সেই পুরনো প্রশ্ন বার বার ফিরে আসে— বাঙালি কেন ব্যবসা-বিমুখ? বাঙালি কি ব্যবসার ঝুঁকি বা ধকল নিতে অক্ষম? দেশ যখন স্বাধীন হল, তখন ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা ছিল এক নম্বরে। এখনকার মহারাষ্ট্র এবং গুজরাত এই দুই রাজ্য মিলিয়ে তখনকার যে বোম্বাই প্রদেশ, তার চেয়েও এগিয়ে ছিল বাংলা। এটা সত্যি যে, সেই সময়ে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগ ছিল ব্রিটিশদের মালিকানাধীন। চা, চট এবং কয়লা, এই তিনটে প্রধান শিল্প ছাড়াও কারিগরি, কাগজ, তামাক, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি শিল্পও ছিল বহুলাংশে বিদেশিদের দখলে। কিন্তু তাই বলে বাঙালিদের নিজস্ব উদ্যোগ ছিল না, এমন নয়।
স্বাধীনতার পর চা-চট-কয়লা শিল্পের ঔপনিবেশিক উদ্যোগপতিরা একটু একটু করে তাঁদের সংস্থাগুলো দেশি ব্যবসাদারদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে গেলেন, এবং পরবর্তী কালে সেই সংস্থাগুলোর বেশির ভাগই রুগ্ণ হয়ে পড়ল, এটাই ইতিহাস। ঔপনিবেশিক উদ্যোগের পাশাপাশি ছিল ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থাগুলি। ১৯৫০ সালেও তেমন ৪১টি সংস্থার মধ্যে ৩২টির সদর দফতর ছিল কলকাতায়। প্রায় সকলেই ধীরে ধীরে বাংলা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পশ্চিম ভারতে আস্তানা গাড়ল। একই সঙ্গে যে সব বাঙালি সংস্থা স্বদেশি আদর্শে তৈরি হয়েছিল, পঞ্চাশ-ষাট দশকেও যেগুলো দাপটে ব্যবসা করত, সেগুলো ক্রমশ দুর্বল হতে হতে হয় একেবারে বন্ধ হয়ে গেল, আর নাহয় সরকারি দাক্ষিণ্যে কোনওক্রমে নামমাত্র টিকে রইল।
স্বাধীনতার পরে ঔপনিবেশিক সংস্থাগুলো রুগ্ণ হয়ে পড়ার একাধিক কারণ ছিল। এই সংস্থাগুলো মূলত রফতানির জন্য উৎপাদন করত, ফলে আন্তর্জাতিক বাজার এবং মুক্ত বাণিজ্যের উপরে এদের প্রবল নির্ভরতা ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে মুক্ত বাণিজ্যের উপর নানা রকম বিধিনিষেধ চাপল, ফলে পুরনো নিয়মে ব্যবসা করা এদের পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া ব্রিটিশ আমলে এরা সরকারের কাছ থেকে যে ধরনের সহায়তা বা আশ্বাস পেত, স্বাধীন ভারতে সেটা সম্ভব ছিল না। হয়তো এই সহায়তা বা আশ্বাস ঔপনিবেশিক সংস্থাগুলোর কাঠামো ও কার্যপদ্ধতিকে কিছুটা শিথিল করে দিয়েছিল যেটা দিয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক কঠিন প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা শক্ত ছিল। কিছু সংস্থা লুটও হয়েছিল। যারা সেগুলো কিনেছিল, তাদের দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনে উৎসাহ ছিল না।
বহুজাতিকরা অবশ্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রির জন্যই মূলত উৎপাদন করত। কিন্তু ষাটের দশকের ঘেরাও রাজনীতি, নকশাল আন্দোলন, শ্রমিকদের কম উৎপাদনশীলতা এবং সবার উপরে পশ্চিম ভারতে ক্রমোন্নত ব্যবসা-বাণিজ্যের আবহাওয়া তাদের পশ্চিমমুখী করেছিল। স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাঙালি উদ্যোগপতিদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো ছিল না তা নয়, কিন্তু যে-হেতু তাঁরা ভূমিপুত্র, যে-হেতু বাংলা মাটির প্রতি, বাঙালি যুবসমাজের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা ছিল নিখাদ, রাজ্যের শিল্প-মানচিত্র থেকে তাঁদের ক্রমশ হারিয়ে যাওয়াটা গভীরতর জিজ্ঞাসার দাবি রাখে।
যে বাঙালি উদ্যোগপতিদের স্বদেশি আদর্শ ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, ব্যবসায় না এলে বাঙালির উন্নতি হবে না। বাংলারও উন্নতি হবে না। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, ইউরোপ-আমেরিকায় লেখাপড়া করা মানুষ। তাঁদের পথিকৃৎ ছিলেন ভারতে রসায়ন-চর্চার জনক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এডিনবরা থেকে ফিরে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি স্থাপনা করলেন বেঙ্গল কেমিক্যালস। তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তৈরি হল ক্যালকাটা কেমিক্যাল, বেঙ্গল ল্যাম্প, বেঙ্গল ইমিউনিটি, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ ইত্যাদি। বেঙ্গল ল্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই সুরেন রায় ও কিরণ রায় জার্মানিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ক্যালকাটা কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা খগেন্দ্রচন্দ্র দাশ ছিলেন বার্কলি এবং স্ট্যানফোর্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন আর এক উদ্যোগপতি, বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ ওয়ার্কস-এর প্রতিষ্ঠাতা সুরেন্দ্রমোহন বসু। বেঙ্গল ইমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়। পরে এই সংস্থার পরিচালনার ভার তিনি অন্য এক চিকিৎসক, নরেন্দ্রনাথ দত্ত-র হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
সেই সময়ের আন্দাজে স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি সংস্থাগুলো প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে ছিল। পরিচালনাতেও দক্ষতার অভাব ছিল না। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতাদের মৃত্যুর পরে একে একে সংস্থাগুলি রুগ্ণ হয়ে পড়ল। এর একটা কারণ নিশ্চয় ষাটের দশকের অশান্ত বাংলা, অবান্ধব শিল্প-পরিবেশ এবং পরবর্তী কালে শিল্পের প্রতি বামফ্রন্টের দীর্ঘ অবহেলা। কিন্তু এগুলি একমাত্র কারণ নয়। যে স্বদেশি আবেগ থেকে এই সংস্থাগুলির জন্ম হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই আবেগটাই আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে এল। ব্যবসা করার প্রেরণাটা যদি স্বদেশি আবেগের বদলে বাণিজ্য-মনস্কতা থেকে আসত, তা হলে হয়তো সংস্থাগুলি টিকে যেত। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতাদের পরবর্তী প্রজন্ম যতটা উচ্চশিক্ষিত ছিল, ততটা বাণিজ্য-মনস্ক ছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
স্বাধীনতার আগে যে সব বাঙালি সংস্থার জন্ম হয়েছিল, তার সব ক’টিই কিন্তু লুপ্ত হয়ে যায়নি। চা, ওষুধপত্র, গুঁড়ো মশলা, গায়ে-মুখে মাখার ক্রিম, ছাতা, গয়নাগাটি থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, সংবাদপত্র এবং প্রকাশনা অবধি একটা বিস্তৃত পরিসরে পুরনো বাঙালি ব্যবসায়ীরা বহু দিন ধরে ভালই ব্যবসা করছেন। পুরুষানুক্রমে এঁরা ব্যবসায়ী, অনেকেই বাঙালি বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ, বাণিজ্য-মনস্কতাই এঁদের চালিকাশক্তি। এঁদের সংস্থাগুলোকে দৈত্যাকার কর্পোরেট বলা যাবে না, কিন্তু প্রতিটিই স্থিতিশীল, দক্ষ, লাভজনক। অর্থাৎ আমরা বলতে চাইছি, কোনও নৈর্ব্যক্তিক আদর্শ— তা সে যত মহানই হোক— দীর্ঘ দিন ব্যবসাকে ধরে রাখতে পারে না। ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য দরকার বাণিজ্য-মনস্কতা— ঝুঁকি নেওয়ার সাহস, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, মুনাফা করার অদম্য ইচ্ছা। সাধারণত এই প্রবণতাগুলো বণিক সম্প্রদায় অথবা পুরুষানুক্রমে যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের মধ্যেই দেখা যায়।
ভারতের বাণিজ্যিক ইতিহাস মূলত বণিক সম্প্রদায়দের ইতিহাস। পশ্চিম ভারতে বাণিজ্যিক অগ্রগতি ঘটেছিল পার্সি, ইহুদি, বানিয়া, জৈন, ভাটিয়া, বোহরা ও খোজা মুসলমান ইত্যাদি বণিক সম্প্রদায়ের হাত ধরে। পূর্ব ভারতের প্রধানতম বণিক সম্প্রদায় মারোয়াড়িরা। দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতিতে চেট্টিয়ার, নাদার, মুদলিয়ার, নায়ডু ইত্যাদি বণিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সম্প্রতি তামিলনাড়ুর তিরুপুরে গৌন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের কৃষিজাত আয় বিনিয়োগ করে গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্রশিল্প গড়ে তুলেছেন।
বণিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ব্যবসায়ীরা নানা ভাবে একে অপরকে সাহায্য করেন। এক জনের হঠাৎ টাকার দরকার হলে অন্য এক জন এগিয়ে আসেন এই অলিখিত চুক্তিতে যে, ভবিষ্যতে দ্বিতীয় জনের টাকার দরকার পড়লে প্রথম জন এগিয়ে আসবেন। এটা এক ধরনের সম্প্রদায়-ভিত্তিক পারস্পরিক বিমা-ব্যবস্থা। সম্প্রদায়ের ভিতরে বাস করতে করতে তৈরি হয় পারস্পরিক সহযোগিতা, বিশ্বাস। সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকলে ধার পাওয়া সহজ, ধার নিয়ে শোধ না-দেওয়া কঠিন। বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরকে প্রযুক্তি, বিক্রির বাজার, কাঁচামাল কেনা, নির্ভরযোগ্য লোকনিয়োগ ইত্যাদি নানা ব্যাপারে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সম্প্রদায়ের মধ্যে লেনদেন অনেক সহজ। চুক্তি অনুযায়ী লেনদেন না হলে সম্প্রদায়ের মধ্যেই তার মীমাংসা করা যায়, টাকা ও সময়ের অপব্যয় করে আদালতে যেতে হয় না। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সম্প্রদায়-ভিত্তিক কোনও বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক এক বার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ওই সম্প্রদায়ের আরও অনেক নতুন উদ্যোগপতি উৎসাহিত হয়ে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেন।
যে প্রশ্নটা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটায় ফিরে আসি— বাঙালি কেন ব্যবসা-বিমুখ? পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটাই মারোয়াড়ি এবং কিছুটা গুজরাতি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দখলে। বহু দিন ধরে এঁরা বাংলায় ব্যবসা করছেন। নিশ্চয় ভবিষ্যতেও করবেন। কিন্তু কোনও অঞ্চলে একটা বা দুটো বিশেষ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগ তাঁদের হাতে চলে গেলে, অন্য সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে অন্য সম্প্রদায় থেকে আসা নতুন উদ্যোগপতিদের অসুবিধা হয়। কারণ প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা তাঁদের সম্প্রদায়ের নেটওয়ার্ক থেকে যে সুবিধাগুলো পান, বাইরের উদ্যোগপতিরা সেগুলো পান না। তাই বাঙালিদের ব্যবসায় উন্নতি করতে হলে, নতুন বাঙালি উদ্যোগপতিদের ব্যবসায় আসার রাস্তাটা সহজ করতে হলে, বাঙালি ব্যবসায়ীদের একটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। অন্যান্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মতো একটা শক্তিশালী বাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তৈরি করতে হবে।
এই প্রয়াসের মধ্যে প্রাদেশিকতা নেই, ইতিহাসের শিক্ষা আছে। যে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ব্যবসা করছেন, তাঁদের উদ্যোগেই এটা হওয়া সম্ভব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)