গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
১৯৯৭ সালে শম্ভু মিত্রের জীবনাবসান ঘটে। আজ, ২২ অগস্ট তাঁর জন্মদিন। এখনকার দর্শক বা পাঠক হয়তো জানেন না, জীবনের শেষ ১৪ বছর তিনিও তাঁর আদর্শস্থানীয় নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর মতো মঞ্চ থেকে দূরেই ছিলেন। দু’একটি বক্তৃতা, যেমন জলসাঘর আয়োজিত ‘কাকে বলে নাট্যকলা’ অথবা সাহিত্য আকাদেমির ‘মিট দ্য অথর’ এবং দু’একটি গ্রন্থপ্রকাশ, যেমন ‘পাঁচ দুই’ (পাঁচটি গল্প, দু’টি নাটিকা) ‘নাটক রক্তকরবী’ (সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত। পরে গ্রন্থসংকলিত) ইত্যাদি ব্যতিরেকে প্রায় তাঁর এককযাপনে অতিবাহিত হয়েছে শেষ বছরগুলি। যেন বুঝেছিলেন সময় বদলাবে, এমন সময় আসবে যে অনুভব বদলে যাবে অবুঝ আদিখ্যেতায়, উপলব্ধি হয়ে উঠবে ক্রমাগত প্রচার, শিল্পের ক্ষমতা চাপা পড়বে রাষ্ট্রীক যন্ত্রের বিচারসভায়।
আর কী আশ্চর্য, তাঁর মৃত্যুর পরে পরেই জাঁকিয়ে বসল বাজার অর্থনীতির তত্ত্ব। মজবুত হল বিশ্বায়নের নীতি। রাতারাতি ‘থিয়েটার’-ও হয়ে উঠল একটি ‘ইভেন্ট’। অবশ্য থিয়েটারকে ‘ইভেন্ট’ করে তোলায় তাঁর বোধহয় খুব আপত্তি ছিল না। ১৬ বছর আগে তাঁর এবং অনেক মানুষের স্বপ্নের ‘নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতি’র প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরেও অনুজ নাট্যবান্ধবদের তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার তো এখন খুব নাম! আমাকে নিয়ে তোমরা একটা কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারো।’’ হয়েছিল সে চেষ্টা। ‘কলকাতা নাট্যকেন্দ্র’ নামে। দর্শক পাঁচদিন আগে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে এক অবিস্মরণীয় ইভেন্টেই পরিণত করেছিলেন ১৯৮০ সালের ‘গালিলেওর জীবন’ নাট্য প্রযোজনাকে। তাঁর কোনও দল ছিল না, বাকিদের দল ছিল, আপনাপন বিকাশের স্বপ্ন ছিল, ক্ষেত্র ছিল। ফলে বাঙালির সব উদ্যোগ একবারের বেশি আর এগোয় না যেমন, তেমনি সে-ও ওই একবারের বেশি আর এগোয়নি।
শম্ভু মিত্রের প্রয়াণের তিন বছর আগে প্রয়াত হন উৎপল দত্ত। সেদিন ছিল ১৯৯৪-এর ১৯ অগষ্ট। শেষ দিকে অসুস্থ তিনি, ক্রমাগত ডায়ালিসিস নিয়েছেন। মঞ্চে ও ছবিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। আমাদের সেই বয়সে মনে হত, কে সঠিক? দত্ত না মিত্র? এখন মনে হয়,শম্ভু মিত্রই সঠিক ছিলেন। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়— আমাদের ছাত্রবয়সে দেখা এই তিন মহারথীই নানা পর্বে নানা অভিজ্ঞতায় পেশাদার / সাধারণ রঙ্গালয়, গণনাট্য, গ্রুপ থিয়েটার— তিন ধারাই দেখেছেন এবং প্রত্যেকটির সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। অজিতেশ থিয়েটারে পেশাদারিত্বের জন্য হাহাকার করেছেন, উৎপল দত্ত শেষকালে নিজেকে ক্ষয় করে দিয়েছেন ব্যক্তিগত ‘পেশাদারি সং’ সাজায়। শম্ভু মিত্র বুঝেছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন বলা যায়, সঠিক শিল্পমানসম্পন্ন নাট্যকেন্দ্র ছাড়া থিয়েটার পেশাদার হবে না, হতে পারে না। তাঁর চলে যাওয়ার পরে যে হইচই, সেখানেও এখন ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ পেশাদারিত্বের বাড়বাড়ন্ত। সেও খুব স্থায়ী হল কি? বিশেষত কোভিডকালে নাট্যকর্মীদের রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য, প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ থাকার জন্য ফেসবুকে যে হাহাকার— দু’য়ের চরিত্র কি এক? হল খুলে দিলেই কি সমস্যার সমাধান? নাকি উৎপল দত্তের অননুকরণীয় ভাষায় বলব— ‘পিলপিল করে চারটে লোক’ ঢুকবে?
সেই ‘ছেঁড়া তার’ নাট্যের বিন্যাসেই শম্ভু মিত্র ভারতীয় থিয়েটারের এক নাট্যভাষ খুঁজতে চেয়েছিলেন। যে উৎপল দত্ত সামগ্রিকভাবে ভারতীয় থিয়েটার প্রকল্পে অনাস্থা পোষণ করতেন, তিনিও ‘ছেঁড়া তার’-এর বিন্যাসের প্রশংসা করেছিলেন। সে প্রকল্পও বাঙালির মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। আর তাই এত হাহাকারের, এত গর্বের বাংলা থিয়েটারের কলকাতায় কোনও ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নেই। এখনও পর্যন্ত নেই। তেমন কোনও কেন্দ্র নেই, যেখানে নাট্যোৎকর্ষের চর্চা হবে। সবই আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন হয়ে থেকেই গেল। আসলে আমাদের তো আর কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যবহির্ভূত যৌথতাই নেই! ফলে এখন আমাদের ছোট ছোট অনেক কেন্দ্র। কিন্তু নেই কোনও ‘ছেঁড়া তার’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রক্তকরবী’। থেমে যাওয়া ওই দিনগুলোয় নীরবতা দিয়ে কি এইসব কথাই বলে গিয়েছিলেন আধুনিক নাট্যের এই যুগপুরুষ?
(লেখক নাটককার, পরিচালক ও অধ্যাপক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy