কেন্দ্রীয় সরকার জানাল, পরের জনশুমারির সময় জাতিগণনাও হবে। ১৯৩১ সালের পর ভারতে জাতিগণনা হয়নি, যদিও তাতে জাতিভিত্তিক সমাজ-বিভাজন যে লোপ পেয়েছে, তা নয়। বরং, জাতিপরিচিতি ক্রমে রাজনীতির ভিত্তি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত নেই, এমন একটি ধারণা বহু দশক ধরে বদ্ধমূল— ভদ্রলোকি আধিপত্যবাদ এই ধারণাটাকে জিইয়ে রেখেছে। কিন্তু সম্প্রতি সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাতের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রভাব প্রকট হয়ে উঠছে। ২০২৬-এর নির্বাচনে এর কি কোনও প্রভাব পড়বে? বাংলায় অনতিঅতীতেও রাজনৈতিক দলই ছিল একমাত্র নির্ণায়ক প্রতিষ্ঠান— সেখানে ইতিমধ্যে হাজির হয়েছে ঘোর সাম্প্রদায়িক বিভাজন। এখন কি জাতিগণনা তাতে যোগ করবে নতুনতর মাত্রা?
প্রথম যখন জনগণনা আরম্ভ হয়, তখন থেকেই বিভিন্ন জাতি তাদের সামাজিক অবস্থান যা ছিল তার তুলনায় উঁচু হিসাবে নিজেদের তালিকাভুক্ত করতে চেয়েছিল। ও’ম্যালি লিখেছেন, ১৯১১-র জনগণনার সময় বাংলার সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, এর আসল উদ্দেশ্য বিভিন্ন জাতির সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করা। বহু জাতই নিজেদের জাত নাম বদলে দেওয়ার আবেদন করে, এবং এতে সার্থক হয়। এর ফল ভাল হয়নি— যারা সাংস্কৃতায়নের আওতায় এসে পড়ল, তারা নীচের দিকে ফেরেনি; তেমন বড় মাপের কোনও মধ্যজাতের নেতাও রাজনীতিতে উঠে আসেননি। এর একটা কারণ হতে পারে রাজ্যে মধ্য জাতির— অর্থাৎ, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি-র ভোটার কত, তা দীর্ঘ কাল নজরে আসেনি। ১৯৫১-য় তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষদের গণনা হলেও, অন্যান্য জাতির তথ্য সংগৃহীত হয়নি।
শেষ জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জাতি এবং জনজাতির জনসংখ্যা ২৯ শতাংশের বেশি— তফসিলি জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫৯, ও জনজাতি গোষ্ঠীর সংখ্যা ৩৮। বর্তমানে আবার সরকারি ভাবে স্বীকৃত কিছু অনগ্রসর জাতির তালিকা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ক্রমশ হিন্দু উচ্চবর্ণের সংখ্যা সঙ্কুচিত হচ্ছে।
বামফ্রন্ট সরকারের বিপরীতে হেঁটে বর্তমান সরকার ‘জাতি’ প্রশ্নকে অনেক দিন আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। দলিত সাহিত্য পরিষদ, বাউরি, বাগদি, নমশূদ্র, রাজবংশী ও কুর্মিদের জন্য উন্নয়ন পর্ষদ গঠন, হরিচাঁদ গুরুচাঁদ, পঞ্চানন বর্মার মতো দলিত নেতাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ এর কয়েকটি উদাহরণ। আলাদা আলাদা জাতভিত্তিক উন্নয়ন পর্ষদ গঠন— এখানে পশ্চিমবঙ্গে জাত প্রশ্নে একটি গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। এত দিন রাষ্ট্রের চোখে সবাই ছিল তফসিলি জাতি বা জনজাতি। এখন তাঁদের মধ্যেকার ধাপগুলো স্পষ্ট।
তবে এই জাতিগুলির নিজেদের জাতিভিত্তিক দাবি বিভিন্ন— কারও দাবি আলাদা রাজ্য গঠন, কারও দাবি ভাষার স্বীকৃতি, আবার অনেকের দাবি আদিবাসী মর্যাদা। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ দাবির অভাব। তাই বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো এখানে ‘বহুজন’ রাজনীতি এখনও সামনে উঠে আসেনি। জাতি প্রশ্নে বিভিন্ন ধাপ গড়ে ওঠা, এবং দাবির বিভিন্নতা তাদের শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করেছে এবং এই জাতিগত গোষ্ঠীগুলিকে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য তুলনামূলক ভাবে সহজ লক্ষ্য বানিয়ে তোলে। এর ফলে রাজ্য জুড়ে কোনও ঐক্যবদ্ধ জাতিভিত্তিক দাবি গড়ে ওঠেনি, এবং রাজ্যে জাতিভিত্তিক রাজনীতি ক্ষুদ্র ও তুলনামূলক ভাবে গুরুত্বহীন রয়ে গেছে।
প্রশ্ন হল, জাতিগণনা হলে অবস্থার পরিবর্তন কতখানি হবে? এখানেই উঠে আসে মধ্যম বর্গের জাতির সংখ্যাধিক্য এবং তাদের দাবির প্রসঙ্গ। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘যদুবংশীয় সদগোপ সমিতি’-র দীর্ঘ দিনের দাবি সদগোপ সমাজকে মণ্ডল কমিশনকৃত সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা; সদগোপ-সহ অন্যান্য মধ্যবর্গ, যেমন মাহিষ্য-তিলি-সাহাদের সঙ্গে মিলে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়া; গোপ-সদগোপ ঐক্য এবং জাতীয় স্তরের যাদব গোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলা; সদগোপ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার ও প্রচার ইত্যাদি। বাকি দলিত সংগঠনগুলির সঙ্গে তাদের দাবির একটি বিশেষ ফারাক দেখা যায়। তারা অন্যান্য মধ্যবর্গের সঙ্গে মিলে একটি বৃহত্তর জোটের দাবি তুলে ধরেছে এবং জাতীয় স্তরের যাদব গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম অনুভব করছে। এত দিন মধ্যম বর্গের এ ধরনের সামাজিক সংগঠনের দাবি শুধুমাত্র মিটিং-মিছিলে সীমাবদ্ধ ছিল। জাতিগণনা হলে এই দাবি একটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবে।
অনেক দিন ধরেই এ ধরনের সংগঠনগুলি এর অপেক্ষা করে আসছে, কারণ তাদের আশা: এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের জাতি-প্রশ্নকে সর্বভারতীয় স্তরে তুলে ধরা সম্ভব হবে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জাতি এবং ওবিসি মিলে যা জনসংখ্যা দাঁড়াবে, তা বিপুল। গ্রামীণ এলাকায় কিন্তু জমির মালিকানার কারণে এই মধ্যমবর্গের দাপট বিরাট। তাই স্থানীয় ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে তাদের জমিতেই। জাতগণনা হলে যে সমস্ত জাতির কোনও নির্দিষ্ট সংগঠন নেই, তারা সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবে নিজেদের জাতসত্তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ফলে একত্রে এই মধ্যমবর্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে ওবিসি ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির জন্ম দেবে; উঠে আসতে পারেন সেই বর্গের একাধিক নতুন নেতাও।
বিভিন্ন জাতির পৃথক উন্নয়ন পর্ষদ গঠন এমনিতেই একটা রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করে রেখেছে। জাতিগণনা হলে এই দাবিগুলিতে সিলমোহর পড়বে। অপর দিকে এই মধ্যমবর্গের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মানচিত্রে একটা পরিবর্তন আনবে। সদগোপ, মাহিষ্য, আগুরি-র মতো বৃহৎ মধ্যমবর্গের প্রাধান্য বীরভূম, বর্ধমান, মেদিনীপুরে। ফলে কলকাতার বা বড় শহরের আধিপত্য কমে আসবে, এবং গ্রাম-মফস্সল হয়ে উঠবে রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে শহুরে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের নিয়ে গঠিত ভদ্রলোকি জনপরিসরেও চিন্তা ও দুশ্চিন্তা দুই-ই বাড়ার সম্ভাবনা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)