Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Artificial Intelligence and Deep Fake

‘আবার আসি ফিরে’

প্রযুক্তি যদি সত্যিই ফিরিয়ে আনতে পারে মৃত মানুষকে— তাঁদের ছোঁয়া না যাক, অন্তত দেখার ব্যবস্থা যদি করে দিতে পারে— সেটাকে কি বিজ্ঞানের নির্বিকল্প আশীর্বাদ বলেই ধরে নেওয়া যায়?

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩৯
Share: Save:

আমেরিকান লেখক এবং সাংবাদিক মাইকেল গ্রোথাসের বাবা মারা গিয়েছেন ১৯৯৯ সালে। দু’দশকেরও বেশি সময় পরে কম্পিউটার স্ক্রিনে বাবার একটা ‘নতুন’ ভিডিয়ো দেখলেন মাইকেল। সুস্থ শরীরে একটা হলুদ টি-শার্ট পরে রৌদ্রকরোজ্জ্বল পার্কে ঘুরে ঘুরে স্মার্টফোনে ছবি তুলছিলেন তাঁর বাবা— যে স্মার্টফোন বস্তুটা আবিষ্কারই হয়েছে তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পরে। ছবি তোলা শেষ করে স্ক্রিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে, ভুরু উঁচিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে সৌম্য হাসলেন তিনি।

বছরকয়েক আগে মাইকেল তাঁর বাবাকে এ ভাবে ফিরিয়ে এনেছিলেন ‘ডিপফেক’ প্রযুক্তির সাহায্যে। খরচ পড়েছিল মাত্র শ’দুয়েক ডলার। সেই সঙ্গে তিনি শুধু জোগান দিয়েছিলেন বাবার ১৯৯০-এর দশকের ৬০ সেকেন্ডের কিছু বেশি সময়ের ভিডিয়ো। ২০২১ সালের বই ট্রাস্ট নো ওয়ান: ইনসাইড দ্য ওয়ার্ল্ড অব ডিপফেকস-এ গোটা ঘটনাটার সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

মৃতকে এ ভাবে ফিরিয়ে আনা যেন হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ়-এ বর্ণিত ‘রেজ়ারেকশন স্টোন’-এর গল্প। জে কে রোলিং এই রূপায়ণকে বর্ণনা করেছেন রক্তমাংসের শরীর হিসাবে নয়, আবার একেবারে কায়াহীন আত্মাও নয়, যেন মাঝামাঝি কিছু একটা। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক ঘুচিয়ে আজ ‘ডিপফেক’-এর সাহায্যে যে শুধু নেতা-অভিনেতা-সেলেব্রিটিদের আপত্তিকর ছবি, অডিয়ো-ভিডিয়ো তৈরি সম্ভব, তা-ই নয়— একই ভাবে মৃতদেরও ‘ফিরিয়ে’ আনা যায়।

প্রযুক্তি যদি সত্যিই ফিরিয়ে আনতে পারে মৃত মানুষকে— তাঁদের ছোঁয়া না যাক, অন্তত দেখার ব্যবস্থা যদি করে দিতে পারে— সেটাকে কি বিজ্ঞানের নির্বিকল্প আশীর্বাদ বলেই ধরে নেওয়া যায়? না কি, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে বিপদের সঙ্কেত?

লোকসভা ভোটের প্রচারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সোশ্যাল মিডিয়ার যৌথ দাপটে সত্য-মিথ্যা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধূসর সীমানা যখন প্রত্যাশিত ভাবেই মিলেমিশে একাকার, জনপ্রিয় মৃত নেতাদেরও দেখা যাচ্ছে ভোটের ময়দানে। বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে। করুণানিধি আর জয়ললিতা, দুই নেতারই ম্যাজিক যে এখনও অটুট বলে মনে করেন বর্তমান রাজনীতিকরা, সেটা স্পষ্ট বোঝা যায় ‘ডিপফেক’ প্রযুক্তিতে নির্মিত এঁদের অডিয়ো কিংবা ভিডিয়ো ক্লিপের সাহায্যে ভোটের প্রচার দেখে। আপাত ভাবে বিষয়টা চিত্তাকর্ষক হলেও এ সবের ভিতরে কিন্তু লুকিয়ে থাকতে পারে অনেক আইনি জটিলতা, এবং অনেক নৈতিক প্রশ্নও।

বিনোদনের জগতে অবশ্য বাজার-সফল ব্যক্তিদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে কিছু দিন ধরেই। সেটা সম্ভব নানা কারণে— প্রিয় তারকাকে সম্মান জানাতে, কোনও অসমাপ্ত প্রোজেক্ট শেষ করতে, কিংবা তারকার জনপ্রিয়তার সোনার তরীতে ভেসে বাণিজ্য সারতে। সাম্প্রতিক ছবি অতি উত্তম-এ উত্তমকুমারের পুরনো ছবির ক্লিপ ব্যবহারের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তাঁর মুখে জোগানো হয়েছে নতুন কথা। হলিউডে মৃত অভিনেতাদের ফিরিয়ে আনার ঘটনাও ক্রমেই বাড়ছে। অভিনেতা পিটার কুশিং মারা যান ১৯৯৪-তে। ২০১৬-র ছবি রোগ ওয়ান-এ দেখা গেল তাঁর ডিজিটাল পুনরুত্থান— কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি (সিজিআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেরানো হল স্টার ওয়র্স-এর খলনায়ককে। লরেন্স অলিভিয়ের থেকে কেরি ফিশার, পুনরুত্থিত হয়ে চলেছেন অনেকেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে আসছে বিটলস-এর নতুন অ্যালবাম। সেখানে পল ম্যাকার্টনি জুড়ি বাঁধছেন সাড়ে চার দশক আগে নিহত জন লেননের সঙ্গে। সম্ভাবনার দুয়ার ভেঙেছে, তার বিস্তৃতি এখন আকাশ-ছোঁয়া।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্মের ঢের আগে থেকেই অবশ্য এ রকম ঘটনা ঘটছে। প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে, ১৯৯১-এর এক বহুচর্চিত ডায়েট কোকের বিজ্ঞাপনে পুনরুত্থিত করা হয়েছিল ১৯৫৭ সালে প্রয়াত অভিনেতা হামফ্রে বোগার্ট, ১৯৭১ সালে প্রয়াত ট্রাম্পেটবাদক লুই আর্মস্ট্রং, আর ১৯৮৬-তে প্রয়াত অভিনেতা জেমস ক্যাগনি-কে, জীবিত গায়ক স্যর এলটন জনকে সাহায্য করার জন্য। সেই বিজ্ঞাপন দেখে আঁতকে ওঠেন আমেরিকার আর্টিস্টস রাইটস ফাউন্ডেশনের তৎকালীন কার্যনির্বাহী অধিকর্তা কিথ লাকুয়া। বিজ্ঞাপনটিকে তিনি বলেন সে সময়ের প্রেক্ষিতে সম্ভবপরের অরওয়েলীয় চিত্ররূপ। হায়! কী অপেক্ষা করছে মাত্র কয়েক দশকের দূরত্বে, লাকুয়া যদি জানতেন!

মৃত শিল্পীদের দিয়ে আইনানুগই কত কী করানো হয়েছে ইতিমধ্যে! যেমন, মৃত্যুর এক দশক পরে, ১৯৯৭-এ, এক ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের বিজ্ঞাপনে পুনরুত্থিত করা হল সর্বকালের অন্যতম সেরা নৃত্যশিল্পী ফ্রেড অ্যাস্টেয়ার-কে। শিল্পীকে দেখা গেল কর্ডলেস ক্লিনারের তালে তালে নাচতে। অড্রে হেপবার্নের মতো সাবলীল অভিনেত্রীকে মৃত্যুর দু’দশক পরে ২০১৪-য় দেখা গেল চকলেটের বিজ্ঞাপনে। মৃত্যুর চার দশক পরে ব্রুস লি ফিরে এলেন ২০১৩-য়, হুইস্কির বিজ্ঞাপনে। ভক্তরা মনে করালেন, ব্যক্তিজীবনে মদ্যপান করতেন না ব্রুস লি।

তাই তৈরি হয় বিতর্ক। আইন এবং নৈতিকতা দুটো বিষয় জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। হয়তো এ সব কারণেই কমেডিয়ান রবিন উইলিয়ামসের মতো কেউ কেউ রীতিমতো উইল করে তাঁর কোনও প্রতিরূপেরই ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু সে নিষেধাজ্ঞাও তো কার্যকর থাকবে মৃত্যুর পর ২৫ বছর মাত্র। হয়তো ভবিষ্যতে আরও অনেক শিল্পী, রাজনীতিক, এমনকি সাধারণ মানুষও এমনই উইল করে যাবেন। আবার অনেকেই হয়তো বিষয়টা ছেড়ে রাখবেন ভবিতব্যের হাতে। অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস যেমন সম্প্রতি বলেছেন, তিনি হয়তো আগামী কাল কোনও বাসের ধাক্কায় মারা যেতে পারেন, কিন্তু তাঁর অভিনয় হয়তো চলতেই থাকবে।

তবু বিতর্ক থেকেই যায়। মৃত মানুষের ছবি, ভিডিয়ো, কণ্ঠস্বর— এ সবের উপর অধিকার কার? কে ঠিক করবে, এগুলোকে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, কতটা ব্যবহার করা যায়? মৃত রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে এ সবের উত্তরাধিকার কি পরিবারের, না দলের? আবার সেই উত্তরাধিকার— পারিবারিক হোক কিংবা রাজনৈতিক— নিয়ে যদি বিবাদ থাকে, যদি থাকে অনেক দাবিদার, তা হলেই বা কী হবে? এ সব বিষয়ে আইনকানুন যে সর্বত্র খুব পরিষ্কার, তা-ও নয়। তবে অভিনেতা বা গায়কদের পুনরুত্থান যে-হেতু ঘটে চলেছে বেশ কিছু দিন ধরে, এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে অল্পবিস্তর। আইন সর্বত্র পরিষ্কার না হলেও, কিছু দেশে আইন আছে। মোটামুটি ভাবে পরিবার বা এস্টেটই অনুমতি দেয় অভিনেতাদের ক্ষেত্রে। এবং সেটাই চূড়ান্ত। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কোনও অভিনেতার ডিজিটাল প্রতিরূপ কোনও ছবিতে অভিনয় করবেন কি না, করলে কোন চরিত্রে করবেন, কোনও বিশেষ বিজ্ঞাপনে, এমনকি পর্নোগ্রাফিতেও যোগ দেবেন কি না, বা তাঁর ডিজিটাল অবতার ভোটের গরম হাওয়ায় কোনও বিশেষ প্রার্থী বা দলকে সমর্থন করে আরও একটু উত্তাপ ছড়াবে কি না, এ সবই ঠিক করতে পারেন সেই উত্তরাধিকারীরা। তাঁদের ইচ্ছাই চূড়ান্ত।

অনেকে একে মনে করেন মৃতের অধিকার খর্ব করা, এবং এই বিষয়টা তাঁদের মনঃপূত নয় একেবারে। আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত অবতারকে দিয়ে তো তার নির্মাতা ইচ্ছামতো কাজ করাতে বা কথা বলাতে পারেন। যেমন, করুণানিধির ডিপফেক অবতারকে দিয়ে ডিএমকে-র পক্ষে যেমন প্রচার করানো যায়, তেমনই ইচ্ছে করলে প্রচার করানো যায় বিরোধী এআইএডিএমকে-র পক্ষেও! ডিপফেক নির্মাতারা যেমন চাইবেন, তেমনই। তাই আইনকে সরিয়ে রেখে বলা চলে যে, কোনও মৃত রাজনৈতিক নেতার দলীয় উত্তরাধিকারীরা যেমন তাঁর ডিপফেকের সাহায্যে নিজেদের প্রচার করাতে পারেন, বিরোধীরাও তাঁদের প্রচার সারতে পারেন বইকি। সত্যি-মিথ্যার সীমারেখা ক্রমেই ঘোলাটে হতে থাকে, হতে থাকে আরও বিস্তৃত।

আবার মৃতকে ফিরিয়ে আনার বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও ক্রমবর্ধমান। যেমন, চিনে বাৎসরিক সমাধি-পরিষ্কারের দিনে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের প্রিয়জনদের স্মরণ করতে ভিড় জমান তাঁদের সমাধিতে। সে পরিপ্রেক্ষিতেই এখন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নামমাত্র মূল্যে চিনাদের সুযোগ দিচ্ছে তাঁদের প্রিয়জনদের চলমান ডিজিটাল অবতার তৈরির। ২০২৫-এর মধ্যে সে দেশে ‘ডিজিটাল মানুষ’-এর বাজার নাকি পৌঁছবে প্রায় ৬.৬৪ বিলিয়ন ডলারে, এমনই পূর্বাভাস!

ফিরে আসা যাক মাইকেল গ্রোথাসের কথায়। ‘ডিপফেক’-এর মাধ্যমে মৃত বাবার নবরূপায়ণ তাঁর মনে সৃষ্টি করে পরস্পরবিরোধী আবেগ। ভিডিয়োটা বার বার দেখতে থাকেন তিনি, উপভোগ করেন বাবার সঙ্গে এই নতুন যোগসূত্র। কিন্তু বাস্তবের দুনিয়ায় তা যে বড়সড় ফাটল ধরাচ্ছে, তা অনুভব করে, এবং সত্যি আর আস্থা সম্পর্কিত আমাদের ধারণার উপরে এর প্রভাবের কথা ভেবে ক্রমেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মাইকেল। মুছে দেন ভিডিয়োটা। তাঁর বইয়ের ‘দি এন্ড অব লাইফ’ শীর্ষক শেষ অধ্যায়ে গ্রোথাস লিখছেন, “ডিপফেক সম্পর্কিত সবই বেশ জটিল, শুধুমাত্র তা তৈরি করতে যে দক্ষতার প্রয়োজন সেটা ব্যতিরেকে।”

তবু, ডিপফেকের মাধ্যমে মৃতের পুনরুত্থান চলতেই থাকে। আর যা কিছু সত্যি, যা কিছু বিশ্বাসযোগ্য, কিংবা সম্ভবপর, তার পরিধি ভেঙেচুরে তৈরি হতে থাকে মোহময় আবছায়ায় ঘেরা ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকা এক নতুন ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’। বাস্তব আর কল্পনা সেখানে মিলেমিশে একাকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Deep Fake Artificial Intelligence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE