E-Paper

রাষ্ট্রহীন শ্রমজীবী তৈরির ছক

২০২২-এর এপ্রিলে দিল্লির জহাঙ্গিরপুরীর বাঙালিপাড়ায় হনুমান জয়ন্তীর দিনে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধল। বজরং দলের স্থানীয় নেতা দাবি করলেন যে, তাঁরাই আগে আক্রান্ত হয়েছেন।

স্বাতী মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২৫ ০৮:১০

দেশ জুড়ে ‘বাংলাদেশি সন্দেহ’-এ ধরপাকড় আবহে কিছু পুরনো কথা মনে করিয়ে দেওয়া যাক। উদাহরণগুলো সবই দিল্লি-সহ জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নয়ডায় এক বহুতল আবাসনে জোহরা বিবি নামক এক গৃহকর্মীকে চুরির অপবাদ দিয়ে মারধর করে আটকে রাখা হয়েছিল। তাঁর স্বামী আবদুল সাত্তার ও তাঁদের প্রতিবেশীরা হানা দেন সেই কমপ্লেক্সে, রক্ষিবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়। ‘বাংলাদেশি’-দ্বারা আক্রান্ত অভিজাত মানুষজন— এই মর্মে ওয়টস্যাপ ফরওয়ার্ড আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক হয়, ‘বাংলাদেশি’দের আর কাজে নেওয়া হবে না। তাঁরা অবশ্য বাংলাদেশি নন, ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার পরিযায়ী শ্রমিক। নয়ডা-গ্রেটার নয়ডার মাঝামাঝি ঝুপড়িতে প্রায় ৬০০ জনের বাস, সেখানে নাগরিক পরিষেবা বলতে একটাই হ্যান্ডপাম্প। ঘরভাড়া ও বিদ্যুতের বিল মিলিয়ে এঁদের মাসে ৭০০ টাকা দিতে হত ঠিকাদারকে। ক্রমবর্ধমান নয়ডায় এঁদের শ্রমের চাহিদা নেহাত কম ছিল না।

২০২২-এর এপ্রিলে দিল্লির জহাঙ্গিরপুরীর বাঙালিপাড়ায় হনুমান জয়ন্তীর দিনে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধল। বজরং দলের স্থানীয় নেতা দাবি করলেন যে, তাঁরাই আগে আক্রান্ত হয়েছেন। পাল্টা দাবি উঠল যে, মসজিদ আগে আক্রান্ত হয়েছিল। এরই মধ্যে গৈরিক রাজনীতির কারবারিরা বললেন, ‘অবৈধ বাংলাদেশি’-রা দাঙ্গার জন্য দায়ী। “বাংলা বোলনা গুনাহ হ্যায় ক্যা?”— এলাকার ক্ষুব্ধ মুসলিম বাসিন্দারা দিল্লির মিডিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন সে দিন। জহাঙ্গিরপুরীর জি ব্লক ছিল মিশ্র মহল্লা, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম মিলিয়ে বাস। ২০২২ সালের পরে ধর্মীয় লাইনে ভাগ হয়ে যায় এই বাঙালি পাড়া। বহু মুসলমান ব্যবসায়ীর দোকান ভাঙা পড়ে সরকারি বুলডোজ়ারে।

ভাগ হয়ে গিয়েছিল তুঘলকাবাদও। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে তুঘলকাবাদ ভিলেজের ‘বঙ্গালি কলোনি’র সুষমা দত্ত ডেমোলিশনের নোটিস পেয়ে বলেছিলেন, “আমরা তো রোহিঙ্গা বা বাঙালি মুসলমান নই। সরকারের তাদের নিয়ে সমস্যা আছে। কিন্তু আমাদের নির্যাতন কেন করা হচ্ছে? আমরা তো হিন্দু!”

ভারতে নগরায়ণের ইতিহাস তথা স্বাধীনতা-উত্তর রিফিউজি-নগরী দিল্লির ইতিহাস শ্রমজীবী মানুষের উৎখাত হওয়ারই ইতিহাস। নির্মাণকর্মী, কারখানার শ্রমিক, গৃহকর্মী, সাফাইকর্মীদের কখনও উৎখাত হতে হয়েছে জরুরি অবস্থার স্বেচ্ছাচারে, কখনও আদালতের নির্দেশে, পরিবেশ রক্ষার খাতিরে— ক্রমে শহরের কেন্দ্র থেকে প্রান্তে, প্রান্তরে পুনর্বাসন হয়েছে তাঁদের। সেই নতুন কলোনিতে পরিস্রুত জল অথবা শৌচাগারের মতো ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা না থাকার ফলে প্রকৃতি ও দৃশ্যদূষণের অভিযোগে আবারও উৎখাত হয়েছেন তাঁরা। নব্বইয়ের দশকে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘অনুপ্রবেশ’-এর জুজু। ১৯৯২ সালের ‘অপারেশন পুশব্যাক’ ও তার পরবর্তী জামিয়া নগর এলাকায় ডেমোলিশন, ১৯৯৬-৯৯ সালে ভোটার তালিকা থেকে তথাকথিত ‘বাংলাদেশি’দের নাম বাদ দেওয়া— এ সবই আজকের ঘটনাবলির পূর্বসূরি। লক্ষণীয়, ১৯৯২ সালে যেমন অ-নথিভুক্ত কিছু অভিবাসী সীমাপুরীর মতো কলোনি থেকে বিতাড়িত হন, অন্য দিকে সরকারি অত্যুৎসাহের জালে জড়িয়ে পড়েন বেশ কিছু ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশে তৎকালীন খালেদা জ়িয়া সরকারের তীব্র প্রতিক্রিয়ার ফলে অ-নথিভুক্ত অভিবাসীদের বিষয়ে কোনও সম্মানজনক নীতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার পরবর্তী পর্যায়েও এই প্রসঙ্গে কোনও গঠনমূলক পদক্ষেপ হয়নি। ভারতের শ্রম বাজারে অ-নথিভুক্ত অভিবাসীদের স্থান, তাঁদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংগঠিত পাচার ও ঠিকাদার চক্র, অর্থনীতিতে তাঁদের অবস্থান— কোনও বিষয়েই ইতিবাচক কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। অতএব, ২০২৫-এও দিল্লি পুলিশের ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠাঁই হয়েছে মহম্মদ আলমগিরের মতো পাথর ভাঙার কাজে নিযুক্ত অ-নথিভুক্ত অভিবাসী শ্রমিকের; সেই একই জালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নাথুরাম বিশ্বাস অথবা হামিদুল রহমানের মতো ভারতীয় নাগরিককে।

একবিংশ শতকে শ্রমজীবী উৎখাত-রাজনীতির নবতম সংযোজন ‘রোহিঙ্গা’। ২০২৪-এর ডিসেম্বরে তৎকালীন আপ সরকার ইউএনএইচসিআর-স্বীকৃত শরণার্থী রোহিঙ্গা শিশুদের সরকারি স্কুলে ভর্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ‘বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত’ হওয়ার অভিযোগে খিয়ালা ভিলেজের ক্রমবর্ধমান উত্তর ভারতীয় মুসলমান-প্রধান বস্ত্রশিল্পের হাব আজ মৃতপ্রায়। অতঃপর জুলাই ২০২৫, গুরুগ্রাম। বাঙালি সাফাইকর্মী ও ঠিকাদারদের পলায়নের ফলে সাফাই শিকেয়। মাসের শুরুতেই এক প্রবাসী ফরাসিনি শহরের জঞ্জাল ও দুর্গন্ধের বিষয়ে লিখে সমাজমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিলেন। প্রবাসীর অবশ্য সামাজিক-অর্থনৈতিক পুঁজি আছে— ইংরেজি বা প্রমিত বাংলার আড়ালে না লুকোতে পারা পরিযায়ী শ্রমিকের সেই পেশির জোর নেই।

সংবিধান নাগরিককে দেশের অভ্যন্তরে অবাধ যাতায়াতের অধিকার দিলেও রাষ্ট্রের দৃশ্যত পরিষেবা অথবা সুরক্ষা দেওয়ার কোনও দায় নেই। অ-নথিভুক্ত অভিবাসীর সস্তা শ্রমের বাজার জিইয়ে রাখা হয় যে উদ্দেশ্যে, সেই একই উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশকারী খোঁজার ছলে শিকার করা হয় বাঙালি শ্রমিককে। বিভাজন ও নাগরিকত্ব জটের আড়াল থেকে উঁকি মারে রাষ্ট্রহীন শ্রমজীবী শ্রেণি তৈরির অলিখিত আকাঙ্ক্ষা। মানবাধিকার জাতীয় বিশ শতকীয় রূপকথাকে বুলডোজ়ারে গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি হয় পৃথিবীর ক্রমশ ফুরিয়ে আসা ভূ-সম্পদের উপর নতুন দখলদারির নীতি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Labour Migrant Workers Bengali

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy