিকষ অন্ধকার গলা টিপে ধরে। দমচাপা, হাঁফফাঁস লাগে।

মাটির নীচের পৃথিবীটা কী অসম্ভব আলাদা!

অনেক পরে রিপোর্টার হিসেবে সেই রানিগঞ্জেই খনি দুর্ঘটনা কভার করতে গিয়ে ছোটবেলার খনিগর্ভে নামার সেই অভিজ্ঞতা মনে পড়েছিল। দুর্ঘটনাগ্রস্ত খনিতে জল ঢুকে আটকে পড়েছিলেন একদল শ্রমিক। প্রায় কেউই বেঁচে ফেরেননি। অনেকের দেহও উদ্ধার করা যায়নি। মনে আছে, রোজ সকালে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম খনিমুখের কাছাকাছি। যদি কোনও দেহ-টেহ ওঠে! পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকত প্লাস্টিকের হলদে হেলমেট পরা কিছু দীনহীন চেহারা। তাদের ক্ষয়াটে শরীর জুড়ে উৎকণ্ঠা। সহকর্মীদের কারও লাশ কি উঠল? না কি আরও অপেক্ষা করতে হবে? অন্তহীন সেই প্রতীক্ষার পরেও খনিগর্ভ উগরে দিত না কোনও নিষ্প্রাণ মনুষ্যদেহ। দিনের পর দিন চলে যাচ্ছিল। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড-পূর্ব যুগে তবিল ফুরিয়ে আসছিল। বাধ্য হয়ে আসানসোলের বড় হোটেল ছেড়ে রানিগঞ্জের একটা রোথো হোটেলে উঠেছিলাম। একটা কুচ্ছিত সিনেমাহলের বেসমেন্টে সেই হোটেলের ঘরের দেওয়ালে পেন্সিলে ঘুচিঘুচি করে বাংলা আর হিন্দিতে অশ্লীল সমস্ত শব্দ লেখা। নাইট শো শেষ না-হওয়া পর্যন্ত ধুপধাপ শব্দ ভেসে আসত পর্দায় ভিলেন পেটানোর। ঘুম আসত না।

সেই ঘনচক্কর থেকে কোন ফিকিরে তৎকালীন চিফ রিপোর্টারকে ঝাঁসা দিয়ে কলকাতায় ফিরেছিলাম, সেটা অন্য কথা। কিন্তু সেই হলদে প্লাস্টিকের ফঙ্গবেনে হেলমেট পরা মুখ আর খর্বুটে চেহারাগুলো ভুলিনি।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধারকাজ দেখতে দেখতে আবার ঝাপটা মারল বহু দিন আগে পিছনে ফেলে-আসা সেই মুখগুলো। সেই প্লাস্টিকের হলদে হেলমেট। সেই তোবড়ানো মুখ। ভেঙে যাওয়া গাল। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে এসেছে। গায়ে ধুসো চাদর। প্রান্তিক এবং উলোঝুলো অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে-থাকা সব মানুষ।

র‌্যাটমাইনার্স!

যাঁদের পেশা ‘র‌্যাট হোল মাইনিং’। অর্থাৎ, ইঁদুরের মতো মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে নীচের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে কয়লা তুলে আনা। যে পেশা এ দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে! ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল র‌্যাট হোল মাইনিংকে। ২০১৪ সালে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালও ওই পদ্ধতিকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে। কারণ, ওই পদ্ধতি ‘অবৈজ্ঞানিক’! তারা বলেছিল, এমন প্রচুর ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মাটির নীচে খোঁড়া ওই সমস্ত গর্তে বর্ষাকালে বৃষ্টির জল প্রবল প্রতাপে ঢুকে খনির পর খনি ভাসিয়ে দিয়েছে। সেই জলে আটকে পড়ে প্রাণহানি হয়েছে প্রচুর। কিন্তু তার পরেও ‘বেআইনি’ ভাবে এই খনন চলে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। সবচেয়ে বেশি উত্তর-পূর্বের রাজ্য মেঘালয়ে। মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তিয়া, পশ্চিম জয়ন্তিয়া এবং পশ্চিম খাসি পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কয়লা তোলার এমন সব সুড়ঙ্গ। মাটির নীচে কয়লার স্তর পর্যন্ত পৌঁছে আড়াআড়ি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে কয়লার স্তর থেকে কয়লা তুলে আনেন র‌্যাটমাইনার্সরা। ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তীসগঢ়েও এই ধরনের খননের কথা শোনা যায়। তবে বিশেষজ্ঞেরা বলেন, ওই দু’টি রাজ্যে মেঘালয়ের তুলনায় কয়লার স্তর অনেক পুরু এবং কঠিন। ফলে ঝাড়খণ্ড বা ছত্তীসগঢ়ে র‌্যাট হোল মাইনিং সম্ভব নয়।

কিন্তু এই পোড়া দেশে মানুষের জীবনের দাম সবচেয়ে কম। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পেট চালাতে হয়। ফলে র‌্যাটমাইনার্সরা তাঁদের পেশা ছেড়ে আসতে পারেননি। আপাতদৃষ্টিতে ‘বেআইনি’ হলেও ধরিত্রীর গহিনে অভিযান জারি ছিল। বাস্তবের সঙ্গে জীবিকার সেই টানাপড়েনের ফলেই সম্ভবত ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট আগেকার কড়া নিষেধাজ্ঞা সামান্য শিথিল করে। দেশের শীর্ষ আদালত জানায়, মেঘালয়ে ওই প্রক্রিয়া চলতে পারে। তবে ১৯৫৭ সালের খনি আইন (মাইন‌স অ্যান্ড মিনারেল্‌স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যাক্ট) এবং ১৯৬০ সালের ‘মিনেরাল কনসেশন রুল’ অনুযায়ী। মণিপুর সরকার ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যায়। তাদেরও বক্তব্য ছিল, পার্বত্য এলাকায় আর কোনও পদ্ধতিতে কয়লা তোলা সম্ভব নয়। ২০২২ সালে মেঘালয় হাই কোর্ট একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। তাদের কাজ এখনও চলছে। যেমন মেঘালয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে র‌্যাট হোল মাইনিং। বন্ধ করা যায়নি।

প্রথমে পাহাড়ি ঢালু জমিতে লম্বালম্বি গর্ত খোঁড়া। সেই গর্তের গভীরতা তিনশো থেকে চারশো ফুট পর্যন্ত হতে পারে। গর্ত খোঁড়ার পরে লম্বা দড়ি বেয়ে বা বাঁশের মই দিয়ে শ্রমিকেরা নীচে নামেন। সেখানে কোদাল বা খন্তা দিয়ে আড়াআড়ি সুড়ঙ্গ খুঁড়তে শুরু করেন। খুঁড়তে খুঁড়তে কয়লা বার করে বালতিতে বোঝাই করে উপরে নিয়ে আসেন। সেই সুড়ঙ্গ খুঁড়তে খুঁড়তে ২০০ ফুট লম্বা হয়ে গিয়েছে, এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। মাটির নীচে অন্ধকার, নিকষ, দমবন্ধ-করা সুড়ঙ্গ। তার মধ্যে পাথর কেটে কেটে প্রায় বুকে হেঁটে (সেনাবাহিনীর পরিভাষায় ‘মাঙ্কি ক্রল’) এগোনো। ভাবতে বিবশ লাগে। চোখ বুজলে মুহূর্তে যে অন্ধকার ঘিরে ধরে, চোখ খুললেও সেই অন্ধকারই থেকে গেলে যেমন দিশেহারা আর বিভ্রান্ত লাগে।

মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তিয়া পাহাড়ে এমনই এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এক মাস ধরে আটকে থাকার পরে মৃত্যু হয়েছিল ১৫ জনের। দু’টির বেশি দেহ উদ্ধার করা যায়নি। পাঁচ জন জীবন্ত বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তা-ও দু’মাস টানা চেষ্টার পর। সাত মাস পরে উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালেও একই রকম দুর্ঘটনা ঘটেছিল এমনই সুড়ঙ্গে জল ঢুকে। প্রথমে তিনটি দেহ উদ্ধার করা গিয়েছিল। তার পরে এক মাস চেষ্টা করে উদ্ধার অভিযান ‘পরিত্যক্ত’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে মনে হচ্ছিল, ওই সব উদ্ধার অভিযানের মতোই ‘পরিত্যক্ত’ তো র‌্যাটমাইনার্সরাও! বিকল্প কোনও পেশার ব্যবস্থা না-করেই রাষ্ট্র তাঁদের সটান বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল। কিমাশ্চর্যম, গত মঙ্গলবার রাতে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে সেই লোকগুলোই ত্রাতা হয়ে উঠল! অত্যাধুনিক সমস্ত প্রযুক্তি যখন ব্যর্থ হয়েছে, ভেঙে গিয়েছে আমেরিকাজাত ‘অগার ড্রিল মেশিন’, সারা দেশ যখন প্রহর গুনছে সুড়ঙ্গে আটক ৪১টি প্রাণের উদ্ধার বা অবসানের, অপেক্ষা করতে করতে কখনও হাল ছেড়ে দিচ্ছে আবার কখনও আশার মোমবাতি জ্বালাচ্ছে, তখন ১২ জন প্রান্তিক মানুষ অন্ধকার সুড়ঙ্গে কংক্রিট কাটতে কাটতে পৌঁছে গেলেন জীবনের দরজায়। যাঁরা আদতে রাজধানী দিল্লির নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী একটি সংস্থার নিম্নতম বর্গের চাকুরে। যাঁদের পেশা হল মাটির নীচের সুড়ঙ্গে নেমে নর্দমা সাফাই!

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, বিশ্বকাপ ফাইনালের চেয়েও অনেক, অনেক বড় একটা ম্যাচ জিতে গেল এই দেশ। ১৯ নভেম্বর আমদাবাদে ১৪০ কোটি ভারতবাসী হেরেছিল। ২৮ নভেম্বর উত্তরকাশীতে ১৪০ কোটি ভারতবাসী জিতল। ১৯ নভেম্বর মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা। ২৮ নভেম্বর উদ্বেল হল আসমুদ্রহিমাচল।

খেলার মধ্যে একটা ব্যাখ্যাতীত জাদু ‌আছে। খেলা আশা দেয়। আবার পরমুহূর্তে চূড়ান্ত হতাশ করে। খেলা এমন এক আখ্যান তৈরি করে, যা আসলে ত্যাগস্বীকার এবং মনুষ্যত্বের স্পিরিটের জাদুবাস্তবতার আশ্চর্য মিশেল। খেলা হল এক এমন ঐকতান, যা দেশকালের সীমা মানে না। ভূগোলের দাসত্ব করে না। কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে ফেলে। খেলা আমাদের জীবন্ত বোধ করায়। প্রতি মুহূর্তে বোধ করায়— বেঁচে আছি! বেঁচে আছি!

উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে ১২টি প্রান্তিক মানুষও আমাদের দেখালেন— বেঁচে আছে! বেঁচে আছে!

একটা গোটা দেশকে জীবনের ট্রফি এনে দিলেন কতগুলো ব্রাত্য, বাতিল, আপাতদৃষ্টিতে ‘অপরাধী’ মানুষ। ইঁদুরের মতোই যাঁদের বাস সমাজের অন্ধকারে। যাঁদের উপর কোনও আলো-বাতাস পড়ে না। যাঁদের কথা কেউ কখনও বলে না। যাঁদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া উদ্বেল হয় না। যাঁরা সে ভাবে কারও ‘এক্স হ্যান্ডলে’ জায়গা পান না। যাঁদের জন্য চটজলদি কোনও পুরস্কার ঘোষণা করা হয় না। কারণ, তাঁরা নাগরিক দঙ্গলে ব্রাত্য। অপাঙ্‌ক্তেয়। তাঁদের ছোঁয়া আমরা এড়িয়ে চলি। তাঁদের হেলাফেলায় ‘তুই’ সম্বোধন করি। তাঁরাই জীবনের মহাকাব্য লিখে গেলেন। অন্ধকার সুড়ঙ্গে জ্বালিয়ে দিলেন জীবনের আলো। উত্তরকাশীর অন্ধকার আকাশে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল জীবনের পায়রার ঝাঁক।

তবে কিনা, যে কোনও মহাকাব্য তো এ ভাবেই তৈরি হয়। উপেক্ষিত মানুষের জীবন থেকে। কিন্তু তাতে কি সেই মানুষগুলোর জীবন বদলায়? সে দেশের ইতিহাস বদলায়? এর পরে কি র‌্যাটমাইনার্সদের ‘শস্ত্র’ বলতে থাকবে সেই পলকা প্লাস্টিকের হেলমেট? না কি তাঁদের জীবনের দাম একটু বেশি হবে? তাঁদের পেশা একটু সম্মানিত হবে? সমাজে তাঁদের অবস্থান খানিক উন্নত হবে?

নাহ্। তেমন হয়নি। হয় না। যুগে যুগে, কালে কালে দধীচিরা জীবন দেন, যাতে তাঁদের হাড় দিয়ে বজ্র তৈরি হতে পারে। যে আয়ুধ প্রয়োগে দেবরাজ ইন্দ্র বধ করেন বৃত্রাসুরকে।

দধীচিদের আর কে মনে রাখে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE