E-Paper

শেষ পর্যন্ত ভিত্তিই ভরসা

অর্থনীতিতে প্রকৃত ইতিবাচক পরিবর্তন এলে তবেই শেয়ার বাজার ঊর্ধ্বমুখী হবে, নচেৎ নয়— এই তত্ত্ব আজ আর সে ভাবে জোরালো নয়।

নীলাঞ্জন দে

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৪ ০৭:৫৩

শেয়ার বাজারের সূচক তো রকেটের গতিতে বাড়ছে, কিন্তু এর সঙ্গে ফান্ডামেন্টাল বা মৌলিক অর্থনৈতিক শর্তগুলির সম্পর্ক কোথায়? গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েক বার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সম্পর্ক আছে, তবে এটাও সত্যি যে, এমন রুদ্ধশ্বাস ঊর্ধ্বগতির জন্য তেমন ফান্ডামেন্টালস না থাকলেও চলবে। অর্থনীতিতে প্রকৃত ইতিবাচক পরিবর্তন এলে তবেই শেয়ার বাজার ঊর্ধ্বমুখী হবে, নচেৎ নয়— এই তত্ত্ব আজ আর সে ভাবে জোরালো নয়। এমন বহু শেয়ার আছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট সংস্থার লাভের মাত্রা তেমন কিছু নয়, অথবা সংস্থাটি বাজারে নতুন— কিন্তু সেখানেও দাম চটজলদি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকৃত হয়েছেন বিনিয়োগকারী। কেবল বাজারের মোমেন্টাম বা ভরবেগ বুঝে লগ্নি করেন, এমন কৌশলী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা আজ আমাদের দেশে প্রচুর। তার জন্য তৈরি হয়েছে আলাদা সূচক; সরকারি নীতিও যথেষ্ট সহায়ক।

উল্টো দিকে কমেছে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের প্রবণতা। গত কয়েক বছরে যাঁরা শেয়ার বাজারে এসেছেন, তাঁরা দেখেছেন শুধু বাজারের চড়াই— উতরাইয়ের অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়নি। ফলে, শেয়ারের ‘প্রাইস’ ও ‘ভ্যালু’, অর্থাৎ মূল্য এবং মানের মধ্যে ফারাক তাঁদের অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়নি এখনও। সে কারণেই বাজারে কেনা-বেচা চলতে থাকে অবিশ্বাস্য গতিতে। স্বল্পসংখ্যক স্টকের পিছনে প্রচুর টাকা ধাবমান, এই দৃশ্য ইদানীং প্রায় জলভাত। সেই কারণেই বেড়ে চলেছে অল্প-খ্যাত স্টক; ঘন ঘন রি-রেটিংয়ের সম্ভাবনায় উদ্ভাসিত হচ্ছে ছোট-মাঝারি সেক্টর। খুব সম্প্রতি খবরে আসা পর্যটন ক্ষেত্রের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে যে কেবল প্রথম বার পর্যটন ক্ষেত্রের স্টকগুলি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ সূচক তৈরি হয়েছে, তা নয়— এই সূচকের ভিত্তিতে প্রথম মিউচুয়াল ফান্ডও বাজারে চলে এসেছে। ভরবেগ দেখে লগ্নি করা যদি এতটাই লাভজনক হয়, তবে আর কোনও সংস্থার ফান্ডামেন্টালস বিচার করব কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার পেশাদার পরামর্শদাতাদের অনেকেই।

বাজারে যে কোনও জিনিসের মতোই শেয়ারের দামও নির্ধারিত হয় জোগান ও চাহিদার সমতাবিধানের মাধ্যমে। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে; চাহিদায় ভাটা পড়লে দামও একই দিকে যাবে। কিন্তু, কোন অদৃশ্য জাদুকরের ছড়ির পরিচালনায় চাহিদা উত্তুঙ্গ হবে অথবা ধসে পড়বে, তা জানা যাবে কোন উপায়ে? নির্ভুল ভাবে জানার উপায় নেই, কিন্তু তার কতকগুলি উপাদান আছে। সংস্থার রোজগার এবং লাভের হিসাব তো আছেই, সঙ্গে আছে একগুচ্ছ বড়-মাপের শর্ত। সহায়ক সরকারি নীতি অথবা পুঁজি-কাঠামো অদলবদল; মার্জার বা বাইআউটের মতো কোনও কর্পোরেট ঘটনা— এই সবই শর্তের তালিকায় পড়তে পারে। কোনও বড় সংস্থা তার ছোট প্রতিদ্বন্দ্বীকে কিনে নিচ্ছে; কোনও নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটেছে বা কোনও আইন পরিবর্তিত হয়েছে— সম্ভাবনার তালিকা লম্বা হতে পারে। শেয়ারের দামে জোয়ার আসতে বেশি সময় লাগে না। এই শ্রেণির বিশেষ পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিকল্প বিনিয়োগের সন্ধান দিয়েছে। আজ একাধিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা এমন ফান্ড পরিচালনা করে। বাজারে নতুন টাকার জোগান যথেষ্ট পোক্ত, তাই নতুনত্ব থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগের পরিমাণ নজর কাড়ে। একই ভাবে চোখে পড়ে সরাসরি স্টকে লগ্নির প্রবণতা। নানা প্রকারের অ্যাপ ব্যবহার করে এই বিষয়ে সড়গড় হয়ে গেছেন বাজারের এক বড় অংশ। ভবিষ্যতে তাঁদের কার্যকলাপ আরও বাড়বে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।

এই মুহূর্তে স্টক এক্সচেঞ্জের জন্য আমরা এক বিরাট আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাক্ষী। ছোট লগ্নিকারীর সংখ্যা এবং তাঁদের বিনিয়োগের ধরন, দুই-ই এই পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। সামান্য কয়েকটি পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে। ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ক্যাশ মার্কেটে লেনদেনের গড় পরিমাণ ছিল এক লক্ষ টাকারও কম। ক্যাশ টার্নওভার তার আগের মাসের তুলনায় ১৬% বেশি হয়ে ২৪.৭ লক্ষ কোটি টাকায় এসেছিল (২১.২ লক্ষ কোটি টাকা ছিল তার আগের মাসে)। শুধু সে মাসেই শেয়ার ট্রেডারদের সংখ্যা ৮% বেড়েছে, জানিয়েছে এনএসই। শেয়ার বাজারে লগ্নির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অগ্রণী রাজ্য মহারাষ্ট্রের চেয়ে খুব পিছিয়ে নেই। গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লির পরই এই রাজ্যের স্থান।

এখন নির্বাচন-পরবর্তী অধ্যায়ে পরের ‘ইভেন্ট’ আসন্ন বাজেট। বিভিন্ন শেয়ার (বা ফান্ড) আরও নজর কাড়বে, অনেক নতুন লগ্নিকারী সম্পদ-গঠনের চেষ্টায় বাজারে আসবেন। ফিক্সড ডিপোজ়িটের ‘নিরাপদ’ বিকল্প ছেড়ে বাজার-মুখী হয়েছে নতুন প্রজন্ম। আগামী দিনে সঞ্চয়ের ধরন সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে, তা বলছি না— কিন্তু সনাতন পরিকাঠামোয় ভাঙন ধরা শুরু তো হয়েছেই, তার ধারা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

তবে, বাজারের এই ঊর্ধ্বগতি ধরে রাখতে হলে আরও বহু দূর যেতে হবে ভারতীয় অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে। রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ, রফতানি বাড়িয়ে আমদানি কমানো, দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতির হার নামিয়ে আনা— সবই সাধ্যমতো করার চেষ্টা জারি রাখতে হবে। আসন্ন বাজেটে অর্থমন্ত্রী কী করেন, তা দেখার অপেক্ষায় থাকবে বাজার। শেষ অবধি অর্থব্যবস্থার ভিত্তিটি পোক্ত না হলে যে কোনও ভরবেগই স্থায়ী হবে না, সে কথা মনে রাখা ভাল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Share Market BSE SENSEX Stock Market Indian Economy Economic Growth

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy