E-Paper

শরীর যখন যুদ্ধক্ষেত্র

গত দু’বছরে আমরা কী দেখলাম? রাজপথে মহিলাদের লাশ পড়ে রয়েছে, কখনও নদীতে ভেসে উঠছে। মহিলা, শিশুদের ত্রাণ শিবির থেকে অপহরণ করা হচ্ছে।

সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ০৫:২৯

আন্তর্জাতিক নারী-দিবস প্রান্তিক মেয়েদের শক্তি ও সংহতির উদ্‌যাপনের দিন। তাঁদের শ্রমের মূল্য সম্পর্কে পর্যালোচনার দিন। সম অধিকার যে কোনও মানুষের বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত। এ বছরের ‘থিম’ হল ‘কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দাও’ (অ্যাকসিলারেট অ্যাকশন)। কী এই কাজ? রাষ্ট্রপুঞ্জ তথা আন্তর্জাতিক নীতি প্রণয়নের বিভিন্ন সংস্থা নারীর ক্ষমতায়নকে উন্নয়নের কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করেছে কয়েক দশক আগে। ‘সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য’ (মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোলস) বিশ্বের উন্নয়নমূলক কার্যসূচির অন্যতম নির্ণায়ক। যার অন্যতম লক্ষ্য হল নারী উন্নয়ন। বিশ্বায়ন-পরবর্তী দুনিয়ায় বাজার অর্থনীতি এক দিকে যেমন নগরায়ণের প্রক্রিয়াকে দ্রুত করছে, তেমনই জমি-হারানো প্রান্তিক মানুষের মধ্যে সংঘাত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তাঁদের প্রায় গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই হিংসার অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠছেন নারী, বিশেষত প্রান্তিক মেয়েরা। তা বোঝা যায় মণিপুরের দিকে তাকালে।

দু’বছর হতে চলল মণিপুর অগ্নিতপ্ত হয়ে রয়েছে। সংবাদ প্রতিবেদনগুলো দেখাচ্ছে যে, মণিপুরের মেয়েরা গত দু’বছর ধরে দু’ভাবে উৎপীড়িত হয়ে চলেছেন। প্রথমত তাঁদের জাতি পরিচয়ের জন্য, দ্বিতীয়ত তাঁদের লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য। উত্তপ্ত মণিপুরে শুধু যে কয়েকটি জনজাতি গোষ্ঠীর মহিলারাই হিংসার শিকার হয়ে চলেছেল তা কিন্তু নয়, বরং মেইতেই-কুকি সংঘাতে দুই কৌমের মেয়েরাই আক্রান্ত হয়ে চলেছেন। তাঁদের শরীর, মন ক্রমান্বয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যাচ্ছে। অথচ মণিপুরি মেয়েরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়, স্বাধীনচেতা, পরিশ্রমী বলে পরিচিত। নিজের সন্তান, নিজেদের কৌম জীবনের প্রতি তাঁরা দায়বদ্ধ।

গত দু’বছরে আমরা কী দেখলাম? রাজপথে মহিলাদের লাশ পড়ে রয়েছে, কখনও নদীতে ভেসে উঠছে। মহিলা, শিশুদের ত্রাণ শিবির থেকে অপহরণ করা হচ্ছে। গণধর্ষণ, হত্যা, যৌন নির্যাতন, অহেতুক প্রহার, ভয় দেখানো, সবই চলেছে ধারাবাহিক ভাবে। এ যেন সংঘাতের অনিবার্য প্রক্রিয়া!

১৯৭০-পরবর্তী সময়টাতে মণিপুরি মহিলারা সামরিক বাহিনী, এবং অর্ধ সামরিক বাহিনী ‘আস্যাম রাইফেলস’-এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম করেছেন। সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতার হাত থেকে নিজেদের সন্তানদের বাঁচাতে মেয়েরা গড়ে তুলেছিলেন ‘মেইরা পাইবি’ নামের একটি সংগঠন। যার অর্থ হল আলোক বাহিকা। ‘মেইরা’ অর্থাৎ মশাল এবং ‘পাইবি’ হলেন সেই মহিলা, যিনি মশালটি বয়ে নিয়ে চলেছেন। ২০০৪ সালে থাংজাম মনোরমাকে যখন সামরিক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করল তখন বিভিন্ন বিরোধ কর্মসূচির মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর কর্মসূচি স্থান পেয়েছিল। এগারো জন মহিলা স্বেচ্ছায় নিজেদের পোশাক খুলে পুরুষতান্ত্রিক হিংস্রতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ হতবাক হয়ে গিয়েছিল, টিভির পর্দায় সেই দৃশ্য দেখে। রাষ্ট্রসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেদের শরীরকে ব্যবহার করার সেই নিদর্শন ছিল অনন্য।

সে সময়ে মণিপুরি মহিলারা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী এসো আমাদের ধর্ষণ করো, আমাদের মাংস খাও’, কাংলা দুর্গের বিশাল সেই লোহার তোরণ নাড়িয়ে মহিলারা গর্জন করেছিলেন, “আমরা সকলেই মনোরমার মা।” সেই প্রতিরোধের উদাহরণ অন্য এক সাহসের গল্প। আজ যেন মণিপুরে সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি। আজকের মণিপুরে ‘মণিপুরি ইমা’ শব্দটাই মুছে যাচ্ছে। ‘কুকি ইমা’, ‘মেইতেই ইমা’ পরিচয় বহন করতে গিয়ে দুই পক্ষের মহিলারাই গোষ্ঠী সংঘাতের সহজ লক্ষ্য হয়ে পড়েছেন। সেখানে মহিলাদের বয়স তেইশ বছর হোক কিংবা তেষট্টি বছর, একই শাস্তি পেতে হয়— শারীরিক অত্যাচার। কাদের হাতে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে? গত কাল পর্যন্ত যারা নিকট প্রতিবেশী ছিল। নিজের পুত্রসন্তানের বন্ধু, কিংবা বান্ধবীর দাদাই আজ ধর্ষক। তলে তলে ঘৃণার আগুন এমন ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এক গোষ্ঠীর কয়েক জন দুর্বত্ত অপর গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা উগরে দিচ্ছে, কোনও মহিলাকে হাতের কাছে পেয়ে। এক বিকৃত মানসিকতার শিকার দু’পক্ষই। সন্দেহের আগুন পরিবারকেও স্পর্শ করেছে, বলছেন মহিলারা।

মণিপুর রাজ্য মহিলা কমিশনের হাতে প্রায় ষাটটি ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। মণিপুরি মহিলাদের প্রতি এই হিংসার ঘটনা দেখলে মনে হয়, আমরা কোথায় আছি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি বাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে কি? না কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ? লাইবেরিয়া, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, রাশিয়া, ইউক্রেন নয়, এ তো ‘বিকশিত ভারত’-এর এক প্রান্ত! ইরম শর্মিলা চোদ্দো বছর ধরে প্রতিবাদ করে গেলেন একটাই কারণে— মণিপুর থেকে সামরিক শক্তি তুলে নেওয়া হোক, সন্ত্রাস বন্ধ হোক। আজকের সন্ত্রাসকে বন্ধ করার ক্ষমতা কাদের হাতে?

হিংসার প্রতিবাদে হাজার হাজার মহিলা রাস্তায় নেমেছেন। জাতি বিদ্বেষের ফলে যে মণিপুরি সমাজকে টুকরো টুকরো করার চক্রান্ত হয়েছে, মশাল জ্বালিয়ে তার বিরোধিতা করছে। কিন্তু শেষ কোথায়? ভার্জিনিয়া উল্ফ বলেছিলেন যে নারীরা এক অন্য সমাজ গড়ে তুলুক যা শান্তির। তিনি মহিলাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আমার বিশ্বাস নারীরা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি একান্তভাবে যুদ্ধকে ঘৃণা করে এবং এটা এ জন্যে নয় যে তারা পুরুষের চেয়ে উন্নত বা বেশি বুদ্ধি রাখে। কারণ এই যে যুদ্ধ মেয়েদের অনেক বেশি কঠোর ভাবে আঘাত করে এবং বিনিময়ে কিছুই দেয় না।” এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি শাসন আরোপ করা হয়েছে মণিপুরে। দেশের রাষ্ট্রপতি এক মহিলা। মণিপুরি মেয়েরা কি আশা করতে পারেন, রাজ্যে আর এক জন মেয়েকেও হিংসার বলি হতে হবে না?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Womens day special Manipur Violence

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy