Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
WTO

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে ভারত চিনের মতো সুবিধা করতে পারে না কেন?

কোনও ক্ষেত্রে ভারত চিনের মতো ধূর্ততা দেখাতে পারেনি, কোনও ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ হয়েছে।

মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে, এর কোনও বিকল্প নেই।

মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে, এর কোনও বিকল্প নেই।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২২ ১০:২৩
Share: Save:

আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে চিনাদের একটি সুপরিচিত কৌশল রয়েছে। নীতিগত ভাবে তারা কিছু বিষয়কে গ্রহণ করে। কিন্তু বাস্তবে কোনওটিই করে ওঠে না। অথবা তারা কোনও বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দান করে। কিন্তু তাকে মান্যতা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের তরফে কোনও উদ্যোগ দেখা যায় না।

পরে তারা প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোনও সঙ্ঘাতের পথ প্রশস্ত করে। অথবা নতুন কিছু ওজর তুলে বসে। যার সূত্র ধরে তারা তাদের দাবি বদলায় এবং সেই নতুন দাবি অনুযায়ী তারা আরও বেশি সুবিধা আদায়ের জন্য দর কষাকষি করে। সুতরাং তাদের দিক থেকে দেখলে আলাপ-আলোচনা কোনও অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া নয়। এর কোনও অন্তবিন্দু নেই।

যাঁরা বেজিংয়ের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত, তাঁরা জানেন আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে এই প্রকার আচরণ চিনারা ক্রমাগত করে এসেছে। এই কৌশল ভারতের ক্ষেত্রে সফল হলেও দক্ষিণ চিন সাগরীয় অঞ্চলের ক্ষেত্রে ফলদায়ী না-ও হতে পারে। তা সত্ত্বেও বেজিং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র দ্বারা নির্ধারিত নিয়মগুলি নিয়ে খেলতে সমর্থ হয়েছে এবং বাজারের নিয়ন্ত্রণকে আয়ুধ হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বের অগ্রণী বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকে জোর করে তাদের শর্ত মানতে বাধ্য করেছে।

দেশের বাণিজ্য তথা আইনি তথা রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় কি তা হলে কোনও বড়সড় ফাঁক থেকে গিয়েছে, যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে?

দেশের বাণিজ্য তথা আইনি তথা রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় কি তা হলে কোনও বড়সড় ফাঁক থেকে গিয়েছে, যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে?

ভারতও একই কৌশল অবলম্বনে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তাতে খুব বেশি সফল হয়নি। কোনও ক্ষেত্রে ভারত চিনের মতো ধূর্ততা দেখাতে পারেনি, কোনও ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী মঞ্চে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভারতকে পিছু হঠতে হয়েছে, আবার কোনও ক্ষেত্রে (ভোডাফোন, কেইর্ন, ডেভাস, অ্যামাজন ইত্যাদি) তা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ডব্লিউটিও এই সব বাণিজ্য-বিতণ্ডায় বারবার ভারতের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছে। যার ফলে বিদেশে ভারতীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এই ধরনের বাজেয়াপ্তকরণের অস্বস্তিকর সংবাদ যখনই শিরোনামে এসেছে, সরকার তার উত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেয়েছে। সরকার ভারতীয় আদালতকে ব্যবহার করে ‘ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এগ্রিমেন্ট’ (আইজিএ)-গুলিকে বাতিল করেছে, আবার পাশাপাশি বিবাদ মেটাতে আপস রফাতেও এসেছে।

কয়েক বছর আগে ভারত সরকার নীরবেই ৫৮টি আইজিএ বাতিল করে, যেগুলি এদেশে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে ১৯৯০-এর দশকে স্বাক্ষরিত হয়েছিল (ভোডাফোন হল্যান্ডের সঙ্গে করসংক্রান্ত মামলা লড়েছিল আইজিএ-র বিষয়ে)। সেই সঙ্গে আবার জবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও করা হয়েছিল।

এ থেকে একটি অনিবার্য প্রশ্ন উঠে আসে— দেশের বাণিজ্য তথা আইনি তথা রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় কি তা হলে কোনও বড়সড় ফাঁক থেকে গিয়েছে, যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে? যদি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিটি চুক্তিতেই পরিশোধ নিয়ে বিতণ্ডা দেখা দেয়, যা থেকে শেষ পর্যন্ত জোগান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, তা হলে সমস্যা অনিবার্য হয়ে পড়বে। এবং অস্ত্র সরবরাহের বেশ কিছু ক্ষেত্রে তেমনটা সত্যিই ঘটেছে। যদি প্রতিরক্ষা বিষয়ক টেন্ডারের প্রতিযোগিতায় এমন অসম্ভব কাণ্ড ঘটতে থাকে, তবে যে পথটি উন্মুক্ত থাকে, সেটি হল আগে থেকে বাছাই করে রাখা। বলাই বাহুল্য, সেটি কখনও কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। যদিও ডেভাস-এর ক্ষেত্রে একটি অভিযোগ ছিল এই যে, সেখানে কোনও প্রতিযোগীকে দরপত্র দিতে আহ্বান জানানোই হয়নি।

কোনও ক্ষেত্রে ভারত চিনের মতো ধূর্ততা দেখাতে পারেনি, কোনও ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ হয়েছে।

কোনও ক্ষেত্রে ভারত চিনের মতো ধূর্ততা দেখাতে পারেনি, কোনও ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ হয়েছে।

কোনও সরকার বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছামতো শর্ত বদলানোর ব্যাপারে অভ্যস্ত হলে তার নিজের নাগরিকরাই নিরন্তর ভাবে ধরে নিতে পারে যে, কোনও লিখিত চুক্তিই চূড়ান্ত নয়। তা হেলাফেলায় লিখিত বা অন্যমনস্কতা থেকেও উদ্গত হতে পারে। এর ফলে যা ঘটে, তা হল ক্রমাগত ব্যয়বৃদ্ধি। ডেভাস চুক্তি থেকে ১০০০ কোটি টাকা রাজস্ব প্রাপ্তির কথা ছিল। কিন্তু এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় মোট ১৫,০০০ কোটি টাকা (এর পরেও কেউ জাতীয় ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলতে পারে কি?)।

এনরনের ক্ষেত্রেও ভিন্নথা হয়নি। যাঁরা এই শক্তি-উৎপাদন প্রকল্পের বিষয়ে সংস্থার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তাঁরা এ কথা বোঝেননি যে, গ্যাসভিত্তিক শক্তিকেন্দ্রগুলি কয়লাভিত্তিক শক্তিকেন্দ্রগুলির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর হবে। সুতরাং যে চুক্তি থেকে গগনচুম্বী লাভের আশা করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায়নি। শুধু তা-ই নয় এর ফল দাঁড়ায় ভয়াবহ (মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের দেউলিয়া দশা হয়)। চুক্তি বাতিল করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর্থিক ক্ষতির কথা আর না বলাই ভাল।

প্রারম্ভিক ভ্রান্তি থেকে শেষ পর্যন্ত গন্ডগোলটি হাস্যকর কাণ্ডে পর্যবসিত হয়। ডেভাস-এর ঘটনায় সরকারের তরফে চুক্তি বাতিলকরণের কারণ (মূলত অপরিণামদর্শিতা) শীর্ষ আদালতের ঘোষণা (জালিয়াতি)-র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। ‘অ্যান্ট্রিক্স’-এর যে চেয়ারম্যান জি মাধবন নায়ারের বিরুদ্ধে যেখানে পূর্ববর্তী সরকার ডেভাস-এর প্রতি অযৌক্তিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিল, তাঁকেই বিজেপি মহিমান্বিত করে দলের সদস্যপদ দান করে। এখন যদি দেখা যায় বিষয়টি জালিয়াতি ছিল, তা হলে কি নায়ারকে তাঁর দল পরিত্যাগ করবে?

বিষয়টি এমন যে, লিখিত চুক্তির ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক এবং শক্তি-সাম্যের প্রেক্ষিত থেকেই যায়। কেউ কেউ এমন চুক্তিকে কোনও সম্পর্কের সূত্রপাত হিসেবেও দেখতে পারেন, আবার কোনও বিতণ্ডাবাজ সংস্কৃতিতে একে সমস্যার প্রারম্ভ হিসেবেও দেখা হতে পারে। অনেকে এটিকে উপযোগের অস্থায়ী সমাধান হিসেবেও ভাবতে পারেন। সুতরাং চুক্তি-আলোচনাকারী আইনজীবীদের বাহিনী এবং ডব্লিউটিও-র মঞ্চের কুশীলবরা ভারতীয় পক্ষকে অ-প্রস্তুত হিসেবেও দেখতে পারেন। ঘটনার ঘনঘটা বা অভিজ্ঞতার পরিমাণ আমাদের এই শিক্ষা দিতে পারে যে, অস্পষ্ট আবেদনে খেসারত দিতে হতেই পারে। সুতরাং মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে, এর কোনও বিকল্প নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

WTO Devas Enron Trade Treaties
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE