পরিবেশ নিহত হচ্ছে যুদ্ধে। বিপুল হারে, কিন্তু তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়। সেই কোন সুদূর অতীত থেকে এই উত্তর আধুনিক যুগেও চলতে থাকা যুদ্ধ-সংঘাত-সংঘর্ষে নিহত ও আহত মানুষের পরিসংখ্যান হয়তো মিলছে। তবে তাতে ধ্বংস হওয়া পরিবেশের তথ্য বেশির ভাগই অধরা থেকে যাচ্ছে। যার অপরিসীম প্রভাব মানুষের জীবনকেই ধ্বস্ত করে চলেছে। এর আর্থসামাজিক মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভবই।
কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে, সে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ হোক, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ কিংবা ইরাক, আফগানিস্তান ও সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই হোক, মানুষের পাশাপাশি কোটি কোটি গাছপালা, বন্যপ্রাণ নিহত হচ্ছে। ব্যবহৃত আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, বিস্ফোরক ও রাসায়নিক জল-মাটি-বাতাসের ব্যাপক দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। বিধ্বস্ত হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ। পরিবেশের উপর যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে ১৯১৪-২০২৩ পর্যন্ত পৃথিবীর নানা দেশে করা ১৯৩ কেস স্টাডি জানাচ্ছে, যুদ্ধে অরণ্য ধ্বংস (৩৪%) ও ভূমিক্ষয় (২৩%) ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।
আর ইজ়রেইলি হামলায় এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজ়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে মাত্র তিন মাসের যুদ্ধেই নথিভুক্ত হয়েছিল ৫ বছরের কম বয়সি ১,৭৯,০০০ শিশুর মারাত্মক শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ এবং ১,৩৬,০০০ শিশুর ডায়রিয়ার ঘটনা, যা ঘটেছিল পরিবেশগত কারণেই। আসলে যে যুদ্ধ কোটি কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, সেই যুদ্ধই ধ্বংস করে দেয় জনস্বাস্থ্য পরিষেবা। ধ্বংস করে দেয় জীবনের জন্য অপরিহার্য প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ। কারণ, বড় ছোট সমস্ত যুদ্ধ ও সংঘাতে যে সব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, তার প্রভাবে পৃথিবীতে ব্যাপক উষ্ণায়ন ও দূষণ ঘটে চলেছে, যার অনিবার্য পরিণতিতে জলবায়ু পরিবর্তনেও বড় ধাক্কা এসে লাগছে। বর্তমান তার মূল্য চোকাচ্ছে। ভবিষ্যৎকেও নানা ভাবে চোকাতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে শুধু ২০২৩-এই ১৭০টির বেশি সশস্ত্র সংঘাত ঘটেছে। সেই বছর শেষে পৃথিবীর ১২ কোটি মানুষকে জোর করে উৎখাত করা হয়েছে তাঁদের বাসভূমি থেকে। এবং সেই সব সংঘাতে সামগ্রিক ভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপরও বিশাল প্রভাব পড়ছে। ধরা যাক, সভ্যতার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বিনাশী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। তাতে সেনা ও সাধারণ নাগরিক নিয়ে প্রায় ৮ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এবং সেই যুদ্ধ থেকেই পরমাণু বিস্ফোরক তথা বোমা এবং নানাবিধ রাসায়নিকের যে ব্যবহার শুরু হল, তাতে বিশ্ব পরিবেশের উপর এক অনিবার্য ও চিরস্থায়ী প্রভাব পড়ে চলেছে। এর মোকাবিলা করাও প্রায় অসম্ভব।
রাশিয়ার ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় বাস্তুতন্ত্রের উপর যে আঘাত পড়েছে, তাতে নানা উদ্ভিদ, স্তন্যপায়ী-সহ বিপুল বন্যপ্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আর স্থানীয় অরণ্যনির্ভর জীবিকা যাঁদের, তাঁরা একাধারে সবই হারিয়েছেন। তবে আশ্চর্য এই যে, নিরবধি কাল ধরে যুদ্ধে সংঘর্ষে মানুষ একাধারে হত্যা করে চলেছে মানুষকে। আবার যুদ্ধে যোগদানকারী সেই মানুষই একই সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের মূলে অবিরত কুঠারাঘাতে নিজস্ব বাসভূমিকেও চরম নৃশংসতায় ধ্বংস করে চলেছে।
হয়তো সেই কারণেই গার্ডিয়ান-এর চিত্রগ্রাহক, দু’বারের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো উইনার অ্যালেসিও ম্যামো বলেছেন, “যুদ্ধ হল প্রকৃতির উপর মানুষের হিংসার চরম উদাহরণ।” তিনি দীর্ঘ দিন ধরে সিসিলি, পশ্চিম এশিয়া, বলকান, ইউক্রেনে সেনা, সাধারণ মানুষ, ও পরিবেশের উপর যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে ছবি তুলে চলেছেন। গার্ডিয়ান-এর একটি প্রতিবেদন থেকেও জানা যাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের বৃহত্তম সংঘাত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে শুধু যে ছেচল্লিশ হাজারের বেশি ইউক্রেনের সেনা নিহত হয়েছেন তা-ই নয়, বহু শহর ও গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় লক্ষ লক্ষ নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। নাগরিকদের মতোই চরম দুর্দশায় পড়েছে সেখানকার পরিবেশও। বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠেছে বহু প্রজাতির অস্তিত্বে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড-এর হিসেব অনুযায়ী, ৩০ লক্ষ হেক্টরেরও বেশি অরণ্য সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত, যার মধ্যে ১০ লক্ষ হেক্টর অরণ্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ইউক্রেনের এই সংস্থার এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর ড. বোহদান ভাইকোর জানান যে, প্রকৃতির কিছু কিছু অংশ আমরা চিরতরে হারিয়েছি। অসংখ্য বন্যপ্রাণীর বসতিও একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আসলে যুদ্ধে ক্ষমতা প্রদর্শন, আগ্রাসন বা আধিপত্যবাদের ঔদ্ধত্যই পৃথিবীর নানা কোণে প্রাকৃতিক অরণ্য, পাহাড়, নদী, সমুদ্র সবই ধ্বংস করে চলেছে। সত্য যে, শুধু যুদ্ধই নয়, প্রায় ৫০,০০০ বছর আগেও মাত্র দু’লক্ষ হোমোসেপিয়েন্স যখন পৃথিবীর বুকে বিচরণ করত, তখনও জীবনধারণের তাগিদেই গাছপালা এবং বহু বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল তাদের হাতে।
তবে গ্রিনপিস ডট ওআরজি জানাচ্ছে, পরিবেশগত সচেতনতার উদ্দেশ্যে ৫০০০ বছর আগেও বৈদিক ঋষিদের স্তোত্রে বন্য প্রকৃতির প্রশংসা উচ্চারিত হত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০-এ গ্রিক দার্শনিক জেনো বলেছিলেন, “জীবনের লক্ষ্যই হল প্রকৃতির সঙ্গে চুক্তি করে জীবনযাপন করা।” কিন্তু চুক্তি দূরের কথা, বিশ্বের বিবদমান দেশগুলির ও সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনগুলির যুদ্ধ উন্মাদনা জল মাটি হাওয়াকে দূষিত করেই চলেছে। আর আমরা সারা বিশ্বের মানুষ, এই নীল গ্রহের সেই সর্বাত্মক ধ্বংসচিত্রের যেন নির্বাক দর্শকে পরিণত হয়েছি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)