E-Paper

চাই নতুন চিন্তার রাজনীতি

পশ্চিমবঙ্গের দরকার নতুন প্রজন্মের পেশাদার রাজনৈতিক নির্মাণকর্মী, যাঁরা জানবেন এ এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই কর্মীদের জন্য চাই উৎস, ব্যবহার ও জবাবদিহির স্পষ্ট ব্যবস্থা-সহ স্বচ্ছ, বৈধ ও সংগঠিত তহবিল, যাতে তাঁরা পূর্ণকালীন কাজ করতে পারেন।

সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:২৮

বিহারের জন সুরাজ আন্দোলনের মধ্যে দেখা যেতে পারে, অন্তত এখনও পর্যন্ত— রাজনীতি যে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের অংশ হতে পারে, সেই সম্ভাবনার পুনর্জন্ম। সেই প্রসঙ্গে এ রাজ্যের কথা ভাবতে ইচ্ছে করে। এখানে কেবল ‘পার্ট-টাইম’ আদর্শবাদ, উৎসবমুখর স্বেচ্ছাসেবা, হঠাৎ-সক্রিয়তা দিয়ে রাজনীতি বদলাবে না। আজকের মিম, খেউড় আর হতাশার রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলার দরকার বিজ্ঞানভিত্তিক, দূরদর্শী, নতুন রাজনৈতিক দল, যার বিজ্ঞাপনে নেতা বা নেত্রীর মুখ নয়, থাকবে পরিষ্কার লক্ষ্য ও নীতির ছবি।

পশ্চিমবঙ্গের দরকার নতুন প্রজন্মের পেশাদার রাজনৈতিক নির্মাণকর্মী, যাঁরা জানবেন এ এক দীর্ঘ পথযাত্রা। এই কর্মীদের জন্য চাই উৎস, ব্যবহার ও জবাবদিহির স্পষ্ট ব্যবস্থা-সহ স্বচ্ছ, বৈধ ও সংগঠিত তহবিল, যাতে তাঁরা পূর্ণকালীন কাজ করতে পারেন। বাংলার বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত যাঁরা, তাঁদের আশু কর্তব্য এমন যৌথ উদ্যোগ।

পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫৪ কোটি বছর। জল, তাপমাত্রা, বায়ু, সূর্যালোক— অজস্র শর্তের নিখুঁত সংমিশ্রণে প্রাণের বৈচিত্র ও বিবর্তনের এই যাত্রা সম্ভব হয়েছে। তুলনায় মানুষের ইতিহাস মাত্র তিন লক্ষ বছরের। বন কাটা, নদী বদলানো, বায়ুদূষণ, সমুদ্র গরম করা— সব মিলিয়ে মানুষ গত এক হাজার বছরের মধ্যে সেই শর্তগুলোই মারাত্মক ভাবে বিপন্ন করেছে। আমাদের দায়িত্ব পৃথিবীর সেই প্রাকৃতিক শর্তগুলি রক্ষা করা, যেগুলির উপর জীবনের ধারাবাহিকতা নির্ভর করে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা— সব কিছুর লক্ষ্য হওয়া উচিত সেই বৈচিত্র ও বিবর্তনের ধারা অটুট রাখা। এই রাজ্যেও রাজনীতির প্রাথমিক মূল ভিত্তি হতে হবে প্রকৃতিবান্ধব সুস্থায়ী উন্নয়নের রাজনীতি।

অনেক উন্নত দেশে সরকারি হাসপাতাল, স্থানীয় ক্লিনিক, জরুরি পরিষেবা— এ সবের মর্যাদা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই যে সমানাধিকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা— ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস)— নানা ওঠাপড়ার মধ্যেও তা আজও ব্রিটিশ সমাজের গর্ব। এনএইচএস-এর বার্ষিক বাজেট ২২ লক্ষ কোটি টাকা। গড়ে প্রতি নাগরিক-পিছু বছরে ২.৫-৩ লক্ষ টাকা। তুলনায়, ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার (কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে) স্বাস্থ্যখাতে প্রতি নাগরিক-পিছু বছরে গড়ে মাত্র ১.৫-২ হাজার টাকা ব্যয় করে। অর্থাৎ, ব্রিটেন প্রতি নাগরিকের স্বাস্থ্যের পিছনে আমাদের তুলনায় প্রায় ১৭০-২০০ গুণ বেশি বিনিয়োগ করে।

সরকার যখন নাগরিকের মৌলিক অধিকারে (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামো, পরিবেশ) পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে, তখনই সমাজ সাম্যের দিকে এগোয়। অর্থ কিন্তু আকাশ থেকে পড়ে না। বিদেশি ঋণ বা কেন্দ্রের অনুদানের উপর নির্ভর করে কোনও রাজ্য সুস্থায়ী উন্নয়ন করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ ধনী নয়, কারণ আমাদের সম্পদ-সৃষ্টির ইঞ্জিন দুর্বল। রাজস্ব বাড়াতে হলে আগে শিক্ষা-দক্ষতা-সুশাসন শক্ত করা চাই। আজ বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে সরকারি স্কুল ও কারিগরি দক্ষতামূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষক কম, পরিকাঠামো ভেঙে পড়ছে। স্বভাবতই শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সন্তানদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন দামি বেসরকারি স্কুলে, ভিন রাজ্যে বা বিদেশে। এই শিক্ষাব্যবস্থা যদি যত্ন দিয়ে নতুন করে গড়া না যায়, তবে কোনও শিল্প ও বিনিয়োগই দীর্ঘমেয়াদে টিকবে না। যে কোনও উন্নয়নমুখী রাজ্যের মূলে তিনটি স্তম্ভ থাকা উচিত: শিক্ষা, শিল্প ও পরিকাঠামো। ফলত নতুন ভাবে শিল্পায়নের পথে হাঁটা ছাড়া গতি নেই— নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ, জল, রাস্তা ও জমির ব্যবস্থার মাধ্যমে। শিল্পায়ন বাড়লে অর্থনীতি সংগঠিত হয়, অপরাধ দুর্নীতি বেকারত্ব হতাশা কমে, মানুষ স্থায়ী আয়ে সমাজের দায়িত্ব নিতে শেখে— অন্তত এখনও অবধি সে রকম মডেল দৃশ্যমান। সুইডেন-নরওয়ে দেখিয়েছে, সমতা, জনকল্যাণ ও শিল্প কী ভাবে এক সঙ্গে রাখা যায়।

এই রাজ্যে দেশভাগের ক্ষত, সম্পত্তি-হারানো, শিকড়-ছেঁড়া মানুষের বেদনা এখনও রাজনীতি-সমাজে সক্রিয়। এই বিদ্বেষ-প্রসবী রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন কত জরুরি, তা বুঝতে হবে। সীমান্তের বাস্তবতা মেনে নিয়ে, বর্তমান জনসংখ্যাকেই শক্তি হিসেবে দেখতে হবে— বোঝা হিসেবে নয়। শান্তি ও সহাবস্থান সুস্থায়ী উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত। আর সে জন্যই রাজনীতির প্রথম কাজ— অভ্যন্তরীণ শান্তি, সহিষ্ণুতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা।

পরিবেশবান্ধব, বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন রাজনীতি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ অন্ধকারমুক্ত হবে না। সেই রাজনীতির মূলে থাকবে জীববৈচিত্র ও বিবর্তনের ভারসাম্য রক্ষা, লিঙ্গসমতা, সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য দূরীকরণ। থাকবে বিশ্ব স্তরের সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তিগত নিরাপত্তা; পরিবেশবান্ধব কৃষির দ্রুত আধুনিকীকরণ। থাকবে দুর্নীতিমুক্ত বিচার ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-ভাষাভিত্তিক হিংসার কঠোর দমন, বাক্‌স্বাধীনতার মুক্তি। সর্বোপরি— ভয়হীন, উচ্চশির সমাজজীবনের পুনর্গঠন।

এমস, কল্যাণী

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Politics politician

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy