বিবাহপ্রস্তাব বা প্রেম নিবেদন দিয়ে শুরু। তার পর চাপ দেওয়া, সামাজিক ভাবে। তার পর পিছু নেওয়া, সমাজমাধ্যমে আড়ি পাতা, এখানে-ওখানে পাকড়াও করা। শেষে, অ্যাসিড ছুড়ে মারা। শহর, শহরতলি, গ্রাম মফস্সলে প্রেমের পরিণতির এই ঘটনাক্রম বারংবার দেখা যায় যে কোনও অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রেই। জনপ্রিয় ছবিতে পিছু-লাগা নায়কেরা নায়িকাদের হাসিল করে নাছোড়বান্দার মতো। আর বাস্তবে, সম্ভাব্য প্রেমিকদের ‘প্রোমোশন’ হয় সম্ভাব্য হামলাকারীতে। কাহিনির স্ক্রিপ্টেও পরিবর্তন আসে না, আর পরিবর্তন আসে না এই বাস্তবেও যে, অ্যাসিড বিক্রির উপর নানা বিধিনিষেধ চাপিয়েও কাজ কিছু হচ্ছে না।
কাগজে সদ্য পড়া খবর, ‘বিয়েতে রাজি না হওয়ায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর উপর অ্যাসিড হামলা, চাঞ্চল্য মিনাখাঁয়’। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে লক্ষ্য করে অ্যাসিড ছুড়ল যুবক। কলকাতার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ছাত্রী। পরিবারের দাবি, শরীরের বেশির ভাগ আংশ ঝলসে গিয়েছে তার।এই সংবাদ নিয়ে বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি সমাজে বা সমাজমাধ্যমে। যেখানে গোটা মানুষ গায়েব হয়ে যায়, আস্ত মেয়েরা লোপাট হয়, মরে যায়, ধর্ষিত হয়, অ্যাসিড আক্রমণ সেখানে কী এমন ব্যাপার। নাহয় সারা জীবনের জন্য মেয়েটিকে লোকের আহা-উহু, ছি-ছি সইতে হবে, ভীত চোখ তাকে গিলবে নয় এড়িয়ে যাবে, বা সেলফি তুলে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করাই বন্ধ হবে তার! নিশ্চিত আকর্ষক, মিষ্টি চেহারা ছিল তার— যত বেশি সুন্দর, তত বেশি অ্যাসিড আক্রমণের মজা। সৌন্দর্যের দিকে আলকাতরা ছুড়তে না পারলে, অ্যাসিডই ছুড়ে দিই নাহয়!
মেয়েদের উপরে অধিকাংশ হিংসার ঘটনাই ঘটে পরিচিতদের দ্বারা, এ এক ‘সর্বজনীন’ তথ্য ও সত্য। অ্যাসিড আক্রমণের মতো ঘটনা প্রেমের ব্যর্থতার সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত হয়ে যায়, এখানেই চলে আসে পিতৃতন্ত্রের ‘এনটাইটলমেন্ট’ বা অধিকারবোধের কালচার। তোমাকে আমি ভোগ করতে চাই, যদি না পারি তা হলে অন্যকেও ভোগ করতে দেব না। তাই তোমার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেব। গভীর এই সামাজিক ক্ষতটি নষ্ট করে একটি পরিবারকে, একটি সুস্থ মানুষের দীর্ঘকালীন বিকলাঙ্গতা নিয়ে আসে। সৌন্দর্য ‘স্কিন-ডিপ’, কিন্তু অ্যাসিড শুধু মুখই পোড়ায় না, সারা শরীরকে জ্বালায়, অতি ব্যয়বহুল চিকিৎসার দিকে নিয়ে যায়।
কতই না সহজলভ্য এই অস্ত্র! খবর পড়ে মনে হয়, গ্রাম-মফস্সলে বুঝি অ্যাসিড-ভর্তি জেরিক্যান— খেলনা বন্দুক, দোলের আবির বা রঙের মতো যখন-তখন যে কেউ কিনতে পারে। অ্যাসিডের বিক্রিবাটায় নজরদারির ব্যাপারে নেই কোনও বাধানিষেধ বা সামগ্রিক সচেতনতাও— যে পদক্ষেপগুলি করে মেয়েদের উপর অ্যাসিড আক্রমণ অনেকটা কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ।
অথচ, ২০১৩-র পর থেকে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এই অপরাধকে জামিন-অযোগ্য, ‘কগনিজ়েবল অফেন্স’ করা হয়েছে। তথাপি জামিন পেয়ে যাচ্ছেন আক্রমণকারী। দণ্ডবিধিতে ৩২৭ ধারায় একটি উপধারা যোগ করা হয়েছে অ্যাসিড আক্রমণের ক্ষেত্রে, স্বেচ্ছায় কোনও বস্তু দিয়ে আক্রমণ করে কারও শরীরের ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে অপরাধ চিহ্নিত করার ধারা। যে অপরাধে দশ বছর অবধি কারাদণ্ড হতে পারে। ২০১৩-র পর যে নির্দেশাবলি জারি হয়েছে, তাতে অ্যাসিড বিক্রির ক্ষেত্রে নানা বাধ্যবাধকতা আনা হয়েছে। অ্যাসিড বিক্রেতার লাইসেন্স, যে কিনছে তার বৈধতা, কে দেখবে, কী ভাবে, এই সব নির্দেশিকা। যে কোনও নিয়মই পালন করতে বাধ্য করা, ভারতের জনগণের ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন। নিশ্চিত ভাবেই তার প্রতিফলন আসল কাজে নেই। না হলে হয়তো এমন ভাবে খোলা বাজারে অ্যাসিড কিনে ইচ্ছেমতো তা ছোড়াও কমত। রাজ্যে রাজ্যে আলাদা নজরদারির বিষয়টি এখানে এসে দাঁড়ায় সদিচ্ছার প্রশ্নে। শুধু আইন করে লাভ হয় না।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া, ২০২৩’ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩-এ দেশ জুড়ে ২০৭টি অ্যাসিড আক্রমণের কেস নথিভুক্ত হয়েছে, ‘ভিক্টিম’-এর সংখ্যা ২২০। সর্বোচ্চ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ, এক বছরে ৫৭টি ঘটনা। নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী উত্তরপ্রদেশ, ৩১টি। গুজরাত ১৫, ওড়িশা ১১, রাজস্থান ১১, অসম হরিয়ানা কেরল ১০টি, ঝাড়খণ্ড ও মেঘালয়ে একটি করে মাত্র। সারা ভারতের ২৭ শতাংশের বেশি ঘটনা যে পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে, আমাদের এই উদারনৈতিক, ‘এগিয়ে থাকা’ রাজ্যের পক্ষে খুব গৌরবের নিশ্চিত! গত বেশ কিছু বছর ধরেই অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনায় এগিয়ে বাংলা, ২০১৮ থেকেই শীর্ষস্থানে। ২০২২-এর রিপোর্টেও ছিল ৪৮টি ঘটনার খবর, যার ‘সারভাইভার’ বা ‘ভিক্টিম’ সংখ্যা ৫২। সার্বিক ভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচারের নিরিখে, ২০২২-এর ৩৪,৭৩৮ ঘটনার তুলনায় ২০২৩-এর ঘটনার সংখ্যা ৩৪,৬৯১।
দেশের মধ্যে জনসংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ স্থানে। তবে নানা অপরাধের মধ্যে অ্যাসিড হামলায় তার প্রথম স্থান অধিকার করাটা নিদারুণ। আরও করুণ এই যে, মাতৃবন্দনার বিপুল শঙ্খঘণ্টার আওয়াজে এই রিপোর্টের কথাও চাপা পড়ে হারিয়ে গেল। পুজো প্যান্ডেলে অ্যাসিড আক্রমণের ‘থিম’টুকু নিয়েই বেঁচে থাকা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)