গত শতকের শেষ দশক থেকেই বিশ্বায়নের বিজয়যাত্রা শুরু— সে জয়যাত্রা অব্যাহত থাকল এই শতকের প্রথম দিকটিতেও, দুনিয়ার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি ইন্টারনেটের মতো দুনিয়া-কাঁপানো প্রযুক্তিতে ভর করে। তার পর পেরোলো এই শতকের এক-চতুর্থাংশ— ডোনাল্ড ট্রাম্পের একুশে আইনের ফলে ‘গেল, গেল’ রব উঠল চার ধারে। শোনা গেল, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির ফলে বিশ্বায়ন নাকি হাঁটছে উল্টো পথে। এ বছর এপ্রিলে যখন বাণিজ্য শুল্ক বাড়ানো নিয়ে হাঁকডাক শুরু করেছেন ট্রাম্প, তখনই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দফতর সরকারি ভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে, দুনিয়া বদলে গিয়েছে, বিশ্বায়ন শেষ। কিন্তু বিশ্বায়নের সমাপ্তি— যদি তা সত্যিই হয়— শুধুমাত্র ট্রাম্পের ট্যারিফ-যুদ্ধ আর তাঁর অভিবাসন নীতির ফল কি? না কি, ঐতিহাসিক ভাবেই বিশ্বায়ন ওঠা-পড়ার এক তরঙ্গায়িত রেখচিত্র মাত্র?
টমাস পিকেটি ট্রাম্পের নীতিকে বর্ণনা করেছেন তাঁর রিপাবলিকান পূর্বসূরি রোনাল্ড রেগনের নীতির ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে। পিকেটি-র মতে, রিপাবলিকানরা বুঝতে পেরেছেন যে, বিশ্বায়ন এবং উদার অর্থনীতি তেমন একটা উপকারে আসেনি আমেরিকান মধ্যবিত্তের। ট্রাম্প আর তাঁর ‘মাগা’-র অনুগামীরাও তো তুষ্ট করতে চান ভোটারদের। তাঁরা মনে করছেন, বিশ্বায়নের স্রোত রুখে দিয়েই সম্ভব তাঁদের ভোটারদের ভাল করা, খুশি করা।
তা হলে আজকের আপাত-বিশ্বায়নবিরোধী মুহূর্তটির শুরু কি ২০২৪ সালে, দ্বিতীয় বারের জন্য ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সময় থেকেই? না কি, তার অনেক আগেই অঙ্কুরিত হয়েছিল এর বীজ? ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো-র ইতিহাসের অধ্যাপক তারা জ়াহরা বলছেন, ১৯৯৯ সালে যখন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনের বিরোধিতা করে মিছিল করে সিয়াটল শহরের কেন্দ্রস্থলে, সেটা ছিল বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলির একটি। ট্রাম্প তখন কোথায়!
তার পর ২০০৮-এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটে বেরিয়ে পড়ল তাবড় সব অর্থব্যবস্থার কঙ্কাল। দ্বিতীয় মহামন্দার সূত্রপাত না হলেও এর ফলে ধ্বংস হয় বহুবিধ ব্যক্তিগত জীবিকা। বিশ্ব-পুঁজিবাদের স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচারের উপরে আস্থা কমে মানুষের। পরবর্তী বছরগুলিতে আমরা দেখব, নির্বাচনে জিতে দেশে-দেশে ক্ষমতায় আসবেন বিশ্বায়ন-বিরোধী জনপ্রিয়তাবাদীরা। ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের এক গবেষণাপত্র দেখাচ্ছে যে, ২০০৮ সালের পরের পনেরো বছরে বিশ্বায়ন স্থবির হয়ে পড়েছে।
এরই মধ্যে ২০১৫-১৬ সালে সিরিয়া-র গৃহযুদ্ধের ফলে কাতারে কাতারে শরণার্থী বদলে দিল ইউরোপের জনবিন্যাস। সেই সঙ্কটকালে কিছু ইউরোপীয় দেশে শরণার্থী-বিরোধী রাজনীতি তীব্র হয়। ২০১৬-র দু’টি দিগ্নির্দেশক ঘটনা— আমেরিকায় ট্রাম্পের নির্বাচন এবং ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোট— অভিবাসী-বিরোধী মনোভাবকে তীব্রতর করে দুনিয়া জুড়ে। তার পর এল শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম অতিমারি। সমকালীন ইতিহাসে শান্তিকালে বিশ্বায়ন এতটা ব্যাহত হয়নি আর কিছুতেই। কোভিড চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য আমদানির উপরে নির্ভরশীল অর্থব্যবস্থাগুলির দুর্বলতা। বিশ্বায়নের অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে কোভিড এবং ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের যৌথ অবদান যেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং মহামন্দার সম্মিলিত প্রভাবের মতো। তার পর ইউক্রেনের সংঘাতের ফলে ব্যাঘাত ঘটল সরবরাহ শৃঙ্খলে। প্রভাব পড়ল দুনিয়ার জ্বালানি, খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্যের বাজারে। এরই মাঝে আমেরিকা আবারও নির্বাচিত করল ট্রাম্পকে। আর আমেরিকাকে ‘পুনর্বার মহান করা’র অভিপ্রায়ে দেশটাকে বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গেলেন ট্রাম্প।
এই আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ পিছনেই ঠেলেছে বিশ্বায়নকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘বিশ্বায়ন’-এর মূল ধারণাটিও কি বিকশিত হয়নি? গ্লোবাল ট্রান্সফর্মেশনস (১৯৯৯) নামক বইয়ে ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড হেল্ড এবং তাঁর সহ-লেখকরা বিশ্বায়নকে সংজ্ঞায়িত করছেন ‘বিশ্ব সঙ্কোচনের প্রক্রিয়া, দূরত্ব কমতে থাকা, আরও কাছে আসার প্রক্রিয়া’ হিসাবে। স্বাভাবিক ভাবেই একীকরণের এই ধারণাটা বিশ্বব্যাপী বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জনের সুযোগ পায়নি উনিশ শতকের আগে। বাষ্পচালিত জাহাজ, রেলপথ, টেলিগ্রাফ এবং অন্যান্য উদ্ভাবনকে সঙ্গী করেই বিশ্বায়নের প্রথম ‘তরঙ্গ’ প্রবাহিত হল, ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। সুতরাং, ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি প্রযুক্তি, পণ্য ও পরিষেবা এবং মানুষ, মূলধন এবং তথ্যের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের ফলে বিশ্বের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জনগণের ক্রমবর্ধমান আন্তঃনির্ভরতার নির্দেশক।
ঐতিহাসিক ভাবে বিশ্বায়ন তার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে। ১৯২০-র বই দি ইকনমিক কনসিকোয়েন্সেস অব দ্য পিস-এ জন মেনার্ড কেন্স বর্ণনা করেছেন বিশ শতকের গোড়ায় বিশ্বায়িত অর্থনীতির উৎকর্ষের ছবি— “লন্ডনের বাসিন্দারা বিছানায় বসেই সকালের চা পান করতে করতে টেলিফোনে অর্ডার করতে পারতেন উপযুক্ত পরিমাণে সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন পণ্য, এবং আশা করতে পারতেন যে, দ্রুতই তা সরবরাহ হবে তাঁদের দোরগোড়ায়।” ১৯১৪-র অগস্টে সে যুগের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অসাধারণ এক অধ্যায় শেষ হয়েছে বলে মনে করেছেন কেন্স। এই আন্তর্জাতিকতাবাদে দাঁড়ি পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামায়। যুদ্ধোত্তর সুরক্ষাবাদ, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উত্থান, মহামন্দা এবং পরিশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ— বিশ্বায়নের গতি রুদ্ধ হল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার, রাষ্ট্রপুঞ্জ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ন্যাটোর মতো বহুপাক্ষিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান ছিল ট্রাম্পের পূর্বসূরি আমেরিকান নেতাদের। চিনের দরজা ধীরে ধীরে খুলতে থাকে ১৯৭৯ থেকে। ১৯৮৯-এ গুঁড়িয়ে গেল বার্লিনের প্রাচীর। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও সম্প্রসারিত হতে থাকল। সব মিলিয়ে বিশ্বায়নের দ্বিতীয় বড়সড় তরঙ্গ এল বিশ শতকের শেষের দিকে। ১৯৯১-এ সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর আবারও বৃদ্ধি পেল বিশ্বজোড়া অভিবাসন। গতি পেল বিশ্বায়নও।
আজ ট্রাম্পের নীতির প্রতিরোধে দুনিয়া জুড়ে গড়ে উঠছে নতুন-নতুন জোট। আঞ্চলিকীকরণই বিশ্বায়নকে প্রতিস্থাপিত করবে কি না, এবং আমেরিকাকে বাদ দিয়ে দুনিয়া কতটা সম্পৃক্ত হতে পারে, এ নিয়ে সন্দিগ্ধ অনেকেই। তবে এটাও ঠিক যে, আন্তর্জাল এবং যোগাযোগের এই যুগে, বিশ্বায়নের কেন্সীয় ধারণা বদলেছে অনেকটাই। কলকাতায় বসে যখন আমি কোনও ব্রিটিশ সিটকম দেখি, কিংবা অনলাইন ভিডিয়ো কনফারেন্সে মিটিং সারি শিকাগোর কারও সঙ্গে, সেগুলো কি পরিবর্তিত বিশ্বায়নের বৈপ্লবিক রূপচিত্র নয়? গ্রিক অর্থনীতিবিদ টাকিস ফোটোপোলোস ২০০১-এর এক গবেষণাপত্রে ‘সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন’কে বলছেন বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতির একীকরণ, ‘রাজনৈতিক বিশ্বায়ন’ হল এক বহুজাতিক অভিজাত শ্রেণির উত্থান এবং জাতি-রাষ্ট্রের বিলুপ্তির বর্ণনা। এ ছাড়াও রয়েছে ‘প্রযুক্তিগত বিশ্বায়ন’, ‘সামাজিক বিশ্বায়ন’ এবং ‘আদর্শগত বিশ্বায়ন’। বহু রূপে প্রতিভাত এই সর্বব্যাপী বিশ্বায়নকে চট করে ধ্বংস করা কঠিন। এমনকি ট্রাম্পের পক্ষেও।
আজ সাংস্কৃতিক ও জাতীয় বিভাজন কাটাতে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। বিশ্বময় একযোগে সৃষ্টি করেছে অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ এবং সমস্যার। আজ বিশ্বের এক প্রান্তের ব্যবসা সহজেই এবং সস্তায় তাদের কাজ আউটসোর্স করতে পারে অন্য প্রান্তে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অভিসৃতিকেও সাবলীল করে আন্তর্জাল। সোশ্যাল মিডিয়া স্থান এবং সময়ের বাধা সম্পূর্ণ রূপে মুছে ফেলেছে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সেই সঙ্গে হঠাৎই যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ও তৈরি করে এক নতুন ধরনের বৈশ্বিক সংহতি— যা কোনও চুক্তির উপরে নয়, বরং প্রযুক্তির উপরে নির্ভরশীল।
মোট কথা, বিশ্বায়ন শেষ হচ্ছে না, বরং তা ফের রূপ পাল্টাচ্ছে। শুল্ক এবং অভিবাসনে ট্রাম্পীয় বিধিনিষেধ যেমনই হোক, এক নবতর বিশ্বায়ন যে ডানা মেলে উড়তেই থাকবে, এ কথা নিশ্চিত।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)