Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Violence

ঘরে বাইরে হিংসার তাণ্ডব

যে কোনও যুদ্ধ বা সংঘর্ষ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনই শুধু ছিনিয়ে নেয় না, তাকে নিরাশ্রয়ও করে।

মালবী গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২২ ০৪:৫৮
Share: Save:

যুদ্ধ বা লড়াইটা চলছেই। কারণ, পৃথিবীতে জন্মমুহূর্ত থেকে সমস্ত প্রাণের ভিতর ও বাহিরে টিকে থাকার নিরন্তর লড়াই চলতেই থাকে। তবে, মানুষই বোধ হয় একমাত্র প্রাণী, যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্যতার বাইরেও জারি রাখে অন্য এক লড়াই। সে লড়াই হিংসার চাবুক হাতে, নিরতিশয় লোভ, ক্ষমতা, আধিপত্য ও আগ্রাসনের পিঠে চড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেয় হিংসার বীজ। অযুত সংঘর্ষের জন্ম দেয়। তা না হলে কি এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রায় ২০০ কোটি মানুষ সংঘাতদীর্ণ এলাকায় বাস করতেন? যা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ! তা না হলে কি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হিংসা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য শুধু গত বছরই পৃথিবীতে ৮ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ উৎখাত হতেন?

রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব তেমনটাই বলছে। প্রাচীন যুগ থেকে এই উত্তর আধুনিক যুগেও যুদ্ধের পরম্পরা অব্যাহত। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন, মায়ানমার, ইথিয়োপিয়া, ইউক্রেন— বিশ্বের নানা প্রান্তই অনন্ত লড়াই বা সংঘর্ষে দীর্ণ। দুটো বিশ্বযুদ্ধের পরেও বিশ্বশান্তি যেন অধরাই রয়ে গেল। দেখা যাচ্ছে, বিবিধ আন্তর্দেশীয়, আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তি বা প্রতিশ্রুতিও বিফল হচ্ছে। পৃথিবীতে বিবদমান নানা রাষ্ট্র, জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘটিত লড়াইয়ে দাঁড়ি পড়ছে না। সে যতই সংঘর্ষ শিশু, নারী-সহ কোটি কোটি মানুষকে গৃহহীন, রাষ্ট্রহীন করে চরম দুর্দশা ও অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষেপ করুক না কেন!

ইউনিসেফ-এর মতে, গৃহযুদ্ধে দীর্ণ ইয়েমেনে ২০ লক্ষের বেশি শিশু অবর্ণনীয় খিদে আর অপুষ্টির শিকার। মায়ানমারের সংঘর্ষে প্রায় ৮,৮০,০০০ ছিন্নমূল রোহিঙ্গাকে দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়েছে, তার অর্ধেকই শিশু। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানাচ্ছে, কয়েক দশকের লড়াই আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি মানুষকে চরম খাদ্যসঙ্কটে ফেলেছে। সেখানে ৯০ লক্ষ মানুষ এখন প্রায় দুর্ভিক্ষের কবলে। চরম দারিদ্রের মুখে বহু পরিবারই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছে কিডনি বেচতে, বা সন্তানদের বিক্রি করতে!

এ ঘোর সঙ্কটের কাল। উন্মত্ত হিংসা এখন দেশে দেশে সনাতন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে, নিত্য উঠে আসছে পথেঘাটে, মাঠে-ময়দানে। অনেক বেশি করে ঢুকে পড়ছে পাড়ায় পাড়ায়, ঘরের অন্দরেও। অহরহ বিপুল মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে নানা অপরাধ, গোষ্ঠী-সহিংসতা ও জঙ্গিহানার হাত ধরে। ক্রমশই বেড়ে চলা সেই সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রপুঞ্জ গোটা বিশ্বকে এ বিষয়ে সতর্ক করছে।

যে কোনও যুদ্ধ বা সংঘর্ষ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনই শুধু ছিনিয়ে নেয় না, তাকে নিরাশ্রয়ও করে। সন্তানহীন, পরিবারহীন করে। খাদ্য, জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলি কেড়ে নিয়ে তাকে ঠেলে দেয় এক অতলান্তিক অনিশ্চয়তার মধ্যে। তায়, বিভিন্ন দেশেই এখন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক গণ-সহিংসতার পাশাপাশি, ব্যক্তিহিংসারও প্রবল লক্ষ্য হয়ে উঠছেন নারী, শিশু-সহ সাধারণ নাগরিক। লক্ষ্য সমাজকর্মী, সাংবাদিক, প্রতিবাদী, পরিবেশ আন্দোলনকারী, মানবাধিকার কর্মী— কে নয়? নিজের দেশ ও রাজ্যের গত কয়েক মাসের সংবাদপত্রের পাতাতেই তার অসংখ্য নজির। যেখানে ভেসে ওঠে বীভৎস অত্যাচার, ধর্ষণ, খুন, গণহত্যা, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা’সহ পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারার চরম নৃশংসতার ছবি। যা জানান দেয়, এই সব অপরাধের বীজ খুব নিঃশব্দে বোনা হচ্ছে আমাদেরই হিংসাদীর্ণ গোপন মনোভূমিতে।

যার শিকড়বাকড়ে, ডালপালায় ছড়িয়ে অপরিসীম লোভ, ক্ষমতালিপ্সা, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও আধিপত্যবাদ। আমরা যেন হিংসা ও সংঘাতের এক নতুন যুগের মধ্য দিয়েই চলেছি। মনে হচ্ছে, খানিক অভ্যস্তও হয়ে উঠছি রোজকার ওই সব নৃশংসতায়। যাকে সমাজও যেন এখন এক প্রকার মান্যতা দিচ্ছে!

মুশকিল হল, এই লড়াই বা সংঘাত প্রশমনে দেশ-রাজ্যের শাসনযন্ত্র উদাসীন। বরং, কখনও সেই সংঘাত সংঘর্ষে পরোক্ষ মদতদানে উৎসাহী। কিংবা নিজেই তাতে সক্রিয় অংশ নিয়ে নিজেদের তৈরি নীতিমালা ও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পীড়নের দণ্ড হাতে তুলে নিচ্ছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘৃণা ও হিংসার আগুন। সেই আগুনের তাপে মানুষ আরও অসহায়, আরও কোণঠাসা।

যে কোনও দেশের রাষ্ট্র বা রাজ্য-প্রশাসক ক্ষমতার সিংহাসনটিকে যে ভাবেই হোক প্রশ্নহীন, প্রতিবাদহীন করে তুলতে চায়। এবং তাকে দীর্ঘস্থায়ী, সম্ভব হলে আজীবন নিজের দখলে রাখতে চায়। শুধু শি চিনফিং বা পুতিনই নন, এ বিষয়ে বিশ্বে তাঁদের বহু সতীর্থ মিলবে। সমাজ বা পরিবারের ক্ষেত্রেও লাগাম হাতে থাকা ক্ষমতাবানরা চান, সেখানে সংঘটিত অন্যায় বা অপরাধ যতই তীব্র হোক, নির্যাতিতকে তাঁর প্রতি থাকতে হবে প্রশ্নহীন, প্রতিবাদহীন। কিন্তু বাস্তবে সব সময় যে তেমনটা ঘটে না। তাই প্রশ্ন ওঠে। গর্জে ওঠে প্রতিবাদ। আর হিংসা তার প্রবল অট্টহাস্য নিয়ে পৃথিবীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Violence World
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE